বাংলা সাহিত্যের শুদ্ধাচারী জ্ঞানতাপস বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, তিনি একাধারে একজন কবি, উপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক। তার সৃষ্টি মানুষ্য জীবনের জটিলতা, মাধুর্য, রহস্যময়ী এবং সর্বোপরি বহমানতা ও বৈচিত্র্যময়তার এক সার্থক চিত্রায়ন। বাংলা সাহিত্যে সাবলীল তার বিচরণ, বলিষ্ঠ লেখনী, কালাত্তীর্ণ তার সাহিত্যকর্ম।
তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ ‘অবিচার’ গল্প যা ১৩২২ খ্রিস্টাব্দে আষাঢ় মাসের প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তার ৭০-৭২ বছর ব্যাপী বিস্তৃত সাহিত্যজীবন পৃথিবীতে এক অনন্য নজির স্থাপন করে। জীবনের শেষ পর্যন্ত এসেও তার লেখনী সমানভাবে পাঠক কুলকে সমৃদ্ধ ও মুগ্ধ করে।
পত্রিকায় শারদীয় সংখ্যায় প্রকাশিত ছোট গল্পগুলি কৈলাসের পাঠবাণী (১৩৮০), জামাইষষ্ঠী (১৩৮৩), স্বরূপ মন্ডলের সব কথা (১৩৮৪), এই জগৎ ওদের চোখে (১৩৯০) বাংলা সাহিত্যের মূল্যবান সম্পদ। ১৩৯৫ সালে ৯৪ বছর বয়সে শেষ লেখেন ‘জীবনতীর্থ’ উপন্যাসটি এবং ১৩৯৩ সালে ৯২ বছর বয়সে ‘সেই তীর্থে বরদ বঙ্গে’ উপন্যাসটি যা পৃথিবীর সাহিত্য ইতিহাসে বিরল নিদর্শন। তার জীবনকালেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সাহিত্যকর্ম গবেষণার বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে এবং বিভিন্ন সময়ে তিনটি সাহিত্য পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ‘কথাসাহিত্য; প্রকাশক সুমথনাথ ঘোষ ও গৌরশঙ্কর ভট্টাচার্য (কলকাতা,১৩৮৩) বঙ্গাব্দ, ‘শ্বাশতবাণী’ প্রকাশক প্রলয় মজুমদার (মজঃফরপুর,১৩৮৮), ‘সৌরভ’ সম্পাদক আশীষ সেন (সমস্তিপুর,১৩৯২)। স্বনামধন্য লেখক ও সাহিত্যের দিকপালগণ যেমন লীলা মজুমদার, প্রবোধ স্যানাল, সুনির্মল বসু, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমথনাথ বিশী, গজেন্দ্রকুমার মিত্র, সজনীকান্ত সেন, আশাপূর্ণা দেবী প্রমুখ তাদের কলম তুলে ধরেন বিভূতিভূষণের বিবরণ, বিশ্লেষণ, ব্যঞ্জনা, বৈশিষ্ট্যের বিবৃতিতে।
বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্য রচনা করেন ব.ভ.ম এবং কশ্চিৎ প্রৌঢ় এই দুই ছদ্মনামে। বিপুল তার রচনা সম্ভার। প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ১১২, আছে অপ্রকাশিত রচনা। বিভিন্ন সাহিত্যে বিভূতিভূষণের ছোট গল্প অধিকতর সমাদৃত ও জনপ্রিয়।
সমালোচকগণের মতে, তাঁর ছোট গল্প বৈচিত্র্যময় এবং অধিকতর বাস্তব গুণসম্পন্ন। মূল বৈশিষ্ট্য সরসতা, সংসম, শুচিতা হলেও জীবনের রূঢ় কর্কশতার সত্য এবং মাধুর্য পাঠক সমাজের কাছে ধরা দেয়। তাঁর লিখিত রানুর প্রথম ভাগ, রানুর দ্বিতীয় ভাগ, রানুর তৃতীয় ভাগ, রানুর কথামালা ছোটগল্পের চতুষ্ঠয় সংকলন বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। তার সৃষ্টি রানু, ছবি এবং তীতু সার্থক শিশু চিত্রায়ন। ছোটদের জন্য লেখা বই ‘পোনুর চিঠি’ ‘কিলাশীর পাঠরানী’, ‘হেসে যাও’। তার গল্প বরযাত্রী এবং টনসিল নাট্যরূপেও সমান সফল। তার নাট্য এবং উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রায়ন হয় বরযাত্রী, শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, লীলাঙ্গুরীয়, কাঞ্চন মূল্য, ফুলেশ্বরী প্রভৃতি যা জনপ্রিয়তায় শীর্ষস্থান লাগ করে। তাঁর লিখিত প্রথম ভ্রমণ কাহিনি কুশি প্রাঙ্গণের চিঠি, দুয়ার হতে অদূরে, অজ্ঞতার জয়যাত্রা। তার উপন্যাস লীলাঙ্গুরীয় হিন্দি ভাষায় ‘নিলাম কী আঙ্গুঠি’ এবং কুশি প্রাঙ্গণের চিঠি মৈথিলী ভাষায় ‘কুশি প্রাঙ্গণ কা চিঠি’ নামে প্রকাশিত হয়। তার প্রথম উপন্যাস লীলাঙ্গুরীয় ১৩৪৯ সালে প্রকাশিত হলেও, রিক্সার গান উপন্যাসটিতে তার প্রতীকী উপন্যাস রচনার সূচনা হয়, যা প্রকাশিত হয় ১৩৬৬ বঙ্গাব্দে। তার সাহিত্যকর্মের উৎকর্ষতার স্বীকৃতিতে তিনি বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য সুরেশচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার, শরৎ স্মৃতি পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কার, ডিএল রায় রীডারশিপ বক্তা পুরস্কার, জগৎতারিণী পদক, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি.লিট উপাধি, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশিকোত্তম’ উপাধি প্রভৃতি।
বিভূতিভূষণ তাঁর রচনায় কৌতুক রসের এক অসামান্য নিদর্শন রেখেছেন। বরযাত্রী গল্পের ছয় বন্ধু গনশা, খোঁতনা, ত্রিলোচন, গোরাচাঁদ, রজেন আর কে গুপ্ত তার লেখনীতে প্রাণবন্ত এবং চিরস্থায়ী স্থান দখল করেছে। ছোটদের জন্য তার লেখা প্রবীণদের কাছেও আগ্রহের।
সাহিত্যকর্মের ন্যায় তার কর্মজীবনও ছিলো বৈচিত্র্যময়। প্রথম দিকে তিনি ইন্ডিয়ান নেশন পত্রিকায় কার্যাধ্যক্ষের দায়িত্ব এবং পরে বিহারের দ্বারভাঙ্গায় মহারাজের সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর কিছুদিন তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।
১৮৯৪ সালের ২৪ অক্টোবর বিহারের দ্বারপভাঙ্গা জেলায় পান্ডুল গ্রামে বিভূতিভূষণ জন্মগ্রহণ করেন। পিতা বিপিন বিহারী মুখোপাধ্যায় দ্বারভাঙ্গা রাজ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং রিপন কলেজ থেকে তিনি আই.এ এবং পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ পাশ করেন।
ব্যাপ্ত কর্মকাণ্ড দ্বারা জীবনের জয়গাঁথা রচয়িতা অনন্য প্রতিভাধর সাহিত্যশিল্পী বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় ২৯ শে জুলাই, ১৯৮৭ সালে বিহারের দ্বারভাঙ্গায় পরলোকে পাড়ি দেন।
মহাপ্রয়াণ দিবসে স্রষ্টা বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়কে বিনম্র প্রণাম জানাই।
মিতালী সরকার, অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত