শুভ জন্মদিন শ্রেষ্ঠ ক্রীড়া সংগঠক শেখ কামাল!!

বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল।ছবি : পাভেল রহমান
যিনি আমাকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি আমার পাথেয় হয়ে আছেন। তাঁর স্মৃতি স্মরণ করছি।
শ্রদ্ধেয় শেখ কামালকে পরিচয় করে দিতে যদি বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল বলি তাতে তাঁর কর্মের পূর্ণতার প্রতিফলন ঘটে না। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র বললেও না। তবে স্বাধীনতা উত্তর ক্রীড়া কিংবা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের যে নীরব বিপ্লব ঘটে যায় সেই বহুমাত্রিক এক ‘ ওয়ান্ডার বয় ‘ ছিলেন ২৫ বছরের যুবক শ্রেষ্ঠ ক্রীড়া সংগঠক শেখ কামাল। এই বিশ্লেষণের কিছুটা হলেও সম্মান দেখানো যায় তাঁকে।
শেখ কামাল ছিলেন বিরল এবং বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। খেলাধুলার প্রতি তাঁর যেমন আগ্রহ ছিল তেমনই ছিল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে এক নিবেদিত প্রাণ। জীবনের শুরুতেই ছাত্র রাজনীতি, বিমান বাহিনী শাহিন স্কুলে ক্রিকেট আর বাস্কেট বল খেলার প্রতি আগ্রহ, মুক্তি সংগ্রামে ২২ বছর বয়সে ভারতের দেরাদুনে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের সশস্ত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিসংগ্রাম চলাকালীন স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে যুব সমাজকে নিয়ে একটা পরিকল্পনা করে ফেলেন কামাল ভাই। সেখানে প্রাধান্য থাকে ক্রীড়া এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড।
দেশে পুনর্গঠনে যখন পিতা সকাল থেকে রাত শুধু কাজ আর কাজে চষে বেড়িয়েছেন দেশ সেখানে অস্ত্র জমা দেবার পর যেন যুব কিশোরদের মনে হতাশা না ঢুকে পড়ে তাঁর বিরুদ্ধে তিনিও সকাল থেকে রাত ছুটেছেন মাঠ থেকে মাঠে , মঞ্চ থেকে মঞ্চে। নিজের হাতে তৈরি করেছেন দেশে আধুনিক ফুটবল টিম আবাহনী ক্রীড়া চক্র। আবাহনীর চমকপ্রদ সাফল্যে হকি টেবিল টেনিস ক্রিকেট ভলিবল টিম তৈরী করে সারা দেশে এগিয়ে যান।
অন্য দিকে শেখ কামাল নিজে ‘ ছায়ানটের ‘ একজন শাস্ত্রীয় সংগীতের যেমন ছাত্র ছিলেন তেমনি ধানমণ্ডির বাড়ীতে প্রতি সকালে ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদের কাছে সেঁতার এর তালীম নিতেন। তাছাড়া পিয়ানো গীটারে তার টান ছিলো। তার তিনতালার ঘরটি ছিল নানা রকম বাদ্য যন্ত্রের সমাহার সাথে ছিল ওয়ার্ল্ড মিউজিকের বিশাল কালেকশন। দিনের শুরু সঙ্গীত, ফুটবল, ক্রিকেট হলেও সন্ধ্যায় তিনি স্টেজ থেকে স্টেজে। কখনো থাকেছেন নাটকের অভিনয়ে ব্যস্ত। কিংবা থেকেছেন রিহারসেলে। তার অভিনীত নাটক নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন ভারত সফরে। কলকাতার স্টেজে মুনির চৌধুরীর বিখ্যাত ‘কবর’ নাটক মঞ্চায়ন করেন তিনি। বাংলা একাডেমি মঞ্চেও অভিনয় প্রতিভার সাক্ষর রাখেন শেখ কামাল। আবার কখনো ব্যস্ত থেকেছেন ফিরোজ শাই ফকীর আলমগীর কিংবা হাবলুদের নিয়ে স্পন্দনে।
পরিচয়ের আগেই ছবি তোলা শেষ। অনেকটা পিতা বঙ্গবন্ধুর মতই পুত্রের। যেদিন ঢাকা স্টেডিয়ামের ক্রিকেট মাঠে প্রথম দেখি। সেইদিন সাদা সার্ট ‑আর সাদা প্যান্ট পড়া এক যুবক হাতে ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে মাঠে নামছেন। সে সময় সিনিয়ার ফটোগ্রাফারদের মাঝে টেলিলেন্স ব্যবহারে কোন প্রচলন ছিল না। থাকবে কি করে সবার হাতেই যে ১২০ মিলিমিটারের বক্স ক্যামেরা। খেলোয়াড়দের কেউ ফিফটি কিংবা ১০০ রান হাঁকালে অ্যামপেয়ারদের অনুমতি নিয়ে দৌড়ে ক্রিজে পৌঁছে যাই ছবি তুলতে। এক্কে বারে মধ্য মাঠে ব্যাটস ম্যানের সামনে দাঁড়িয়ে। ১৯৭৩ সালের সেইদিন সেই ব্যাটসম্যান ছিলেন শেখ কামাল। সেই প্রথম শেখ কামালের ছবি তোলা। তাঁকে প্রথম দেখাতেই আমার ভালো লেগে যায়। তাঁর কথায় সবাইকে সম্মান করার প্রবণতা। এতদিন দূর থেকে দেখা শেখ কামাল সামনে একদাম অন্য রকম হয়ে যায় ! নেই কোন অহংকার নেই কোন বাহ্যিক গরিমা। একেবারেই সাধারণ এক যুবক যেমন তেমনি ! শরীরের চেয়ে বড় এক জোড়া গোঁফ। সেই গোঁফের নীচে অমলিন একটুকরো হাসি সব সময় লেগেই আছে ঠোট জুড়ে। অন্য সবার চেয়ে কনিষ্ঠ বলে আমার ক্যামেরায় একটু যেন বেশি বেশি ব্যাট উঁচিয়ে পোজ দিলেন তিনি, শেখ কামাল !
সেই ভালোলাগা মানুষটার সঙ্গে আবার দেখা হয় আকস্মিক ধানমণ্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নাম্বারের বাড়িতে। সেই দিন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের সকালে ! শিশু কিশোর সংগঠন খেলাঘরের শিশুদের এক অ্যাসাইনমেন্ট ছিল আমার। আমি তখন সাপ্তাহিক একতায়।
সেই ভালোলাগা মানুষটার সঙ্গে আবার দেখা হয় আকস্মিক ধানমণ্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নাম্বারের বাড়িতে। সেই দিন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের সকালে ! শিশু কিশোর সংগঠন খেলাঘরের শিশুদের এক অ্যাসাইনমেন্ট ছিল আমার। আমি তখন সাপ্তাহিক একতায়।
বঙ্গবন্ধুর ছবি তোলার ফাঁকে গাড়ি বারান্দায় আসতেই দেখা হয়ে গেল কামাল ভাইয়ের সঙ্গে। কামাল ভাই ক্র্যাক প্লাটুনের দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জাল চৌধুরী মায়া ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমাকে দেখেই কামাল ভাই বঙ্গবন্ধু শুভানুধ্যায়ীদের উপহার আনা জন্মদিনের একপিস কেক তুলে দিতে দিতে বললেন , ‘কেমন আছো?’
আমি চমকে উঠি তাঁর আন্তরিক ঐ সম্ভাষণে। এতো আপন করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন? যেন কত দিনের পরিচয় আমাদের। আমি মাথা নেড়ে বলি, ভালো। তিনি বললেন, ‘ কোথায় কাজ করো তুমি’? ‘তুমি কি আমাদের আবাহনীর ছবি তুলে দিবে ‘? ওনার কথাগুলি শুনে আমি বিস্মিত হয়ে যাই ! প্রথম সাক্ষাতেই তিনি আমাকে দেশের প্রখ্যাত ক্রীড়া সংগঠন আবাহনী ক্রীড়া চক্রের ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করার আমন্ত্রণ জানালেন। বললেন, ‘আবাহনী ক্লাব কোথায় তুমি চেনো?’ সন্ধ্যায় চলে এসো ক্লাবে আমরা গণভবনে যাব বঙ্গবন্ধুকে আবাহনীর পক্ষ থেকে ফুল দিতে ’।
আবাহনীর ছবি তুলব আমি? নিজেকেই আমার বিশ্বাস হয় না। খুশিতে আমি আত্মহারা হয়ে যাই। আমার সেই ‘সকাল ’ আর ‘সন্ধ্যা’ হতে চায় না। আমার প্রিয় আবাহনী মুহূর্তে আরও প্রিয় হয়ে যায়। সেই সন্ধ্যায় গণভবনে অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা ঘটে গেল আমার জীবনে! আবাহনীর ফটোগ্রাফার হিসাবেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করে দেন কামাল ভাই। দেশের বিখ্যাত সব খেলোয়াড়দের নিয়ে আবাহনীর কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানাতে গণভবনে। প্রথমেই কামাল ভাই ফুলের মালা পড়িয়ে দিলেন পিতা বঙ্গবন্ধুকে। আমার ক্যামেরায় সেই সন্ধ্যায় দারুণ এক ছবি উঠে এলো । উৎফুল্ল বাবা আর ছেলের। এরই মাঝে শুভেচ্ছা জানাতে শুরু করেছেন দেশের স্টার ফুটবলাররা আর ক্রীড়াবিদরা। এক এক করে সালাউদ্দিন অমলেশ দাদা, শামছূ ভাই , আশরাফ ভাই , হারুন ভাই , তারেক ভাই , অনেকে।

আকস্মিক কামাল ভাই আমাকে ডাকলেন, ‘পাভেল পাভেল ’। আমি তাঁর সামনে আসতেই তিনি আমাকে বঙ্গবন্ধুর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘ আব্বা, ও হচ্ছে আমাদের আবাহনীর ফটোগ্রাফার ‘! ঘটনার আকস্মিকতায় মুহূর্তেই আমি নার্ভাস হয়ে যাই। শরীর হেলিয়ে চেয়ারে বসা বঙ্গবন্ধু আবাহনীর ফটোগ্রাফার শুনেই নড়ে চড়ে বসলেন , তিনি বিস্মিত ! বললেন ‘ কি ? তোদের আবাহনীতে আবার ফটোগ্রাফারও আছে নাকি ‘? বঙ্গবন্ধুর কথায় এবার আমি আরও নার্ভাস। এমনিতেই এতো এতো সুপার স্টার বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে সেখানে আমি পুচকে এক ফটোগ্রাফার ! বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয়ে আমাকে কেমন বেমানান লাগে ! ‘ আবাহনীর ফটোগ্রাফার ‘ শুনেই বঙ্গবন্ধু আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কামাল ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ? তোদের আবাহনীতে আবার ফটোগ্রাফারও আছে নাকি ‘? বঙ্গবন্ধুর ঐ কথায় আমার হার্ট বিট ধাক ধাক করে উঠে । কামাল ভাই তখন সহাস্যে বলে উঠলেন, ‘ হ্যা আব্বা আছে তো, আর ওর নাম হচ্ছে পাভেল ‘। পাভেল নামটা শুনে বঙ্গবন্ধু আমাকে কি জানি কি ভেবে কাছে টেনে নিলেন। তিনি স্মিত হাস্যে আমার বাম গালে তাঁর ডান হাত বুলাতে লাগলেন আর বলে উঠলেন, ‘পাভেল ! বাহ , কি চমৎকার নাম তোমার ‘?
৪৬ বছর পর আজও সন্ধ্যার সেই স্মৃতি আপ্লুত করে আমাকে। আমি বিস্মিত হই এই ভেবে ‘ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল নগণ্য এক ফটোগ্রাফার আমাকে কি করে এতো সম্মানিত করে দিয়েছিলেন।
৪৬ বছর পর আজও সন্ধ্যার সেই স্মৃতি আপ্লুত করে আমাকে। আমি বিস্মিত হই এই ভেবে ‘ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল নগণ্য এক ফটোগ্রাফার আমাকে কি করে এতো সম্মানিত করে দিয়েছিলেন।
একদিন আমার বাড়ি ফিরতে আজিমপুর মোড়ে পুলিশের ব্যারিকেডে আটকে গেল কামাল ভাইয়ের নীল টয়োটা। আমাকে আজিমপুর কলোনির বাসায় ড্রপ করতে এসে। সহযাত্রী কেউ একজন গাড়ির ভিতর থেকে পুলিশের উদ্দেশ্যে বলে বসলেন, ‘ এটা শেখ কামালের গাড়ি ’। কিন্তু সার্জেন্ট সে কথা আমলে নিলেন না। তিনি গাড়ি চেক করবেন। সঙ্গে সঙ্গে কামাল ভাই গাড়ি থেকে নেমে আমাদেরও নামতে নির্দেশ করলেন। পুরো গাড়ি চেক করলেন পুলিশ সার্জেন্ট।
প্রেসিডেন্টের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল বলে বিন্দুমাত্র বাড়তি সুবিধা নেননি কামাল ভাই ! এমনকি পুলিশ সার্জেন্টকে তাঁর ডিউটির প্রশংসা করতে ধন্যবাদ দিতে ভুলেননি তিনি ! এমনই ছিলেন কামাল ভাই জীবনের শেষ মুহূর্তই পর্যন্ত।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট !
বাড়ির তিনতালার শয়ন কক্ষে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল। গোলাগুলির আওয়াজে তিনি শয়ন কক্ষে নব বিবাহিত স্ত্রীকে রেখে প্রথম ছুটে আসেন নীচ তালায় , গাড়ী বারান্দায়। ততক্ষণে বিরামহীম ভারী মেশিনগানের শব্দ ছুটে আসছে ধানমণ্ডি ৩২ নাম্বারের দিকেই। তিনি ছুটে এসে দেখলেন কিছু সেনা কর্মকর্তা পুলিশ সদস্য দিব্বি দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের উদ্দেশে শেখ কামাল বলে উঠলেন, ‘ পুলিশ ভাইরা আর্মি ভাইরা এতো গোলাগুলি চলছে, আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন কেন ‘? তিনি সবাইকে হামলা প্রতিহত করে প্রেসিডেন্টকে তাঁদের পরিবার কে রক্ষার দায়িত্বের কথা স্মরণ করে দেন।
কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য ছদ্মবেশী অফিসাররাই মুহূর্তে তাঁর দিকেই গুলিবর্ষণ করে নিহত করে শ্রেষ্ঠ ক্রিয়া সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা জাতির পিতার ২৬ বছরের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালকে। যিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কেউকে একটি কটু কথা বলেননি।
এমন নির্মম মৃত্যু না এলে কি বিশাল হতো আমাদের ক্রীড়া নৈপুণ্যের আকাশ ! কী অপূর্ব হতো আমাদের সাংস্কৃতিক বাতাস ! ৭২তম জন্মদিনে তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা !
পাভেল রহমান : একুশে পুরস্কারপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী