লোকসংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী আবদুল আলীম আজীবন বেঁচে থাকবেন বাঙালির হৃদয়ে

‘পরের জায়গা পরের জমি
ঘর বানাইয়া আমি রই
আমি তো এই ঘরের মালিক নই।।’
এই গানটি গেয়েছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত লোকসংগীতশিল্পী আবদুল আলীম। যাঁর গান শুনে মুগ্ধ হন নিই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। এই মরমী শিল্পীর আজ ৯০তম জন্মবার্ষিকী। তিনি আজকের দিনে ১৯৩১ সালের পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদের তালিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম মোহাম্মদ ইউসুফ আলী।
গানের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসায় পড়াশোনা বেশি চালিয়ে যেতে পারেননি। ছোটবেলা গানের এতবেশি ঝোঁক সৃষ্টি হয় গ্রামোফোনের দেখে। এই কলের গানে কিভাবে তিনি গাইবে এমন স্বপ্নে বিভোর থাকতেন তিনি। সম্পর্কে হবেন চাচা। তাঁর কাছে রোজ শুনতে যেতেন গ্রামোফোন রেকর্ডে গান। শুনতে শুনতে তীব্র আগ্রহে শুরু করেন সংগীতচর্চা। নিজ গ্রামের সঙ্গীত শিক্ষক সৈয়দ গোলাম ওলির কাছে তালিম নিতে শুরু করেন। ওস্তাদ তাঁর আগ্রহ দেখে ভীষণ মুগ্ধ হলেন। নিজে তালিম দেওয়া ছাড়া তিনি ভাবলেন তাঁকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া।সেখানে গেলেন। কিছুদিন থাকার পর আবার ফিরে আসেন তাঁর আপন গ্রামে।
অজপাড়া তালিবপুর গ্রামের ছোট আবদুল আলীমের গান শুনে মুগ্ধ হয়নি এমন মানুষ ছিল না। তাই তো গ্রামের বিভিন্ন উৎসবে, পালা পার্বণে ডাক পড়ল তাঁর। সবাই তাক লাগিয়ে শুনত তাঁর গান। ওস্তাদ সৈয়দ গোলাম ওলির কাছে যতটুকু সংগীত শেখার দরকার ছিল, তা তিনি শিখে ফেলেন, উচ্চতর সংগীতচর্চার জন্য ঔ অজপাড়া গ্রামে আর সুযোগ ছিল না। তাই বড় ভাই শেখ হাবিব আলী এক প্রকার জোর করে ধরে নিয়ে গেলেন কলকাতায়। ১৯৪২ সাল। তখন স্বাধীনতা আন্দোলন তুমুলভাবে চলছে চারদিকে। তৎকালীন বাংলার মূখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক আসবেন কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসায়। এই খবর বড় ভাই শেখ হাবিব আলী শুনতে পেয়ে ছুঁটে যান মাদ্রাসায়। জানতে পারেন, মূখ্যমন্ত্রীর আগমের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ভাই হাবিব অনুষ্ঠান আয়োজকদের সঙ্গে দেখা করে আবদুল আলীমের নামটা দিলে একটা গান গাইবার জন্য। দুই ভাই মঞ্চে অপেক্ষা করছেন কখনো নামটা ঘোষণা করা হবে। এক ফাঁকে মঞ্চ থেকে ঘোষণা এল। মঞ্চে ওঠে ছোট শিল্পী আবদুল আলীম কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামী গান গাইতে শুরু করলেন। (তখন কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় ঘটেনি)
‘‘সদা মন চাহে মদিনা যাবো,
আমার রসূলে আরবী, না হেরে নয়নে,
কি সুখে গৃহে র’বো।।
মদিনার বুকে রয়েছে ঘুমায়ে আমার বুকের নিধি
তায় বুকে তার মিলাইব বুক পায়ে লুটাইব নিরবধি
ধূলিকণা হবো, আমি ধূলিকণা হবো
(ওগো) নবী পদরেখা যেই পথে আঁকা
সেই পথে বিছাইবো।’
গান শুনতে শুনতে কেঁদে ফেলেন শেরে–বাংলা।গান শেষে মঞ্চ থেকে নামার পরপরেই বুকে জড়িয়ে ধরে উৎসাহ, সাহস ও দোয়া করলেন। বড় ভাই হাবিবও খুশি। এই খুশিতে ভাইকে কিনে দিলেন পাজামা, পাঞ্জাবী, জুতা, পুটিসহ নানা। পরিরচয় হয় তৎকালীন গীতিকার মো. সুলতানের সঙ্গে। তিনি একদিন নিয়ে যান গ্রামোফোন কোম্পানীতে। সেখানে নিয়মিত কাজ করেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তারপর দুজনেই পরিচয় হয়।
গান শুনতে শুনতে কেঁদে ফেলেন শেরে–বাংলা।গান শেষে মঞ্চ থেকে নামার পরপরেই বুকে জড়িয়ে ধরে উৎসাহ, সাহস ও দোয়া করলেন। বড় ভাই হাবিবও খুশি। এই খুশিতে ভাইকে কিনে দিলেন পাজামা, পাঞ্জাবী, জুতা, পুটিসহ নানা। পরিরচয় হয় তৎকালীন গীতিকার মো. সুলতানের সঙ্গে। তিনি একদিন নিয়ে যান গ্রামোফোন কোম্পানীতে। সেখানে নিয়মিত কাজ করেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তারপর দুজনেই পরিচয় হয়।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর গান শুনলেন। গান শুনে মুগ্ধ হয়ে গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানীর ট্রেনার ধীরেন দাসকে গান রেকর্ড করার নির্দেশ দিলেন। ১৯৪৩ সালে মো. সুলতান রচিত দু’টি ইসলামী গান আবদুল আলীম রেকর্ড করলেন। গান দু’টি হলো- ‘আফতাব ঐ বসলো পাটে আঁধার এলো ছেয়ে ও চল ফিরে চল মা হালিমা আছেরে পথ চেয়ে।’
‘তোর মোস্তফাকে দেনা মাগো, সঙ্গে লয়ে যাই, মোদের সাথে মেষ চারণে ময়দানে ভয় নাই।’
তখন মাত্র ১৩ বছর বয়স। এত অল্প বয়সে গ্রামোফোন রেকর্ডে কম মানুষের সুযোগ হয়েছিল।তারপর দেখা হয় আব্বাসউদ্দিন সঙ্গে। শিল্পী আব্বাসউদ্দিন ও কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অনেক গান করেন। ধীরে ধীরে তিনি লোক ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উপর দীক্ষা নেন বেদারউদ্দিন আহমদ, ওস্তাদ মোহাম্মদ খসরু, মমতাজ আলী খান, আব্দুল লতিফ, কানাইলাল শীল, আব্দুল হালিম চৌধুরী প্রমুখের কাছে। লেটো দলে, যাত্রা দলে কাজ করেছেন।
১৯৪৭ সাল। দেশভাগ হওয়ার একমাস আগে কলকাতা থেকে ফিরে যান নিজ গ্রাম মুর্শিদাবাদের তালিবপুরে। ঐ বছরেই ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় চলে আসেন। ১৭ বছরের আবদুল আলীম পরের বছর অর্থ্যাৎ ১৯৪৮ সালে তৎকালীন ঢাকা বেতার কেন্দ্রে অডিশন দেন। অডিশনে পাস করার পর আগষ্ট মাসের ৯ তারিখে তিনি বেতারে প্রথম গাইলেন প্রখ্যাত গীতিকার ও সুরকার মমতাজ আলী খানের ‘ও মুর্শিদ পথ দেখাইয়া দাও।’
পরিচয় হয় পল্পী কবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে। তিনি তাঁকে পাঠালেন জিন্দাবাহার দ্বিতীয় লেনের ৪১ নম্বর বাড়িতে। সেখানে দেশের বরেণ্য সঙ্গীত গুণী শিল্পীরা থাকতেন। সেখানে সংগীতজ্ঞ মমতাজ আলী খানের কাছে শিল্পী আবদুল আলীমকে তালিম নিতে শুরু করেন। কবি জসীমউদ্দীন ও মমতাজ আলী খানের সংস্পর্শে আবদুল আলীম পল্লী গানের জগতে প্রবেশ করেন পরবর্তীতে কানাই শীলের কাছে সঙ্গীত শিক্ষা লাভ করেন। লোকসঙ্গীতের শিল্পী আব্বাসউদ্দিনের পরামর্শক্রমে তিনি ওস্তাদ মো. হোসেন খসরুর কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম গ্রহণ করেন।
গ্রামোফোন কোম্পানী তাঁর গাওয়া গান ‘প্রেমের মরা জলে ডুবে না’ ও ‘অসময় বাঁশী বাজায়’ ‘হলুদিয়া পাখী’, ‘দুয়রে আইসাছে পাখি’, ‘নাইয়ারে নায়ে বাদাম তুইলা’, ‘এই যে দুনিয়া কিসেরও লাগিয়া’, ‘পরের জাগা পরের জমিন’ প্রভৃতি গান অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করে। তিনি দেশের প্রথিতযশা গীতিকার ও সুরকারদের গান গেয়েছেন, তাদের মধ্যে লালনশাহ, হাসন রাজা, জসীমউদ্দীন, আবদুল লতিফ, মমতাজ আলী খান, শমশের আলী, সিরাজুল ইসলাম, কানাইশীল, মন মোহন দত্ত প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। প্রায় ৫০০ গান রেকর্ড হয়েছে। বাংলাদেশ গ্রামোফোন কোম্পানী (ঢাকা রেকর্ড) শিল্পীর একখানা লংপ্লে রেকর্ড বের করেছে।
১৯৫১-৫৩ সালে আবদুল আলীম কলকাতায় বঙ্গীয় সাংস্কৃতিক সম্মেলনে গান গেয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। পল্লী গানের জগতে সুখ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ১৯৬২ সালে বার্মায় অনুষ্ঠিত ত্রিদেশী সঙ্গীত সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করেন। এই সম্মেলন ঘটে গেল এক ঘটনা। প্রচণ্ড খরা। রোদ্রে মানুষজন অতিষ্ঠ। বৃষ্টি নেই। তবে আকাশ মেঘ মেঘ। মঞ্চে অন্যান্য শিল্পীরা গান গাইছেন। তিনিও সেই মঞ্চে। এবার তিনি গান ধরলেন—
‘‘আল্লাহ, মেঘ দে
আল্লাহ, মেঘ দে
আল্লাহ, মেঘ দে, পানি দে
ছায়া দে রে তুই
আল্লাহ, মেঘ দে’
( গীতিকার : জালালউদ্দিন; সুর : গিরীন চক্রবর্তী; শিল্পী আব্বাস উদ্দিন)
কী আশ্চার্য! গান শেষ হওয়া মাত্র শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন একজন বার্মার মন্ত্রী। তিনি বলেন, “আবদুল আলীম আমাদের জন্য বৃষ্টি সঙ্গে করে এনেছেন।”তারপর থেকে বার্মার মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে শিল্পী আবদুল আলীম।
কী আশ্চার্য! গান শেষ হওয়া মাত্র শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন একজন বার্মার মন্ত্রী। তিনি বলেন, “আবদুল আলীম আমাদের জন্য বৃষ্টি সঙ্গে করে এনেছেন।”তারপর থেকে বার্মার মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে শিল্পী আবদুল আলীম
শিল্পী আবদুল আলীম বহু দেশে লোক সংগীত পরিবেশন করেন। ১৯৬৩ সালে রাশিয়া, ১৯৬৬ সালে চীন সফর করেন। দেশ–বিদেশে পল্পী গানকে ছড়িয়ে দেওয়া তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন। এছাড়া তিনি বেতার, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অসংখ্য গান করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’এ কণ্ঠ দেন। আজান, রূপবান, জোয়ার এলা, শীত বিকেল, এদেশ তোমার আমার, কাগজের নৌকা, নবাব সিরাজউদ্দৌলা (বাংলা ও উর্দু), সাত ভাই চম্পা, দস্যুরাণী, সুজন সখিসহ ৫০টি চলচ্চিত্রের নেপথ্যে কণ্ঠশিল্পী ছিলেন।
তিনি জীবদ্দশায় ও মরণোত্তর বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেন। উল্লেখযাগ্য একুশে পদক (মরণোত্তর), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, পূর্বাণী চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার ও স্বাধীনতা পুরস্কার । তিনি সঙ্গীত কলেজের লোকসঙ্গীত বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ছিলেন। পাকিস্তান মিউজিক কনফারেন্স, লাহোরে সঙ্গীত পরিবেশন করে আব্দুল আলীম পাঁচটি স্বর্ণ পদক পেয়েছিলেন।
বেঁচে ছিলেন মাত্র ৪৩ বছর। ১৯৭৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা পিজি হাসপাতাল ( বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বাংলাদেশের লোকসংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী হিসেবে আমাদের মাঝে আজীবন বেঁচে থাকবেন।
৯০তম জন্মদিনে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি..
তথ্যসুত্র : সৈকত আসগর: আবদুল আলীম ১৯৩১-১৯৭৪, বাংলা একাডেমি ঢাকা, প্রথম প্রকাশ জুন ১৯৯৭; আব্বাসউদ্দিন আহমদ: আমার শিল্পী জীবনের কথা, হাসি প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ৩৪ নর্থব্রুক হল রোড, ঢাকা-১১০০, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি ২০০২, উইকিপিডিয়া, গুণীজন ডটকম