স্বপ্ন গড়ার শিল্পী, রামকিঙ্কর বেইজ

৭৪ বছরের জীবনকালে তিনি সৃষ্টি করেছেন এক অনন্য শিল্প শৈলী, যাঁর শিল্পকলার মধ্যে দিয়ে ভারতীয় শিল্পের জগতে শুরু হয়েছিল নূতন একটি অধ্যায়। রামকিঙ্কর বেইজ, ভারতীয় শিল্পের আকাশে এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, শিল্পের ইতিহাসে তাকে ‘ভারতীয় শিল্পে আধুনিকতার জনক’ নামে অভিহিত করা হয় । রামকিঙ্কর ছিলেন প্রথম ভারতীয় শিল্পী যিনি আধুনিক পাশ্চাত্য শিল্পশৈলী অধ্যয়ন করে সেই রীতি নিজের ভাস্কর্যে প্রয়োগ করেন । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং রামকিঙ্করের শিল্পকীর্তির প্রশংশা করে গেছেন । এখনও শান্তিনিকেতনের কলাভবনে তার তৈরি ভাস্কর্য পর্যটকদের কাছে অন্যতম আর্কষণ এত গুণী একজন মানুষ হওয়া সত্বেও মদ্যপ্রীতি, নারীসঙ্গ ইত্যাদি কারণের জন্য সমাজে খুব একটা সুখ্যাতি তার ছিল না ! অবশ্য কে কি বলল সে বিষয়ে তিনি ছিলেন উদাসীন, তার ভাস্কর্য নিয়েই ব্যাস্ত থাকতে তিনি ভালোবাসতেন। বাড়ির চালের জন্য খড় কেনার পয়সাও তার ছিলোনা, তাই ঘরের ভাঙা চাল ঢাকতেন নিজের তৈরি ক্যানভাসে। এইরকম একটি খামখেয়ালী শিল্পীর জানা অজানা কিছু গল্প নিয়েই আজকের এই ফিচার।

রামকিঙ্কর বলতেন,”ছোটবেলা থেকেই বড় ইচ্ছে ছিল, যেখান দিয়ে যাব, রাস্তার ধারে ধারে মূর্তি রচনা করে চলব। সূর্যের আলো, চাঁদের আলো আর বর্ষাতুর আকাশের তলায় বড় মূর্তি দেখতে ভালো লাগে।”
সাল ১৯০৬, ২৫ মে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার যোগীপাড়ায় এক পরমানিক পরিবার চন্ডীচরণ প্রামানিকের ঘরে জন্মনিলেন ‘আধুনিক শিল্প ধারার পথিকৃত’ রামকিঙ্কর বেইজ । ছোট থেকেই তিনি ছিলেন ডানপিটে, খামখেয়ালী পাগলাটে গোছের, তিনি নিজেই তাঁর পদবি পরিবর্তন করে বেইজ রেখেছিলেন। বেইজ পদবিটি বৈদ্য পদবিটির পরিবর্তিত রূপ। ছোটবেলায় কুমোড়দের পাড়ায় ঘুরে ঘুরে তিনি মূর্তি বানানো দেখে নিজের খেলার ছলেই মূর্তি সৃষ্টির কাজে ব্রতী হন। ক্রমে ছবি অঙ্কনের দিকেও তার মন যায়, কৈশরের মাঝামাঝিতে তিনি অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবি আঁকতেন ।

শিল্প সৃষ্টির বাসনা বা দক্ষতা থাকলেই হয় না একটা ছবি আঁকতে চাই রঙ, তুলি কাগজ ইত্যাদি । একজন নাপিতের কতইবা সাধ্য যে, সে ছেলেকে রঙ তুলি কিনে এনে দেবে ! তাই কিশোর রামকিঙ্কর তার শিল্পতৃষ্ণা মেটানোর জন্য শিম গাছের পাতা, মেয়েদের পায়ের আলতা, কাচা হলুদ বাটা, মুড়ি ভাজার ভুষোকালি এমনকি পুঁইশাক থেকে বেগুনি রঙের নির্যাস বের করে সেইদিয়ে সাদা কাগজে চিত্র হিসেবে ফুটিয়ে তুলতেন মনে কল্পনাগুলোকে । ছাগলের লোম কেটে বাঁশের কাঠির ডগায় বেঁধে তুলি বানিয়ে চলত তাঁর চিত্রকলার কাজ ।
পড়াশোনায় মন তেমন কোনোদিনই ছিল না তাঁর, মেট্রিক পাশ করার পর আর বিশেষ পড়াশোনা তিনি করেন নি। চিত্রকলা এবং মূর্তি তৈরিই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। মূর্তি তৈরির নেশা এবং অভাবের সংসারে দুচার আনা কামানোর জন্য তিনি নিষিদ্ধ পল্লীতে গিয়েও মহিলাদের মূর্তি গড়ে দিতেন । দেশ তখন পরাধীন, চারিদিকে বিপ্লবের আগুন। সেই আগুনের তাপ রামকিঙ্কর কেও করে তুলেছিল উৎতপ্ত । তিনি বন্দুক হাতে তুলে নেননি ঠিকই কিন্তু সামান্য তুলির টানে বিভিন্ন ছবির মাধ্যমে তিনি তার ভেতরে থাকা বৈপ্লবিকতাকে বার বার জন সমক্ষে তুলে ধরেছেন। এহেন পরিস্থিতিতেই তিনি চোখে আসেন বাঁকুড়ার বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের নজরে। এই রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় কিশোর রামকিঙ্করকে নিয়ে হাজির হন শান্তিনিকেতনে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সামনে ।

১৯২৫ সালে ১৫ বছর বয়সী এই অসামান্য শিল্পীর পায়ের ধূলো পরে শান্তিনিকেতনের কলাভবনে, বিশ্বকবি এবং নন্দলাল বসুর আনুকুল্যে রামকিঙ্করের জীবনে শুরু হয় নূতন এক অধ্যায়ের। ১৯৩০ সালে তিনি কলাভবনের অধ্যায়ন শেষ করে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এই কলাভবনেই। কলাভবনের ইতিহাসে এই সময়টি ছিল সূবর্ণযুগ, একসঙ্গে নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখার্জী এবং রামকিঙ্করের মত শিল্পীরা তাদের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা শিল্পের বিপ্লব আনে। সেইদিন গুলোর অক্লান্ত পরিশ্রম জন্য আজ কলাভবনকে ভারতের শিল্প-সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ এক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হয়। পরবর্তী সময়ে রামকিঙ্কর কলাভবনের ভাষ্কর্য বিভাগের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৭১ এ তিনি অবসর গ্রহন করেন।
শান্তিনিকেতনে এখনও রামকিঙ্কর বেইজ-র সবচেয় বিখ্যাত দুই ভাষ্কর্য কীর্তি ‘সাঁওতাল পরিবার’ এবং ‘কলের বাঁশি’ এখনও কলাভবনের ঐতিহ্যের স্বাক্ষর রাখে। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনকে শিল্পকলায় ভরিয়ে তোলার ভার দিয়েছিলেন তার যোগ্য শিষ্য রামকিঙ্করকে, সেই নির্দেশের মর্যাদা তিনি রেখেছিলেন শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন জায়গায় ‘সুজাতা’, ‘গৌতম বুদ্ধ’, ‘সাওতাল পরিবার’ এবং ‘কলের বাঁশি’ সহ বিভিন্ন মূর্তি তিনি তৈরি করেছিলেন যা এখনও বর্তমান। এই বিষয়ে লেখক সাগরময় ঘোষাল তার লেখা একটি প্রচ্ছদে ব্যক্ত করেছেন রবীন্দ্রনাথের রামকিঙ্করকে বলা একটি উক্তি, “শোন, কাছে আয়। তুই তোর মূর্তি আর ভাস্কর্য দিয়ে আমাদের সবখানে ভরে দে। একটা শেষ করবি আর সামনে এগিয়ে যাবি— সামনে।’’

রামকিঙ্কর তাঁর শিল্পকলায় সবসময় তাঁর স্বপ্নকে এবং বাস্তব জীবনে দেখা মুহূর্তগুলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।গুরু নন্দলাল বসু সবসময় তাঁকে বলতেন, ‘‘রাতের স্বপ্নগুলোকে মনে রেখো কিঙ্কর। ভুলে যেও না। তেমন হলে, স্বপ্ন ভেঙে গেলে, উঠে স্বপ্নের কথা লিখে রাখবে। কোনো স্বপ্নই ভুলে যেও না। স্বপ্নে ছবি আসে কিঙ্কর, প্রতিমা আসে। স্বপ্ন আঁকবে!’’ তিনি গুরুর কথাই অনুসরণ করে ছিলেন। শান্তিনিকেতনে অয়েল পেন্টিয়ের কাজ তিনি প্রথম শুরু করেন।
রাতের স্বপ্নগুলোকে মনে রেখো কিঙ্কর। ভুলে যেও না। তেমন হলে, স্বপ্ন ভেঙে গেলে, উঠে স্বপ্নের কথা লিখে রাখবে। কোনো স্বপ্নই ভুলে যেও না। স্বপ্নে ছবি আসে কিঙ্কর, প্রতিমা আসে। স্বপ্ন আঁকবে!’’
রামকিঙ্কর কে নিয়ে বিতর্কেরও শেষ ছিল না। তাকে অনেকেই মদ্যপ এবং নারী সঙ্গের সন্ধানী বলে চিহ্নিত করত। একবার তিনি এক আদিবাসী রমনীর সাথে অনেকদিনের জন্য কোথাও হারিয়ে গিয়েছিলেন তারপর শান্তিনিকেতনে ফিরে এসে তিনি বলেছিলেন, ‘‘I lost myself, search myself.” অনেক নারী সঙ্গে জড়ালেও সেকথা কখনো তিনি অস্বীকার করেননি । ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন খুবই একা, বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ তিনি কখনই হননি। কিন্তু তাঁর জীবনের মুক্ত আকাশে হঠাৎ ই একদিন দানা মেলে উড়ে এল রাধারাণী নামক পাখিটি ।

রবীন্দ্রনাথের ছোট মেয়ে মীরাদেবীর হাত ধরে শান্তিনিকেতনে আসেন রাধারাণী। রাধারাণী সামান্য কাজের লোক হিসেবে এলেও মীরাদেবী তাকে পরিবারেই একজন সদস্য বলে মনে করতেন। ন’বছর বয়সেই রাধারাণীকে তার পিতা অপাত্রে দান করেছিল, কিছুদিনেই সে ফিরে এসেছিল এবং কাজ শুরু করে মীরাদেবীর কাছে। শান্তিনিকেতনে থাকা কালীন রাধারাণীর পরিচয় হয় রামকিঙ্করের সঙ্গে। ধীরে ধীরে রামকিঙ্করের নিঃসঙ্গ আর একাকী জীবনের একমাত্র সঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন এই রাধারাণী। তাঁদের সম্পর্ক নিয়েও শান্তিনিকেতনে কম জল ঘোলা হয়নি। তবে শিল্পী এইসব বিষয়ে ছিলেন উদাসীন। তাঁর জীবনের সঙ্গে জড়িত নারী প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, জীবনে অনেক মেয়ে এসেছে, এটা সত্যি। কেউ এসেছে দেহ নিয়ে, কেউ এসেছে মানসিক তীব্র আকর্ষণ নিয়ে। কিন্তু ছাড়িনি কাউকে। ধরেছি, আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছি। হজম করে ছিবড়ে করে ছেড়েছি। হজম করার মানে জানো? ও মন্ত্রটা আমার গুরুদেবের কাছে শেখা। তাঁর থেকে জন্ম নিয়েছে আমার অনেক ছবি, মূর্তি, অনেক কল্পনা, আর অনুভব।…আমার মডেলরা আমার বহু স্কেচে, ছবিতে, মূর্তিতে, বেঁচে আছে। মডেলরা তো এভাবেই বেঁচে থাকে।

তিনি মনে করতেন স্বশিক্ষাই হল সবচেয়ে বড় শিক্ষা। নিজে থেকেই, নিজের তাগিদে শিক্ষা গ্রহণই আসলে প্রকৃত শিক্ষা। তিনি নিজেই নিজের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর শিল্পকর্মের মধ্যে দিয়ে তিনি সেইসব শিক্ষারই প্রর্দশন ঘটিয়েছেন।১৯৭০ সালে তিনি পদ্মভূষণ এ ভূষিত হন, ১৯৭৭ এ রবীন্দ্রভারতী তাঁকে দেশিকোত্তম দেন এছাড়া ১৯৭৯ এ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.লিট সম্মাননায় ভূষিত করে । এতকিছুর পরেও এই শিল্পীর দরীদ্রতার মধ্যে ১৯৮০ তে তাঁর জীবনাবসান ঘটে ।
বাঙলা চলচ্চিত্রের অন্যতম পরিচালক ঋত্বিক ঘটক ওনাকে নিয়ে সিনেমা বানাতে চেয়েছিলেন, কাজও শুরু হয়েছিল কিন্তু সেই ছবি শেষ করার আগেই ঋত্বিক ঘটক অন্তর্ধান হয়ে যান। এই ছবিটি অসমাপ্তই থেকে যায় । তবে ‘জানা-অচেনা শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ‘ বই এবং আবীর মুখোপাধ্যায় ও ওয়াজিদুর রহেমানের লেখা প্রবন্ধে এই শিল্পী সমন্ধে আরও তথ্য পাওয়া যায় ।
“আমি যখন শান্তিনিকেতনে কিছু ভাস্কর্য গড়া নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম, তখন আমার মা মারা যান। মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়েও আমি দেখতে যেতে পারিনি। বড্ড খারাপ লেগেছিল। কিন্তু মায়ের মৃত্যু আমার শিল্পের ছায়াকে স্পর্শ করতে পারেনি। সবাই মারা গেছে, আমার দাদা-বোন-বাবা-মা— সবাই, সবাই।… মৃত্যু সম্পর্কে আমি সব সময়ই উদাসীন। একজন শিল্পী যতক্ষণ সৃষ্টির নেশায় মাতাল হয়ে থাকেন, ততক্ষণ পর্যন্ত মৃত্যু কোনোভাবেই তাকে স্পর্শ করতে পারে না।”
ঋণস্বীকার – উইকিপিডিয়া, বিভিন্ন পত্রপত্রিকা।
দীপক সাহা : লেখক ও শিক্ষক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত