পাঠ্যপুস্তকে কবি রজনীকান্তের লেখা ভাবসম্প্রসারণে পড়ানো হলেও নাম না থাকায় অনেকের কাছে অজানা

পঞ্চকবির এক কবি, সুরকার, প্রখ্যাত গীতিকার রজনীকান্ত সেনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে ছোটবেলায় পাঠ্যপুস্তকে এভাবে—
‘বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই
কুড়ে ঘরে থাকি কর শিল্পের বড়াই।’ (স্বাধীনতার সুখ)
কবিতা ও সংগীতে দক্ষ ছিলেন কবি রজনীকান্ত। তাই তো কবিকে ‘কান্তকবি’ বলা হত। তিনি ১৮৬৫ সালের ২৬ জুলাই সিরাজগঞ্জের (তৎকালীন পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমা) বেলকুচির সেন ভাঙাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। আজ এই ক্ষণজন্মা বহুমুখী প্রতিভাবান কবির ১৫৬ তম জন্মবার্ষিকী। তাঁর লেখার মূল উপজীব্য ছিল স্রষ্টা ভক্তি, সদুপদেশ ও স্বদেশ প্রেম।

পড়াশোনাও করেছিলেন সুনামের সঙ্গে। ১৮৮৩ সালে কুচবিহারের জেনকিন্স স্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে প্রবেশিকা পাস করায় মাসিক ১০ টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এসময় রাজশাহী বিভাগীয় স্কুলগুলোর প্রতিযোগিতায় ইংরেজি প্রবন্ধ লিখে লাভ করেন মাসিক ৫ টাকা হারে প্রমথনাথ বৃত্তি।
বি এ ও বি এল ডিগ্রী নিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন আইন পেশায়। গ্রামের নিরক্ষর মহিলাদের শিক্ষার প্রসারে জন্য তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। মা মনোমোহিনী দেবীও ছিল একজন সাহিত্যিক। তিনি বাংলা সাহিত্য চর্চার করার জন্য অনেক প্রভাব বিস্তার করেন। বাবা ও মা দুইজনেই সংস্কৃতিমনার কারণে কবি ছোটবেলা থেকে কবিতা লিখতে শুরু করেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই বাংলা ও সংস্কৃত ভাষা রপ্ত করে ফেলেন। দুই ভাষায় লিখতে শুরু করেন কবিতা। মাত্র ১৫ বছর বয়সে রচনা করেন কালীসঙ্গীত। অভিষেক অনুষ্ঠান, সমাপনী প্রভৃতিতে গান লিখে গাইতেন তিনি। এক বিকেলে রাজশাহী গ্রন্থাগারে তাঁর ডাক পরে গান লেখার জন্য। হাতে মাত্র এক ঘন্টা সময়। সবাইকে অবাক করে দিয়ে দ্রুত এই কালজয়ী এক গানটি লিখে ফেলেন—
‘তব, চরণ নিম্নে, উৎসবময়ী শ্যাম-ধরণী সরসা,
ঊর্দ্ধে চাহ অগণিত-মণি-রঞ্জিত নভো-নীলাঞ্চলা
সৌম্য-মধুর-দিব্যাঙ্গনা শান্ত-কুশল-দরশা।”

গান ও কবিতা রচনা করতে থাকেন তিনি। স্বদেশী আন্দোলন চলছে। চারদিকে আন্দোলনরত। কবিও রচনা করে ফেললেন এক বিখ্যাত গান—
‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই;
দীন দুখিনি মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই৷’

এই গানটি রচনার মাধ্যেম চারদিকে গোরগোল পড়ে গেল। কবি হয়ে ওঠলেন ‘কান্তকবি’ নামে। এই গান গেয়ে স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ উৎসাহ, উদ্দীপনা নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন৷
কবির বৈচিত্র বিষয় নিয়ে কবিতা লিখেছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে ‘অমৃত’ কাব্যগ্রন্থটি স্বার্থক নীতি কবিতার অন্তর্ভুক্ত। জীবিতাবস্থায় মাত্র তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে— বাণী, কল্যাণী ও অমৃত। মাত্র ৪৫ বছরে জীবন অবসান ঘটে। এই অল্প সময়ে মধ্যে তিনি বাংলা সাহিত্যকে উজ্জ্বলত্র করে গেছেন। মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় আরও ৫টি কাব্যগ্রন্থ। তা হলো— অভয়া, আনন্দময়ী, বিশ্রাম, সদ্ভাবকুসুম, শেষদান। তাঁর সংগীতকে ‘কান্তগীতি’ নামেও অভিহিত করা হয়।
এছাড়াও রচিত হয়েছে তাঁর আদর্শ সম্বলিত নীতিকবিতা, যা আমাদের বাংলা ব্যাকরণের পাঠ্যপুস্তকে অবশ্য পাঠ্য হিসেবে বিবেচিত।
‘নদী কভু নাহি করে নিজ জলপান
তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল,
গাভী কভু নাহি করে নিজ দুগ্ধ পান,
কাষ্ঠ, দগ্ধ হয়ে, করে পরে অন্নদান’
এসব ভাববাচ্যমূলক কবিতা যতটা গুরুত্ব সহকারে পাঠ্যপুস্তকে রাখা হয় ততটা গুরুত্ব সহকারে থাকে না কবির পরিচিত। ফলে শিক্ষার্থীরা কার রচনা সেসব না জেনেই গলাধঃকরণ করে পরীক্ষায় লিখে আসে৷ এভাবেই আরও অনেক কবিতা-গান নামবিহীন হয়ে গেছে তাঁর।

ধীরেধীরে বিস্মৃত হয়ে যাওয়া এসব গান-কবিতার স্রষ্টা শেষজীবনে কণ্ঠনালীর ল্যারিঙ্কস্ ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হন। অর্থ অভাব দেখা দিলে তাঁর ‘বাণী’ ও ‘কল্যাণী’ দুটি গ্রন্থের স্বত্ব বিক্রি করে অর্থ জোগাড় করা হয়। ক্যাপ্টেন ডেনহ্যাম হুয়াইটের তত্ত্বাবধানে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ট্রাকিওটোমি অপারেশন করা হয়। কিছুটা সুস্থ হলেও সাত মাস পরে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পরেন। শেষদিনগুলো কাটে হাসপাতালের কটেজ ওয়ার্ডে। অবশেষে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে কবি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বেঁচে থাকলে হয়ত সাহিত্যের আরও অবদান রাখতে পারতেন।শেষ জীবনে লিখতে শুরু করেছিলেন আত্মজীবনী। কিছুটা লিখেও ছিলেন তিনি। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু তাঁকে আর শেষ করতে দেয়নি। জীবনগুচ্ছাতে না গুচ্ছাতে চলে গেল কবি। কবির অনেক লেখা সঠিকভাবে গবেষণা, সংরক্ষণ না থাকার কারণে অপ্রকাশিত থেকে যায় বহু লেখা।

গাম্ভীর্যপুর্ণ এই সঙ্গীতকার ও কবিকে সম্মান জানিয়ে বাংলাদেশের প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক আসাদ চৌধুরী ১৯৮৯ সালে রজনীকান্ত সেন শিরোনামে একটি জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন। কবি বাঙালির হৃদয়ের আজীবন বেঁচে থাকবেন তাঁর কবিতা ও গানের মাধ্যমে। যে গানটি শুনলে মনকে প্রশান্তি পাওয়া যায়, তা হলো—
তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন
মর্ম মুছায়ে ।।
তব, পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক্, মোর
মোহ-কালিমা ঘুচায়ে।
মলিন মর্ম মুছায়ে ।
কবির ১৫৬তম জন্মদিনে জানাই শ্রদ্ধা, ভালোবাসা।