কিশোর কুমার এক সর্বকালীন, সর্বজনবিদিত ও সর্বজনপ্রিয় শিল্পী

সঙ্গীত এমন এক জিনিস যা প্রতিটা মানুষকে হতাশা, ব্যর্থতা, শোষণ, বঞ্চনা, দগ্ধতা জীবনের টানাপোড়েন দুর্দশার আচ্ছন্ন থেকে বাঁচার ঝলক দেখায়, অনুপ্রেরণা যোগায়। সঙ্গীত যেন মানুষের কাছে চিরায়ত পথচলার নব দিশা। আমরা দেখেছি পৃথিবীব্যাপী সংগীতের প্রতি মানুষের ভালোলাগা, মুগ্ধতা, উচ্ছ্বাস। সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ সংগীত। এই সঙ্গীত বা গানের জগতকে আপামর দর্শক শ্রোতার কাছে সুচারু, সুনিপুণ, শিল্প সুষমায় পৌঁছে দেন গীতিকার, সুরকার, যন্ত্রশিল্পী এবং অবশ্যই কন্ঠের অধিকারী নিবেদিতপ্রাণ শিল্পীরা।
আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের নান্দনিকতার ভুবন কে, বেঁচে থাকার চিরায়ত পরিসরকে, আগামীর পরিকল্পনাকে স্বতন্ত্রীকরণ চিন্তাভাবনার বুনোটে বেঁধে রাখতে পারে সংগীতের জাদুতে। এখানেই সঙ্গীত অর্থাৎ গানের প্রাসঙ্গিকতা, তাৎপর্য ও ভালোলাগা। যুগ যুগ ধরে এভাবেই সাধারণ মানুষ মুগ্ধ হয়েছে সুললিত কন্ঠের গানের জাদুতে। তারা যেন নিজেদের নতুনভাবে মেলে ধরার, বিকশিত করার সর্বোপরি লড়াইয়ের ময়দানে অস্তিত্ব টিকে থাকার প্রাণ দায়ী অপরিহার্য রসদ মণি মুক্তোর মতো খুঁজে পাই।

সেখানেই গানের বিশেষত্ব, সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা, মননশীলতা। সেই সঙ্গীত অর্থাৎ গানের ভুবন কে বাঁচিয়ে রাখে অগণিত নিবেদিতপ্রাণ সঙ্গীত শিল্পীরা। রক্ত মাংসে গড়া শরীর একদিন নশ্বর হয়ে যায়, ঝরে যায় অকালে বহু গুণী মনন। কিন্তু বেঁচে থাকে সৃষ্টিশীলতা, সৃজনশীলতা, শিল্প সত্তা।।শিল্পীর মৃত্যু হয় না। পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে তার পরেও তাঁরা হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকেন। মানুষ যেন তাদের ভুলতে দেয় না। মননের মনি কোঠায় পাকাপাকি জায়গা করে নেয়। মানুষের স্মৃতিতে, মনে, ভালো লাগায়, খারাপ লাগায় চিরসঙ্গী হয়ে রয়ে যান শিল্পীরা। এমনই একজন চিরস্মরণীয় শিল্পীর আজ জন্মদিন। যাঁর গানের ভুবনে, সুরের জাদুতে, মূর্ছনায় ভেসে গিয়েছে আসমুদ্রহিমাচল আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। যাঁর গান মানুষের বেঁচে থাকার, পথ চলার, ভাবনার, নান্দনিকতার, জীবনের জিয়ন কাঠিতে পরিণত হয়েছিল। যাঁর গান উদ্বেলিত, নাড়া দিয়েছিল বিভিন্ন প্রজন্মের সঙ্গীত অনুরাগীদের। যিনি এখনো আপন প্রতিভায়, অনাবিল গায়কিতে স্বমহিমায় সঙ্গীতপ্রেমী, সংস্কৃতি মনস্ক ভারতীয়দের মধ্যে একচ্ছত্র ভাবে বিরাজ করছেন তিনি আর কেউ নন আমার আপনার সকলের প্রিয় শিল্পী কিশোর কুমার।
খুব আনন্দে কিংবা প্রেমে মন ভাঙলে আজও তাঁর গান শুনে নিজেদের অনুভূতিগুলিকে যেন মোলায়েম পরতের মধ্যে ধরে রাখা যায়। তাঁর গান শুনেই যেন আলোর গতিতে পৌঁছে যাওয়া যায় পুরনো দিনে। মরচে পড়া স্মৃতিকে যেন জলজ্যান্ত করে তোলে তাঁর গান।

আজ সেই আভাস কুমার গঙ্গোপাধ্যায় তথা কিশোর কুমারের জন্মদিন। প্রতিবছর এই বিশেষ দিনটি যেন তাঁর সংগীতচর্চায়, সাধনায়, আলোচনায় আরো বেশি প্রাসঙ্গিক, অর্থবহ হয়ে উঠে। প্রতিনিয়ত চিন্তা-চেতনায়, স্মরণে, মননে তিনি যেন আমাদের আরো আপনজন, সর্বজন পরিচিত, ভালোলাগার শিল্পীতে নিজেকে উদ্ভাসিত করে তুলেন। এখানেই কিশোর কুমার চিরসবুজ, অমলিন, জনপ্রিয়, ভালোলাগার, ভালোবাসার বর্ণময় শিল্পী সত্তার অধিকারী।
১৯২৯ সালের ৪ অগাস্ট মধ্যপ্রদেশের এক বাঙালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কিশোর কুমার। আজ তাঁর ৯২ তম জন্মবার্ষিকী। কিশোর আসলে তাঁর ডাক নাম ছিল। ভালো নাম আভাস কুমার গঙ্গোপাধ্যায়। বম্বে টকিজ ছবিতে দাদা অশোক কুমারের সঙ্গে গান গেয়েছিলেন। সেই সময়ে নিজের কিশোর নামটাই ব্যবহার করেছিলেন তিনি। পরে সেই নামটাই থেকে যায়। সেই নামে গান গেয়ে জয় করেছিলেন প্রতিটি ভারতীয়দের মনন, ভালোবাসা, অফুরন্ত প্রশংসা। কিশোরকুমার নামই যেন শিল্পী কিশোর কুমার কে জনপ্রিয়তা, যশ খ্যাতির মধ্য গগনে পৌঁছে দিয়েছিল। সেখান থেকে পিছনে ফিরে তাকায় আর কোনো অবকাশই ছিল না।

সঙ্গীতে প্রথাগত প্রশিক্ষণ না নিয়েও গানের জগতে তিনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। অর্থাৎ খোলসা করে বলতে গেলে কিশোর কুমারের সে রকম গান শেখার, চর্চার নিরবচ্ছিন্ন তালিম, প্রশিক্ষণ ছিল না। অনেকটা সহজাত, জন্মগত প্রতিভাকে পাথেয় করে তাঁর সুরের দুনিয়া প্রসারিত হয়েছিল। সেখানে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী, অপ্রতিরোধ্য, লম্বা রেসের ঘোড়া। যাঁর জীবনের ধ্যান-জ্ঞান ভালোলাগা আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রাপ্তি জুড়েই শুধু মাত্র গানের মূর্ছনা।

ব্যক্তিগত জীবনে কিশোর কুমার কে এল সায়গলকে নিজের সবচেয়ে বড় আদর্শ মানতেন। ১৯৪৮ সালে জিদ্দি ছবিতে প্রথম একটি গানে প্লেব্যাক করেন তিনি। তবে শুধু গান নয়। অভিনেতা হিসেবেও যে তিনি পারদর্শী, তা প্রমাণ করেছেন কিশোর। এমনও হয়েছে, শরারত ও রাগিনী ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। আর তাঁর কণ্ঠে গান গেয়েছেন মোহাম্মাদ রফি। তাঁর অভিনীত বেশ কিছু ছবি হিট ছিল বক্স অফিসে। তাঁর বিপরীতে বৈজন্তিমালা, মধুবালা ও সায়রা বানুর মতো অভিনেত্রী কাজ করেছেন। গানের পাশাপাশি সেলুলয়েডের পদ্ধতি তিনি ছিলেন সমানভাবে সাবলীল।

গানের জীবনে বাংলা, হিন্দি, ভোজপুরি, অসমিয়াসহ দুইহাজারও এর বেশি গান গেয়েছেন কিশোর কুমার। আটবার পেয়েছেন ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড। তাঁর গানে সেলুলয়েডের পর্দায় কণ্ঠে দিয়েছেন অমিতাভ বচ্চন, উত্তম কুমার, রাজেশ খান্না, সঞ্জীব কুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়সহ আরও অনেকে। তাদের জনপ্রিয়তা, চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় হওয়াটা অনেকটা কিশোর কুমারের কন্ঠের গানের উপর নির্ভর করত।
শচীন দেববর্মন, রাহুল দেববর্মন, গুলজার, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়সহ আরও বহু সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। হিন্দি সিনেমার গানের জগতে তিনি হলেন একচ্ছত্র, কালজয়ী সংগীতশিল্পী। সবকিছুই একদিন থেমে যাবে, জীবনের ছন্দতা, পথশালা, প্রবাহমানতা প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে। তবুও সৃষ্টিশীলতা, সৃজন চর্চা, শিল্পীসত্তা, গানের নিত্যতা, সুরের মূর্ছনা বেঁচে থাকবে মানুষের মননে। কিশোর কুমার এমনই এক বর্ণময় ব্যক্তিত্ব, শিল্পী সত্তার অধিকারী যার আদ্যোপান্ত জীবনটাই ছিল সঙ্গীত সাধনা মোড়া। ভারতবর্ষের শিল্প-সংস্কৃতি তথা সংগীতের জগতে কিশোর কুমার এক সর্বকালীন, সর্বজনবিদিত, সর্বজনপ্রিয় শিল্পী। যিনি এখনো অগণিত সঙ্গীত পিপাসু, অনুরাগীদের মননে সব হবে বিরাজিত, শ্রদ্ধা সম্মানের এক অনন্য বহুমাত্রিক শিল্পী।
জন্মদিবসে এই অফুরান ভালোবাসার ভালোলাগার শিল্পীর প্রতি নিবেদিত প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ভক্তি। এভাবেই শিল্পী কিশোর কুমার হয়ে যাবেন সঙ্গীতপ্রেমীদের মননে চিরকালীন তাঁর মনভোলানো, প্রাণ জুড়ানো গানের ডালা নিয়ে।
পাভেল অমান, হরিহর পাড়া, মুর্শিদাবাদ, ভারত