হৃদয়ে হুমায়ূন আহমেদ

১.
বহুব্রীহি নাটকের একটি সংলাপ আছে—‘কোথায় যে গেলেন, এখনো ঠিক বুঝতে পারছি না’। তবে এই পৃথিবীতে যে আপনি আর নেই সেটা বুঝতে পারছি।
কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর জন্মগ্রহন করেন। নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া থানার বিখ্যাত পীর জাঙ্গির মুনশি’র ছেলে মৌলানা আজিমুদ্দিন হুমায়ূন আহমেদের দাদা। দাদা ছিলেন একজন উঁচুদরের আলেম এবং মৌলানা৷ হুমায়ূন আহমেদের বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ অফিসার আর মা ছিলেন গৃহিনী৷ তিন ভাই দুই বোন। সবার বড় হুমায়ূন৷ ছোটভাই ড.জাফর ইকবাল একজন প্রখ্যাত কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও কথাসাহিত্যিক৷ সবার ছোট ভাই আহসান হাবীব নামকরা কার্টুনিস্ট এবং রম্য লেখক৷ দেশের একমাত্র কার্টুন পত্রিকা উন্মাদ’র কার্যনির্বাহী সম্পাদক৷ হুমায়ূন আহমেদ ১৯৭৩ সালে গুলতেকিনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন৷ হুমায়ূন এবং গুলতেকিন দম্পতির চার ছেলে-মেয়ে৷ দীর্ঘ ৩২ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটিয়ে ২০০৫ সালে ডিভোর্সের মাধ্যমে তাঁরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যান৷ এরপর তিনি অভিনেত্রী ও পরিচালক মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন৷ শাওন ১৯৯০ সাল থেকে টিভিতে অভিনয় শুরু করেন৷ পরবর্তীতে চলচ্চিত্রের সঙ্গেও যুক্ত হন৷ হুমায়ূন শাওন দম্পতির এক পুত্র সন্তান৷
২.
ফয়জুর রহমান ও মা আয়েশা ফয়েজের প্রথম সন্তান তিনি৷ ফলে অত্যধিক বাড়াবাড়ি রকমের আদরের মধ্য দিয়ে তাঁর শৈশবের দিনগুলি রাতগুলি পার হতে থাকে৷ বাবার ধারণা ছিল তাঁর প্রথম সন্তান হবে মেয়ে৷ তিনি মেয়ের নামও ঠিক করে রেখেছেন৷ তাঁর অনাগত কন্যা সন্তানটির জন্য তিনি একগাদা মেয়েদের ফ্রক বানিয়ে রেখেছেন৷ বানিয়ে রেখেছেন রূপার মল৷ তাঁর মেয়ে মল পায়ে দিয়ে ঝুম ঝুম করে হাঁটবে- তিনি মুগ্ধ হয়ে দেখবেন৷ কিন্তু ছেলে হওয়াতে তাঁর সব পরিকল্পনা মাঠে মারা গেল৷ তবে তিনি হাল ছাড়েন নি৷ তাঁর এই পুত্র সন্তানটিকে তিনি দীর্ঘদিন মেয়েদের সাজে সাজিয়ে রেখেছেন৷ এমন কি তাঁর মাথার চুলও ছিল মেয়েদের মতো লম্বা৷ লম্বা চুলে মা বেণি করে দিতেন। কাজল সিলেট থানার ওসি ফয়জুর রহমান সাহেবের বড় ছেলে৷

বাবার চাকরি সূত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়, বিচিত্রসব দৃশ্যাবলীর ভেতর দিয়ে তিনি ঘুরে ঘুরে তাঁর শৈশব অতিবাহিত করেছেন৷ সিলেট থেকে বাবা বদলী হন দিনাজপুরের জগদ্দলে৷ সেখানে জঙ্গলের ভেতর এক জমিদার বাড়িতে তাঁরা থাকতেন৷ জগদ্দলের দিনগুলি তাঁর কাছে ছিল হিরন্ময়৷ বাবার সাথে জঙ্গলে ভ্রমণ করতেন৷ গুলিভর্তি রাইফেল হাতে বাবা তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে জঙ্গলে ঢুকতেন৷ ঘন পাতার ফাঁক দিয়ে অল্প অল্প আলো আসত৷ থমথমে জঙ্গল৷ বিচিত্র সব পাখি ডাকত৷ বুনো ফুলের গন্ধ৷ পরিষ্কার বনে চলার পথ৷ বিচিত্র বন্য ফল৷ জঙ্গল পেরোলেই নদী৷ চকচকে বালির উপর দিয়ে স্বচ্চ পানি বয়ে যেত৷ দুপুরে সেই নদীতে গোসল করতেন৷ একবারেই আলাদা এক জীবন৷ জগদ্দল থেকে আবার বদলী৷ পঞ্চগড়ে৷ সেখানে ভোরবেলা বাসার সামনে দাঁড়ালে কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষার শুভ্র চূড়া চোখের সামনে ঝলমল করে উঠত৷ পঞ্চগড় থেকে এবার রাঙামাটি৷ পাহাড়ি উপত্যকায় আবার সেই উদ্দাম ঘুরে বেড়ানোর দিন৷ কী লোভনীয় শৈশব কেটেছে তাঁর! হুমায়ূন আহমেদের শৈশব কেটেছে এমনি স্বপ্নময়তার ভেতর দিয়ে৷
৩.
সিলেটের মীরা বাজার৷ ১৯৫০-৫৫ সালের দিকের শহর৷ গাছপালা শোভিত, প্রাচীন আমলের ঘর দোর, ভাঙা রাস্তা কোথাও কোথাও কাঁচা বাড়ি৷ আবার মাঝে মাঝে খুব সুন্দর করে সাজানো গোছানো বনেদি বাড়ি৷ স্কুল ছুটির পর এমনি এক রাস্তা ধরে হেঁটে চলছে এক বালক৷ দুরন্ত ঘাস ফড়িঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে তাঁর চলা৷ নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য নেই, যেন কোন একদিকে গেলেই হল৷ ইচ্ছে হল আর হুট করে ঢুকে পড়ল কোন বাড়িতে৷ কোন কোন বাড়ি থেকে অনাহুত ভেবে বের করে দেয় আবার কোন কোন বাড়িতে একটা ছোট্ট দেব শিশু ভেবে আদর আপ্যায়নও করে৷ এমনিভাবে হাঁটতে হাঁটতে সামনে পড়ে গাছগাছালিতে ছাওয়া এক বিশাল ঘেরা জায়গা, সেখানে ধবধবে সাদা রঙের বাংলো প্যাটার্নের একটা বাড়ি৷ সিলেট এম. সি. কলেজের রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান এস কে রায় চৌধুরী সাহেবের বাড়ি৷ বালকের কাছে অধ্যাপকের পরিচয় হচ্ছে প্রফেসর সাব, অতি জ্ঞানী লোক- যাঁকে দূর থেকে দেখলেই পূণ্য হয়৷ তো সেদিন দুপুরে সেই প্রফেসর সাবের বাড়ির গেট খোলা পেয়ে হুট করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে বালক৷ গাছপালার কী শান্ত শান্ত ভাব৷ মনে হচ্ছে সে যেন ভুল করে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি কোন বাড়ির বাগানে ঢুকে পড়েছে৷ একা একা অনেকক্ষণ সে হাঁটল৷ হঠাত্ দেখতে পেল কোনার দিকের একটি গাছের নিচে পাটি পেতে ষোল সতের বছরের একটি মেয়ে উপুর হয়ে শুয়ে আছে৷ তার হাতে একটা বই৷ সে বই পড়ছে না- তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে৷ বালকের মনে হল এত সুন্দর মেয়ে সে আর দেখেনি৷ মনে হচ্ছে মেয়েটির শরীর সাদা মোমের তৈরি৷ মেয়েটি হাত ইশারায় তাঁকে ডাকল৷ কাছে যেতেই মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, কী নাম তোমার খোকা? কাজল, বালকের উত্তর৷

এই সেই কাজল যিনি বড় হয়ে বাংলা কথাসাহিত্যে এক স্বপ্নলোকের রচনা করেছিলেন৷ আর এই স্বপ্নলোকের চাবি তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন প্রফেসর সাহেবের এই মেয়ে শুক্লা৷ সেই চাবিটির নাম অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ক্ষীরের পুতুল’৷
শৈশবে হুমায়ূন আহমেদ যত জায়গায় গিয়েছেন তার মাঝে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছিলো দিনাজপুরের জগদ্দল৷ তার প্রধান কারণ ছিল তাঁরা যেখানে থাকতেন তার আশেপাশে কোন স্কুল ছিল না৷ স্কুলের কথা মনে হলেই হুমায়ূন আহমেদের মুখ এমন তেতো হয়ে যেত যে, মনে হত যেন তাঁর মুখে জোর করে কেউ ঢেলে দিয়েছে নিশিন্দা পাতার রস৷ বাবা মা তাঁকে স্কুলে পাঠাতেন বটে তবে স্কুলে সময় কাটাতেন কেবল দুষ্টুমি করে৷ টেনে টুনে পাশ করতেন৷ প্রাইমারি স্কুল পাশের পর এই হুমায়ূন বদলে যান৷ ষষ্ট শ্রেণিতে উঠার পর থেকে স্কুলের প্রতি তাঁর আগ্রহ বাড়তে থাকে৷ আগ্রহটা এমনি ছিল যে এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট হওয়ার পর দেখা গেল তিনি সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছেন৷ ১৯৬৫ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন ৷ ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে তিনি এইচএসসি পাস করেন৷ এইচএসসি পরীক্ষাতেও তিনি মেধা তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন৷ ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে৷ ১৯৭২ সালে রসায়ন বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সাথে স্নাতকোত্তর পাশ করে তিনি একই বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন৷ পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে প্রফেসর যোসেফ এডওয়ার্ড গ্লাসের তত্ত্বাবধানে পলিমার কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি ডিগ্রি নেন৷ ড. হুমায়ূন আহমেদ লেখালেখিতে অধিক সময় এবং চলচ্চিত্রে নিয়মিত সময় দেবার জন্য পরবর্তীতে অধ্যাপনা পেশা ছেড়ে দেন ৷

বাংলাদেশের লেখালেখির ভুবনে প্রবাদ পুরুষ হুমায়ূন আহমেদ৷ গত ত্রিশ বছর ধরেই তাঁর তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা৷ ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাস দিয়ে সাহিত্যাঙ্গনে তাঁর আত্মপ্রকাশ৷ ‘নন্দিত নরকে’ যখন প্রকাশ হয় তখনই বোঝা গিয়েছিলো কথা সাহিত্যের কঠিন ভুবনে তিনি হারিয়ে যেতে আসেন নি, থাকতেই এসেছেন৷ ফলে এদেশের সাহিত্যাকাশে তিনি ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করছেন
মধ্যবিত্ত জীবনের কত কথা, বেশ কিছু সার্থক সায়েন্স ফিকশন-এর লেখকও তিনি৷ জনপ্রিয় চরিত্র মিসির আলী ও হিমুর স্রষ্টা তিনি- যে দু’টি চরিত্র যথাক্রমে লজিক এবং এন্টি লজিক নিয়ে কাজ করে৷
হুমায়ূন আহমেদের বড় মামা শেখ ফজলুল করিম যিনি তাঁদের সাথেই থাকতেন এবং যিনি ছিলেন তাঁদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী, তিনি কবিতা লিখতেন, লিখতেন নাটক এবং সেই নাটক তিনি তাঁর ভাগ্নে-ভাগ্নিদের দিয়ে বাসায় গোপনে গোপনে মঞ্চস্থও করাতেন৷ আর হুমায়ূন আহমেদের নিজের ছিল গল্প উপন্যাসের প্রতি অসাধারণ টান৷ তাঁর এই টান তৈরি করে দিয়েছিলেন মীরা বাজারের প্রফেসর রায় চৌধুরী সাহেবের মেয়ে শুক্লা৷ যিনি তাঁকে ‘ক্ষীরের পুতুল’ নামের বইটি উপহার দিয়ে সাহিত্যের প্রতি এই অসাধারণ টানের সৃষ্টি করেছিলেন৷ প্রথম যেদিন তিনি ওই বাড়িতে ( যে বাড়ির বর্ণনা লেখার শুরুতে দিয়েছি) যান শুক্লা তখন তাঁকে মিষ্টি খেতে দিয়েছিলেন৷ মিষ্টির লোভে দ্বিতীয় দিন আবার সেই বাড়িতে গেলে শুক্লা আবার তাঁকে মিষ্টি খেতে দেন৷ তৃতীয় দিন তিনি তাঁর ছোট বোন শেফালিকে নিয়ে যান৷ শুক্লাদের বাড়িতে তখন মিষ্টি ছিল না৷ শুক্লা তখন মিষ্টির পরিবর্তে তাঁদের হাতে তুলে দেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ক্ষীরের পুতুল’ বইটি৷ক্ষীরের পুতুল’ হলো হুমায়ূন আহমেদের পড়া প্রথম সাহিত্য৷

যদিও তাঁর প্রথম রচনা ‘নন্দিত নরকে’ তবে তারও বহু পূর্বে তিনি একটি সাহিত্য রচনা করেছিলেন৷ দিনাজপুরের জগদ্দলে থাকা অবস্থায়৷ জগদ্দলের যে জমিদার বাড়িতে তাঁরা থাকতেন৷ সেখানে জমিদারের পরিত্যাক্ত সম্পত্তির তালিকায় ছিল একটি কুকুর৷ জমিদারের অনেকগুলি কুকুর ছিল৷ তিনি সবকটি কুকুরকে নিয়ে যেতে চাইলেও এই কুকুরটি যায়নি৷ রয়ে গিয়েছিল বাড়ির মায়ায় আটকা পড়ে৷ কুকুরটির নাম ছিলো বেঙ্গল টাইগার৷ তাঁরা যেখানেই যেতেন কুকুরটি সাথে সাথে যেত৷ কুকুরটির সাথে তাঁদের একরকম বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল৷ একদিন ভোরবেলা হুমায়ূন আহমেদ জমিদার বাড়ির মন্দিরের চাতালে বসে আছেন তাঁর সাথে আছে ছোট বোন শেফালি ও ছোট ভাই জাফর ইকবাল৷ কিছুক্ষণ পর তাঁর মা তাঁদের সবার ছোট ভাই আহসান হাবীবকে বসিয়ে রেখে গেলেন, আর তাঁদের উপর দায়িত্ব দিয়ে গেলেন তাঁকে দেখে রাখার জন্য৷ মা চলে যাওয়ার পর দেখতে পেলেন একটা প্রকাণ্ড কেউটে দরজার ফাঁক থেকে বের হয়ে এসেছে৷ ফণা তুলে হিস হিস শব্দে সে আহসান হাবীবের দিকে এগিয়ে আসছে৷ ঠিক তখুনি বেঙ্গল টাইগার ঝাঁপিয়ে পড়ে সাপটির ফলা কামড়ে ছিঁড়ে ফেলে৷ সাপও তার মরণ ছোবল বসিয়ে দিয়ে যায় কুকুরের গায়ে৷ দু’দিন পর যখন বিষক্রিয়ায় কুকুরের শরীর পচে গলে যেতে থাকে তখন তাঁদের বাবা মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবার জন্য কুকুরটিকে গুলি করে মেরে ফেলেন৷ এই ঘটনা হুমায়ূন আহমেদের মনে গভীর দাগ কাটে৷ এই কুকুরকে নিয়েই তিনি প্রথম কিছু লিখেছিলেন, নাম দিয়েছিলেন বেঙ্গল টাইগার (অথবা আমাদের বেঙ্গল টাইগার)৷ তারপর ১৯৭২ সালে ‘নন্দিত নরকে’ রচনা করেন৷ তারপর তো সবই ইতিহাস৷ একে একে শঙ্খনীল কারাগার, রজনী, গৌরিপুর জংশন, অয়োময়ো, দূরে কোথাও, ফেরা, কোথাও কেউ নেই, আমার আছে জল, অচিনপুর, এইসব দিনরাত্রিসহ দুইশতাধিক উপন্যাসের জনক হূমায়ূন আহমেদ৷
৪.
পেশাগত জীবনে হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক৷ তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমনি’ ৷ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই চলচ্চিত্রটি দেখতে প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের ঢল নেমেছিল৷ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে আটটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নিয়েছিল এই ছবিটি৷ তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরেকটি চলচ্চিত্র ‘শ্যামল ছায়া’ বিদেশী ভাষার ছবি ক্যাটাগরিতে অস্কার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল৷ তাঁর অন্য কীর্তি শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা প্রভৃতি চলচ্চিত্রগুলি কেবল সুধীজনের প্রশংসাই পায়নি, মধ্যবিত্ত দর্শকদেরও হলমুখী করেছে বহুদিন পর।
টিভি নাট্যকার হিসেবেও তিনি সমান জনপ্রিয়৷ তাঁর প্রথম টিভি নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’ মধ্য আশির দশকে তাঁকে এনে দিয়েছিল তুমুল জনপ্রিয়তা৷ তাঁর হাসির নাটক ‘বহুব্রীহি’ এবং ঐতিহাসিক নাটক ‘অয়োময়ো’ বাংলা টিভি নাটকের ইতিহাসে একটি অনন্য সংযোজন৷ নাগরিক ধারাবাহিক ‘কোথাও কেউ নেই’-এর চরিত্র বাকের ভাই বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছিল টিভি দর্শকদের কাছে৷
ছাত্র জীবনে একটি নাতিদীর্ঘ উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যজীবনের শুরু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হল-এর অধিবাসী ছাত্র হুমায়ূন আহমেদের এই উপন্যাসটির নাম নন্দিত নরকে। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উপন্যাসটি প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭২-এ কবি-সাহিত্যিক আহমদ ছফার উদ্যোগে উপন্যাসটি খান ব্রাদার্স কর্তৃক গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রখ্যাত বাঙলা ভাষাশাস্ত্র পণ্ডিত আহমদ শরীফ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখে দিলে সবার মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি হয়। শঙ্খনীল কারাগার তাঁর ২য় গ্রন্থ। এ পর্যন্ত (২০০৯) তিনি দুই শতাধিক গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস প্রকাশনা করেছেন।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস মধ্যাহ্ন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে পরিগণিত। এছাড়া জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প আরেকটি বড় মাপের রচনা যা কি-না ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তযুদ্ধ অবলম্বন করে রচিত। তবে সাধারণত তিনি সমসাময়িক ঘটনাবলী নিয়ে লিখে থাকেন। তাঁর গল্প সংগ্রহ ১৯৭১ বাংলা ছোটগল্প জগতে একটি নতুন দিগন্ত বলে গণ্য হয়। গল্প তৈরীতে তাঁর প্রতিভা তুলনা রহিত।

৫.
ঢাকা শহরের অভিজাত আবাসিক এলাকা ধানমন্ডীতে নির্মিত তাঁর বাড়ীর নাম দখিন হাওয়া। আর ঢাকার অদূরে গাজীপুরের গ্রামাঞ্চলে স্থাপিত বাগান বাড়ী নূহাশ পল্লীতে কাটে তার বেশির ভাগ সময়। তিনি বিবরবাসী মানুষ তবে মজলিশী। রসিকতা তার প্রিয়। তিনি ভণিতাবিহীন। নিরবে মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি ও আচার-আচরণ পর্যবক্ষেণ করা তার শখ। তবে সাহিত্য পরিমণ্ডলের সংকীর্ণ রাজনীতি বা দলাদলিতে তিনি কখনো নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন নি। তিনি স্বল্পবাক, কিছুটা লাজুক প্রকৃতির মানুষ এবং বিপুল জনপ্রিয়তা সত্বেও অন্তরাল জীবন-যাপনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তিনি ছবি এঁকেও অবসর সময় কাটাতে ভালবাসেন। তিনি অত্যন্ত অভিমানী প্রকৃতির মানুষ। স্ত্রী গুলতেকিনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদের পর আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের কাছ থেকে যে বৈরীতামূলক ব্যবহার পেয়েছেন তা তাঁক ব্যথিত করেছে।
৬.
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। উল্লেখযোগ্য—বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮১),শিশু একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক (১৯৯৪), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (শ্রেষ্ঠ কাহিনী ১৯৯৩, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ১৯৯৪, শ্রেষ্ঠ সংলাপ ১৯৯৪), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসুদন পদক (১৯৮৭), বাকশাস পুরস্কার (১৯৮৮), হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদক।
৭.
২০১২ সালের ১৯ জুলাই ক্যান্সার নিয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের বেলভ্যু হাসপাতালে মারা যান। এই প্রণয়দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা।
এক নজরে হুমায়ূন আহমেদ :
জন্ম : ১৯৪৮, ১৩ নভেম্বর৷ নেত্রকোণা জেলার কুতুবপুর গ্রামে৷
বাবা : ফয়জুর রহমান আহমেদ৷
মা : আয়েশা ফয়েজ৷
স্ত্রী : মেহের আফরোজ শাওন৷
শিক্ষা : মাধ্যমিক, বগুড়া জিলা স্কুল, ১৯৬৫৷ উচ্চ মাধ্যমিক, ঢাকা কলেজ, ১৯৬৭৷ স্নাতক (সম্মান) রসায়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৭০৷ স্নাতকোত্তর (রসায়ন) ১৯৭২৷ পি এইচ ডি, নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটি, ১৯৮২৷
পেশা : অধ্যাপনা, রসায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় অবসর, বর্তমানে লেখালেখি ও চলচ্চিত্র নির্মাণ৷
উল্লেখযোগ্য উপন্যাস : নন্দিত নরকে, লীলাবতী, কবি, শঙ্খনীল কারাগার, মন্দ্রসপ্তক, দূরে কোথায়, সৌরভ, নী, ফেরা, কৃষ্ণপক্ষ, সাজঘর, বাসর, গৌরিপুর জংশন, নৃপতি, অমানুষ, বহুব্রীহি, এইসব দিনরাত্রি, দারুচীনি দ্বীপ, শুভ্র, নক্ষত্রের রাত, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমনি, শ্রাবণ মেঘের দিন, বৃষ্টি ও মেঘমালা, মেঘ বলেছে যাবো যাবো, জোছনা ও জননীর গল্প প্রভৃতি৷
উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র : আগুনের পরশমনি, শ্যামল ছায়া, শ্রাবন মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, নয় নম্বর বিপদ সংকেত৷
পুরস্কার : একুশে পদক (১৯৯৪), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮১), হুমায়ুন কাদিও স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূধন দত্ত পুরস্কার (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮)৷ দেশের বাইরেও হয়েছেন মূল্যায়িত৷ জাপান টেলিভিশন NHK তাঁকে নিয়ে একটি পনের মিনিটের ডকুমেন্টারি প্রচার করেছে Who is who in Asia শিরোনামে৷