হিমেল বরকত থেকে যাওয়া আলো

হিমেল বরকত স্যারকে বাংলা বিভাগের বাইরে একবার পেয়েছিলাম ‘ধ্বনি’তে আবৃত্তির ক্লাস করার সময়। ছন্দ বুঝিয়েছেন চমৎকার কৌশলে। তারপর আরেক দিন পেয়েছিলাম কবীর স্মরণীতে। আমি বটতলার দিকে যাচ্ছিলাম হেঁটে স্যার আমাকে দেখতে পেয়ে ডেকে রিকশায় উঠালেন। তাঁর সঙ্গে বটতলা পর্যন্ত গেলাম। কথা বললাম কীভাবে লিখেছি ‘দশমাতৃক দৃশ্যাবলী’র রিভিউ।
একদিন একজন সম্পাদক ফোন করে বলেন, স্যারের এ বইটি নিয়ে রিভিউ লিখতে। রাজি হলাম। তখন আমার কাছে বইটি নাই। স্যারকে ফোন করলাম। তিনি বিভাগে এসে নিতে বললেন। নিলাম। কিন্তু রুমে পড়তে ইচ্ছে করে না। কারণ তখন বাসে পড়ার একটা অভ্যাস তৈরি হয়ে গেছে। টানা মাসখানেক ক্যাম্পাস থেকে ঢাকায় আসতে-যেতে এই অভ্যাস পোক্ত হয়। বইটা নিয়েও লেখা দরকার। চিন্তায় পড়ে যাই।
চিন্তা থেকে মুক্তি নিতে একদিন বাসে উঠে ঢাকার দিকে যেতে থাকি। উদ্দেশ্য বই পড়া। আসতে যেতে ৪-৫ ঘণ্টা সময় পাই এবং হয়ে যায় পড়া। এ গল্প স্যারকে শোনালাম।
তারপর আরেকদিন তাঁকে পাই বইমেলায়। স্যার আমাকে চা খাওয়ালেন। তিনিও খেলেন চা এবং ধরালেন সিগারেট। সিগারেট টানতে টানতে বলতে থাকেন- মানুষের বই না পড়া নিয়ে। আরও অনেক কথা হলো। স্যারের সিগারেট ফুরালে তিনি মেলায় প্রবেশ করেন, আমি দোয়েল চত্বরের দিকে অগ্রসর হই।
একবার বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধ পাঠ্য হলো। প্রবন্ধ আর ভাষাবিজ্ঞান আমার কাছে বরাবরই দুর্বোধ্য আর যন্ত্রণার মনে হয়। বসুকে তো পড়তেই হবে। তখন স্যারের ‘সাহিত্য-সমালোচক বুদ্ধদেব বসু’ এই বইটার কথা মনে পড়ল। যার পোস্টার দেখেছিলাম বিভাগে। তারপর বইটি সংগ্রহ করে পড়ি আর চিন্তামুক্ত হই। কারণ বসুর প্রবন্ধের বিষয় ও প্রকরণ নিয়ে চমৎকার বিশ্লেষণ রয়েছে বইটিতে। স্যারের গদ্য সহজ আর ঝরঝরে। ফলে বইটা দারুণভাবে ভালো লেগেছিল।
তিনি কবিতা লিখেছেন ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে। তিনি জীবনকে দেখেছেন নানা দৃষ্টিকোণ ও পর্যবেক্ষণে। কবিতা পাঠে মনে হয়েছে কল্পনা নয় বাস্তবজীবনকেই দেখিয়েছেন বিচিত্রভঙ্গিতে।
বর্তমান সময়, সমাজ, বিশ্বায়ন, বিচ্ছিন্নতা, অবিশ্বাস, পরকীয়া, নৈতিক অবক্ষয়, মানুষের যান্ত্রিক আচরণ, নিঃসঙ্গতা সবই হয়েছে কবিতায় উপজীব্য।

আমরা অন্যের চোখে দেখতে চাই বিশ্ব, হয়ে উঠেছি চর্বিত চর্বণে পারদর্শী। কবি মানুষের বিচার-বিশ্লেষণ ক্ষমতা জাগরিত করার পক্ষে। এজন্য উচ্চারণ করেন:
‘সব কেন শুনতে চাও মুখে?
নিজে কিছু পড়ো। নিঃশ্বাসের
তাপ, ঘামের গরিমা-
ছুঁয়ে
দ্যাখো
ভেজা চোখ দেখে শেখো’।
হিমেল স্যার যখন ক্লাস নিতেন তখন তাঁর চমৎকার ভয়েসে ক্লাসরুম ভরে যেত। তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ আর জোরালো ভয়েস কান খাড়া রাখতে সহযোগিতা করত। তিনি পড়াতেন বেশ গুছিয়ে। মেঘনাদ বধের মতো জটিল টেক্সট বোঝার সাধ্যে আসত।
ক্লাস করার বাইরেও স্যারের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। সম্পর্কের ভিত্তি লেখালেখি। স্যারকে নতুন লেখা দেখাতাম। তিনি পাঠ শেষে দারুণ উৎসাহের সাথে প্রশংসাও করতেন। যদিও আমি সব প্রশংসা গ্রহণ করতাম না। কোনটা দুর্বল লেখা সেটা আমি বুঝতে পারতাম।
স্যার আমাকে ল্যাপটপে একটা বানান লেখা শিখেয়েছেন। ল্যাপটপে কীভাবে লিখতে হয় ওই বানান সেটা বুঝতেছিলাম না। তারপর দেখলাম ল্যাপটপের ইংরেজি কী-বোর্ডে কীভাবে লিখে চলছেন বাংলা ফ্রন্ট। সুতনি এমজি। দেখতে দেখতে দারুণ উৎসাহ পাই। হলে ফিরে আমিও প্রাকট্রিস শুরু করি। তারপর আমিও শিখে ফেলি।
হিমেল স্যার, আমাদের ছেড়ে হয়েছেন আরেক জগতের বাসিন্দা। আমরা তাঁকে দেখছি না। তিনি হয়তো দেখছেন আমাদের। আমরা ছুঁয়েছেনে দেখছি তাঁর আর আমাদের দীর্ঘ চলাচল। ভিন্ন জগতের বাসিন্দা হলেও মনে হচ্ছে তিনি আমাদের সঙ্গেই আছেন। ছড়াচ্ছেন আলো। কেননা হিমেল বরকত থেকে যাওয়া আলো।
হিমেল বরকত স্যারের জন্য রচিত পঙক্তিমালা
আজ একজন কবির কথা বলব
যার কোকড়ানো চুল ছিল, চোখে ছিল চশমা
গালে ছিল ছোটো ছোটো ঘন দাঁড়ি
হাঁটতেন গভীর পদক্ষেপে
পরতেন টি-শার্ট, হাফশার্ট, ফতুঞ্জি কিংবা পাঞ্জাবি
পায়ে থাকত কালো বেল্টের চামড়ার জুতা, নট স্যুটেট বুটেট
তিনি ছিলেন সাধারণ জীবনযাপনে এক অসাধারণ ফুল
যে নিরহংকারী আর সহজ মানুষের কথা বলছি
তিনি আমাদের পড়াতেন মেঘনাদ বধ, বীরাঙ্গনা কাব্য কিংবা ছন্দ-অলংকার
পড়াতেন বিশ্লেষণ আর যুক্তিতে পরিষ্কার করে
যার স্বর ছিল স্পষ্ট
যার স্বর পৌঁছত শেষ বেঞ্চ পর্যন্ত
যার ব্রত ছিল সহযোগিতা আর পাংচুয়ালিটিতে জড়ানো
যিনি ছিলেন মরুভূমিতে কয়েক ফোটা পানি
তিনি ছিলেন ছাত্র আর ছাত্রীর আশা এবং ভরসা
তিনি বপন করেছিলেন নবীন কবি কিংবা লেখকের মাঝে উৎসাহের বীজ
যা পরিস্ফুট তাদের বয়স আর অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সাথে সাথে
আমি একজন শিক্ষকের কথা বলছি
আমাদের প্রিয় মানুষের কথা বলছি
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোয় সৃজনশীল-মননশীল কিংবা ভালো পড়াতে পারা
শিক্ষকের সংখ্যা যখন শূন্যে নেমে যাচ্ছিল
সেখানে হিমেল বরকত ছিলেন শূন্যে পূর্ণতা
সেখানে তিনি ছিলেন অন্ধকারে আলোর প্রদীপ
হ্যাঁ, আমি হিমেল বরকতের কথাই বলছি
তিনি একজন কবি
তিনি একজন পথপ্রদর্শক
তিনি একজন মানবিক কিংবা সংবেদনশীল মানুষ
তিনি না-জানা কিংবা স্বল্প জানা তরুণের বিস্তারিত জ্ঞান
তিনি নবীনের আশীর্বাদ
তিনি ছিলেন আলোকবর্তিকা
তিনি ছিলেন পথপ্রদর্শক
তিনি ছিলেন আমার শিক্ষক
প্রিয় বিভাগের বারান্দায় কতবার একসাথে হেঁটেছি
বলেছি কথা রুমে কিংবা বারান্দায়
পেয়েছি তার উদারতা কিংবা পাণ্ডিত্য
গ্রহণ করেছি তার পরামর্শ
নতুন লেখা কাটাকাটিতে হয়েছে পরিণত
আমি আমার শিক্ষকের কথা বলছি
বলছি একজন কবির কথা
যিনি থাকবেন দশমাতৃক দৃশ্যাবলীতে
যিনি থাকবেন ভালোবাসায়
যিনি থাকবেন ছন্দে
যিনি থাকবেন পাঠের স্মৃতি কিংবা অভিজ্ঞতায়
যিনি থাকবেন পড়ানো জ্ঞান কিংবা শিক্ষার বিস্তৃতিতে প্রজন্মের পর প্রজন্মে
এক প্রজন্ম ছিল তার ছাত্র কিংবা ছাত্রী
এই প্রজন্ম বিস্তারিত হবে পরের প্রজন্মে
আমি একজন শিক্ষকের কথা বললাম
আমি একজন কবির কথা বললাম
বললাম একজন মানবিক মানুষের কথা
যার কাছে ছিল আলোর খনি
যে আলোয় আলোকিত বিভাগ, সহকর্মী, কর্মচারী এবং ছাত্র-ছাত্রী
আলো নিভে না
থেকে যায় মোমবাতিতে, না-হয় মনে
হিমেল বরকত থেকে যাওয়া আলো।
হারুন পাশা : গল্পকার ও ঔপন্যাসিক