বাংলার এক বিরল ও বহুমূখী প্রতিভা প্যারীচাঁদ মিত্রের ২০৭তম জন্মবার্ষিকী আজ

বাংলার এক বিরল ও বহুমূখী প্রতিভা প্যারীচাঁদ মিত্র। ১৮১৪ সালের ২২ জুলাই কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে বাংলার নবজাগরণের প্রাণপুরুষ, বরেণ্য সাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক. প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক, সফল ব্যবসায়ী ও সংগঠক। পিতার রামনারায়ণ মিত্র পেশায় কাগজ ও হুন্ডি ব্যবসায়ী ছিলেন। পারিবারিক ঘরানায় প্যারীচাঁদ ব্যবসা কাজে লিপ্ত হলেও সাহিত্যের প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল। বাংলা,ইংরেজি এবং ফার্সি ভাষায় তিনি বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করেন।
পারিবারিক পরিমণ্ডলে শুরু হয় তাঁর শিক্ষাজীবন, শৈশবে একজন পণ্ডিত মহাশয়ের কাছে বাংলা এবং কৈশেরে একজন মুন্সর কাছে তিনি ফার্সি শিক্ষালাভ করেন। কলকাতার হিন্দু কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়াকালীন তিনি প্রখ্যাত শিক্ষক ডিরোজিওর সংস্পর্শে আসেন এবং ইংরেজি শিক্ষাসহ তাঁর আর্দশে ঔদ্বুদ্ধ হন।
ব্যবসা পেশা হিসাবে গ্রহণের পাশাপাশি তিনি শুরু করেন সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চা, বাংলাসহ ইংরেজি ভাষায় তিনি লেখা শুরু করেন, যা তৎকালীন ইংরেজি পত্রিকা Englishman, Indian Field, Hindu Patriol, Bengal Spectator, Friend of India প্রভৃতিতে নিয়মিত প্রকাশিত হয়। তাঁর ইংরেজি গ্রন্থসমূহ A Biographical Sketch of David Hare (1877), The Spiritual Stray Leaves (1879), Stray Thought of Spiritualism (1879), Life of Dewan Ramkamal Sen (1880) এবং Life of Coles Northy Grant বিশেষ সমাদৃত হয় বিশিষ্ট মহলে।
সাংবাদিকতা ক্ষেত্রেও তিনি বিশেষ খ্যাতিলাভ করেন। পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয় তাঁর সৃষ্টিতে, বাংলা সাহিত্য জগতে তিনি আবির্ভূত হন ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’ ছন্মনামে। তিনিই বাংলা সাহিত্যে প্রথম ঔপন্যাসিক হিসেবে মর্যাদা লাভ করেন, তিনি রচনা করেন ‘আলালের ঘরের দুলাল’ প্রচলিত গদ্যরীতির নিয়মভঙ্গ করে চলিত কথায়—সাধারণ মানুষের কথ্যভাষায়, বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টি করেন ইিতহাস। এই উপ্যাসের ‘ঠকচাচা’ তৎকালীন সমান্তের এক জ্বলন্ত চরিত্র, বলা হয়, বাংলা সাহিত্যে প্রথম ‘দালাল’ চরিত্রের চিত্রায়ণ ‘ঠকচাচা’।
তাঁর অপর উপন্যাস ‘মদ খাওয়া বড় দায়, জাত থাকার কি উপায়’—ব্যঙ্গাত্মক রচনায় উনিশ শতকের কলকাতার নব্যশিক্ষিত বাঙালি পুরুষদের জীবনযাপনের বিবরণ, তাঁর লেখনীতে গ্রাম্য জীবনে পুরুষদের গাঁজাসেবন এবং শহরে পুরুষদের মদ সেবনের সমান্তরাল চিত্রায়ণ ফুটে ওঠে।
বিস্তৃত তাঁর মেধা, অফুরন্ত তাঁর প্রাণশক্তি, সাহিত্য এবং সংস্কৃতিচর্চার পাশাপাশি তিনি নিযুক্ত হন বিভিন্ন সেবামূলক কাজ ও প্রতিষ্ঠানে। এরমধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য মহিলাদের জন্য একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা, জনকল্যাণমূলক কাজ, বেথুন সোসাইটি ও ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটির অন্যতম উদ্যোক্তা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সনেট সদস্য, জ্ঞানান্বেষণ সভার সদস্য, শু-ক্লেশ নিবারণী সভার সদস্য, পুলিশী অত্যাচারের বিরোধীতা, স্ত্রী শিক্ষা প্রসার, বিধবাবিবাহ সমর্থস, বাল্যবিবাহ রোধ এবং বহুবিবাহ বিরোধিতা। এক বিরল ও বহুমূখী প্রতিভা প্যারীচাঁদ মিত্র ১৮৮৩ সালে ২৩ নভেম্বর কলকাতায় পরলোকগমন করেন।
জন্মদিনে এই প্রণম্য পুরুষকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাই।
মিতালী সরকার, অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত