আজি প্রণমি তোমারে

২ আগস্ট, রসায়ন তথ্য বিজ্ঞানজগতের অন্যতম গর্বের, স্মরণীয় একটি দিন । আজ এক সাধক, স্বনামধ্য রসায়নবিদ প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জন্মদিন। তিনি ১৮৬১ সালে, বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য বছর। এই বছর দুই জ্যোতিষ্ক প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন।ভিন্ন আঙিনায় কৃতি এই দুই মনীষী দার্শনিক, চিন্তাধারা এবং জীবনচর্চায় ছিলেন সমমনোভাবাপন্ন এবং মাহাত্ম্যপূর্ণ চিরভাস্কর।
প্রফুল্লচন্দ্র রায় একাধারে বৈজ্ঞানিক ও সমাজ সংস্কারক, দেশপ্রেমী ও শিল্পদ্যোগী এবং আচার্য ও তাপস, সমগ্র জীবনব্যাপী তাঁর নিরন্তর সাধনা এবং জনহিতার্থে বিজ্ঞানের প্রয়োগে তিনি চিরস্মরণীয়। রসায়নশান্ত্র ছিল প্রফুল্লচন্দ্রের প্রিয়। এক এ পড়াকালীন তৎকালীন অধ্যাপকদের রসায়ন পাঠদান কারণে তিনি রসায়নের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং রসায়নে অর্নাস নিয়ে স্নাতকস্তরে প্রেসিডেন্সি কলেজে স্নাতক স্তরে ভর্তি হন।
তিনি বর্তমানে বাংলাদেশের খুলনা এবং তৎকালীন যশোর জেলার অন্তর্গত রাড়ুলী গ্রামের এক ভুস্বামী পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হরিশচন্দ্র ছিলেন এক উদার দৃষ্টিভঙ্গী সম্পন্ন এবং শিক্ষার বিশেষ অনুরাগী। তাঁর সংগ্রহে ছিল বহু বই, বিভিন্ন বিষয়ে। প্রফুল্লচন্দ্র গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন এবং প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি ১৮৭০ সালে কলকাতা হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে দু’বছর পরে তিনি কলকাতা ত্যাগ করে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন। দু’বছর গ্রামে থাকার পর পুনরায় তিনি কলকাতার আলবার্ট স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং ১৮৭৮ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উর্ত্তীন হন এবং ১৮৮০ সালে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউট ( বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ) থেকে এক এ পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হন। পরবর্তীকালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়নে স্নাতকস্তরে ভর্তি হন। তিনি ১৮৮২ সালে গিলক্রাইস্ট বৃত্তি লাভ করেন এবং স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৮৮৫ সালে বিএসসি এবং ১৮৮৭ সালে রসায়নে ডিএমসি ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি প্রথমে বেঙ্গল এডুকেশন সার্ভিসে যোগ দেন এবং ১৮৮৯ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়নের সহকারি অধ্যাপক পদে যোগদান করেন।
১৯১৬ সাল পর্যন্ত এই কলেজে অধ্যাপনার পর তিনি রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজে রসায়নে স্যার তারকনাথ পালিত নামাঙ্কিত পালিত অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদটি অলঙ্করণ করেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি আমৃত্যু এমিরিটাস অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত থাকেন।

অসামান্য পাঠদান পদ্ধতি, রসায়নের জটিল তত্ব সুশ্রাব্য এবং রসময় পরিবেশেনে শিক্ষক হিসেবে তাঁর খ্যাতি অচিরেই ছড়িয়ে পড়ে, তাঁর ছাত্র তালিকা সুদীর্ঘ এবং তাঁর বহুছাত্র স্বগরিমায় তাঁদের র্কীতি স্থাপন করেছেন, উল্লেখযোগ্য ছাত্ররা হলেন সত্যেন্দ্রনাথ বোস, মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, পঞ্চানন নিয়োগী, পুলিনবিহারূ সরকার, এ কে ফজলুল হক, রসিকলাল দত্ত প্রমুখ বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ। শিক্ষকতার পাশাপাশি চলতে থাকে প্রফুল্লচন্দ্রের গবেষণা। ১৮৯৬ সালে প্রেসিডেন্স কলেজের গবেষণাগারে তিনি উৎপন করেন মারকিউরাস নাইট্রাইট [Hg2(NO2)2] নাম যৌগটি রসায়নে এক গুরুত্বপূর্ণ এবং বিস্ময়কর এই আবিস্কার, অত্যন্ত ভঙ্গুর এবং অস্থায়ী এই যৌগটির প্রস্তুত রসায়নবিদদের কাছে অসম্ভব ছিল, প্রায় সমস্ত ধাতুর নাইট্রাইট যৌগ তৈরি করা গেলেও এই যৌগটি ছিল অধরা। প্রফুল্লচন্দ্র এই যৌগটি তৈরি করলেন পারদের সঙ্গে লঘু নাইট্রিক অ্যাসিডের বিক্রিয়ায়। ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা তাঁকে ভূষিত করলেন মাস্টার অফ নাইট্রাইটস হিসেবে। এই গবেষণা পত্রটি প্রকাশিত হয় এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল এই জার্নালে এবং ১৮৯৬ সালে ২৮ মে লন্ডনের নেচার পত্রিকায়। তিনি ভেষজ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে, নিজের দেশের বাড়িতে, এই সময়েই তাঁর চিন্তায় আসে শিল্প প্রতিষ্ঠার ভাবনা। পরবর্তীকালে তিনি তৈরি করলেন বেঙ্গল কেমিক্যালস, ভারতের ইতিহাসে করলেন নতুনকালের সূচনা, একজন বৈজ্ঞানিক গবেষক এক সফল শিল্পদ্যোগী হিসাবে বাঙালিকে করলেন উদ্বুদ্ধ,দেখালেন দিশা।
বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে শিক্ষক,দার্শনিক,ইতিহাসবিদ ও কবি হিসেবেও তাঁর ছিল অসামান্য দক্ষতা, কেবলমাত্র বিজ্ঞানশিক্ষা নয়, সমগ্র বাঙালি জাতিকে অন্তর থেকে বিজ্ঞানমনস্ক এবং বিজ্ঞান চেতনায় জাগরুক করে তোলা ছিল তাঁর আজীবন সাধনা। পুঁথিগত বিজ্ঞানশিক্ষা অপেক্ষা ব্যবহারিত এবং ফলিত বিজ্ঞানেরর প্রসার, বাংলায় (মাতৃভাষা) বিজ্ঞান শিক্ষা এবং চর্চা ছিল তাঁর ব্রত। ব্যবসাবিমুখ বাঙালিকের সাবলম্বী উপাজর্নের আদর্শে অনুপ্রাণিত করা ছিল তাঁর লক্ষ্য, বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস ছাড়াও তাঁর উদ্যোগে তৈরি হয় বাঙালির নিজস্ব ক্যালকাটা পটারি ওয়ার্কস ন্যা শনাল ট্যাং নারি লিমিটেড, বেঙ্গল এনামেল ওয়ার্কাস প্রভৃতি বিভিন্ন সংস্থা।
তাঁর সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থের প্রায় সমগ্রভাগ তিনি দান করেছিলেন বেঙ্গল কেমিক্যালসের উন্নতিকল্পে, দেশবাসীর হিতার্থে। ১৯২২ সালে রসায়নে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য নিজ অর্থ থেকে তিনি চালু করেন নাগার্জুন পুরস্কার । বিজ্ঞার জগতের গণ্ডী ছড়িয়ে তাঁর কর্মকাণ্ড বিস্তৃত ছিল সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিসরে। বহু স্কুল এবং কলেজকে তিনি আর্থিক অনুদান প্রদান করেন।
তাঁর বিস্তৃত, মহৎকার্যের স্বীকৃতিতে বাঙালি বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায় ব্রিটিশ সরকার নাইট উপাধি লাভ করেন। শিক্ষকতার জন্য তিনি সাধারণ্যে ‘আচার্য’ হিসেবে আখ্যায়িত। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে এই ডিগ্রি দেয়। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে তৃতীয়বারের মত তিনি ইংল্যান্ড যান এবং সেখান থেকেই সি আই ই লাভ করেন। এছাড়া ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরবর্তীকালে মহীশুর ও বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তিনি ডক্টরেট পান। ১৯৪৪ সালে ১৬ জুন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় মৃত্যুবরণ করেন।
জন্মবার্ষিকীর এই পূণ্যদিনে জ্ঞানতাপস, বিজ্ঞানসাধক, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে সশ্রদ্ধ প্রণতি জানাই।
মিতালী সরকার, অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত
আরও পড়ুন
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ছিলেন ভারতবর্ষের আকাশে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সান্নিধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ১৬১তম জন্মদিনে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ