ঐতিহাসিক এবিএম হোসেন: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবস্তম্ভ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ‘প্রফেসর অব ইমেরিটাস’। তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইতিহাসবিদ। ।অধ্যাপক ড. এ বি এম হোসেন। এই নাম উচ্চারণ করলেই যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব বেড়ে যায়।
ড. এ বি এম হোসেন ‘ত্রিকালদর্শী। বৃটিশ আমলে পড়াশুনা শুরু করেন; পাকিস্তান আমলে অধ্যাপনায় ব্রতী হন; স্বাধীন বাংলাদেশে খ্যাতির শীর্ষে উঠেন। এমন গৌরবদীপ্ত শিক্ষক বাংলাদেশে বিরল, যিনি একটানা ৬০ বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। ৪০ বছর নিয়মিত শিক্ষক, ২০ বছর ইমেরিটাস প্রফেসর। এ-এক অনন্য কাব্যিক মহাজীবন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েরই শুধু নন, অধ্যাপক এ বি এম হোসেন বাঙালি জাতিরও গৌরবস্তম্ভ। ১৯৭৭ সালে নরওয়ের জাতীয় সংসদ নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য গঠিত বোর্ডে তাঁকে মনোনীত সদস্য নির্বাচিত করে। এই বিরল সম্মান অতি গৌরবের, তাই তিনি বিশ্ব-বাঙালির অহংকার।
এমন বিরল সম্মাননার আরেকটি হচ্ছে, ক্যাবিনেটের সিদ্ধান্তক্রমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ বিশেষ মর্যাদা দিয়ে ১৯৮৪ সালে প্রফেসর এ বি এম হোসেন ওআইসিতে নিয়ে যান। তুরস্কের আঙ্কারায় অনুষ্ঠিত ওআইসি কনফারেন্স-এ মূল অধিবেশনে মূল বক্তব্য (keynote speaker) হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে তিনি অভিভাষণ রাখেন ইসলামি স্কলার হিসেবে। বাংলাদেশের পণ্ডিত হিসেবে ইসলামি বিশ্বে তখন তাঁর নাম সমাদৃত হয়। ইসলামি বিশ্বের দেশসমূহের সরকার প্রধান ও রাস্ট্র প্রধানগণ সম্মানের দৃষ্টিতে দেখেন। দেশ-বিদেশে আর বহু সম্মানায় তিনি ভূষিত।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের সময় গৃহীত ‘১৯৭৩ সালের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়ন’ (৭৩’র অধ্যাদেশ নামে খ্যাত) কমিটির তিনি সদস্য ছিলেন।
‘ইমেরিটাস প্রফেসর’ হওয়ার কারণে ড. এ বি এম হোসেন আমৃত্যু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। ১৯৬০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ২০০১ সালে ‘প্রফেসর ইমেরিটাস’ হিসেবে নিযুক্ত হন। স্বাধীনতার আগেই তিনি ১৯৭২ সালে পূর্ণ প্রফেসর হন।
২০২০ সালের ১০ জুলাই দিবাগত রাত ২টায় (তখন ১১ জুলাই) মহান এই শিক্ষক মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে স্যারের বয়স হয়েছিল ৮৬।
কুমিল্লার দেবিদ্বারের ঐতিহ্যবাহী ‘ধামতী’ গ্রামে ড. এ বি এম হোসেন ১৯৩৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর এক খ্যাতিমান এক মুসলিম জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম আবুল বাশার মোশাররফ হোসেন।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ও দেবিদ্বার রিয়াজুদ্দিন পাইলট স্কুল থেকে যথাক্রমে উচ্চমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। বেঙ্গল স্ট্যান্ড করা ছাত্র হিসেবে এখনও কুমিল্লা অঞ্চলে অতি প্রবীন লোকদের কাছে তাঁর মেধার খ্যাতি শোনা যায়।
এরপর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে রেকর্ড পরিমাণ নম্বর পেয়ে প্রথম শেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা লাভের পর তিনি কেন্দ্রিয় সরকারের সরকারি মেধাবৃত্তি নিয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৫৮ ও ১৯৬০ সালে ইতিহাস ও ইসলামি প্রত্নতত্ত্বে যথাক্রমে বিএ অনার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা লাভের পর তিনি কেন্দ্রিয় সরকারের সরকারি মেধাবৃত্তি নিয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৫৮ ও ১৯৬০ সালে ইতিহাস ও ইসলামি প্রত্নতত্ত্বে যথাক্রমে বিএ অনার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
মোঘল সম্রাট আকবরের রাজপ্রাসাদ ফতেপুর সিক্রি বিষয়ে পিএইচডি থিসিস লিখেন। তাঁর পিএইচডির বিষয়বস্তু ছিলো ‘History and Archaeology of Fathpur-Sikri. School of Oriental and African Studies’। তাঁর পিএইচডির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বিখ্যাত ঐতিহাসিক Professor Cordington and Professor Rice।
বঙ্গীয় সভ্যতার পাদপীঠ প্রাচীন ‘সমতট’ রাজ্যের (এখনকার কুমিল্লা) রাজধানী বা প্রধান কেন্দ্র লালমাই ও ময়নামতি প্রত্নতাত্ত্বিক প্রথম খনন শুরু হয় ১৯৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে। প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. এফ এ খানের খননের নেতৃত্বে দেন। খনন দল এই ময়নামতি ও লালমাইয়ের ১৮ কিলোমিটার প্রত্ন-এলাকার বিভিন্ন ধ্বংসস্তূপ থেকে বিভিন্ন প্রত্ননিদর্শন খুঁড়ে-খোঁজে বের করেন।
ময়নামতিতে প্রাপ্ত প্রত্নসম্পদের ভিত্তিতেই লেখা হয়েছে বাঙালির গৌরবের ইতিহাস, যে ইতিহাসের জনক হয়েছেন খনন দলের প্রতিটি সদস্য। এ বি এম হেসেন-এর নামও লেখা হয়েছে এই গৌরবের ইতিহাসের সোনালী পাতায়। কারণ তিনি ছিলেন এই খনন দলের একজন নবিন সদস্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসাধারণ রেজাল্টের কারণে এ বি এম হোসেনের মেধা-খ্যাতি তখন পাকিস্তান সরকার ও বিদ্ব্যৎসমাজে ব্যাপকৃতভাবে সমাদৃত হয়। তৎকালিন পাকিস্তান কেন্দ্রিয় সরকারের সিদ্ধান্তে এ বি এম হোসেনকে ময়নামতির প্রত্নতাত্ত্বিক খনন দলে যুক্ত করা হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন প্রফেসর প্রফেসর ড. ফজলুল হক, যিনি প্রফেসর এ বি এম হেসেনের গৌরবদীপ্ত ছাত্র ও সহকর্মী। তিনি জানান, ‘স্যার শিক্ষকতা জীবনে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একস্ট্রা মুরাল লেকচারার, নাফিল্ড ফেলো, ইউনেস্কো ইন্টারন্যাশনাল ফেলো এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আগাখান ফাউন্ডেশন ফর ইসলামিক আর্কিটেকচারের উপদেষ্টা ছিলেন। তাঁর নিবিড় গবেষণার বিষয়বস্তু ইসলামী শিল্পকলা হলেও তিনি তাঁর মূলধারার বিষয় মধ্যপ্রাচ্যের সামগ্রিক ইতিহাস থেকে বিচ্যুত হননি।’
প্রফেসর এ বি এম হোসেন রচিত ১১টি আকর গ্রন্থ দেশ-বিদেশে পণ্ডিতমহলে ব্যাপক সমাদৃত। ‘পরন্ত বেলার গল্প’। প্রফেসর এ বি এম হোসেনের আত্মজীবনী। জীবনী গ্রন্থটি জ্ঞানের আধার। গৌরবের অসামান্য দলিল।
প্রফেসর এ বি এম হোসেন রচিত ১১টি আকর গ্রন্থ দেশ-বিদেশে পণ্ডিতমহলে ব্যাপক সমাদৃত। ‘পরন্ত বেলার গল্প’। প্রফেসর এ বি এম হোসেনের আত্মজীবনী। জীবনী গ্রন্থটি জ্ঞানের আধার। গৌরবের অসামান্য দলিল।
শৈশব-শিক্ষা-বেড়ে ওঠা, মুক্তিসংগ্রাম, মহান মুক্তিযুদ্ধ, রণাঙ্গনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন্ত-বিবরণ ছাড়াও বিশ্বপণ্ডিত-সমাজে তাঁর বিচরণের গৌরবসাক্ষী ‘পরন্ত বেলার গল্প’-তে।
তাঁর দীর্ঘ শিক্ষা জীবনের গবেষণা ও অভিজ্ঞতার ফসল ইউজিসি কর্তৃক প্রকাশিত ‘মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস : অটোম্যান সাম্রাজ্য থেকে জাতিসত্ত্বা রাষ্ট্র’ গ্রন্থটি। বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মুসলিম শিল্পকলা’, ‘আরব স্থাপত্য’ ছাড়াও প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাসের বিভিন্ন ঘরানার গ্রন্থ এবং শতাধিক মৌলিক প্রবন্ধের তিনি জনক।
পৃথিবীর বিখ্যাত জার্নালসমূহে তাঁর গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ হতো। তিনি তত্ত্বাবধান, সম্পাদনা ও নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশ-বিদেশের বহু গবেষণা কর্ম। দেশে বিদেশে তিনি বহু মনীষীর সংস্পর্শে এসেছেন, আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে যোগদান করেছেন এবং তাঁদের সান্নিধ্য ও জ্ঞানচর্চায় আলোকিত হয়েছেন।
১৯৮৫ সালে এথেন্সে অনুষ্ঠিত মানবাধিকার কমিশনে বাংলাদেশের পক্ষে পর্যবেক্ষক সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ও বাংলা একাডেমির সম্মানিত আজীবন ফেলো ছাড়াও বিশ্বের খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠানের সদস্য।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর এ বি এম হোসেন সকলের অশেষ শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। স্যারের শিক্ষকতা জীবনের সায়াহ্নে দেখেছি, স্যার যদি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেন, উপাচার্যের গাড়ি স্যারকে ক্রস করে এগিয়ে যেতো না। আমি নিজে স্বাক্ষী, এ বি এম স্যার একদিন প্যারিস রোড দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, স্যারের পেছনে গাড়ি থেমে গেল, গাড়ি থেকে নেমে এলেন উপাচার্য প্রফেসর ড. সাইদুর রহমান খান (তিনি পরবর্তীতে বৃটেনে বাংলাদেশের হাই কমিশনার ছিলেন)।
উপাচার্য মহোদয় বিনয়ে সালাম দিয়ে স্যারের সাথে মৃদস্বরে কথা বলতে বলতে স্যারের পেছন পেছন হাঁটতে লাগলেন।
ড. সাইদুর রহমান খানের উপাচার্যের মেয়াদেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ড. এ বি এম হোসেনকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ‘ইমেরিটাস প্রফেসর’ হিসেবে নিযুক্ত করে।
এ বি এম হোসেনের বর্ণাঢ্য জীবন। স্ত্রী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ প্রফেসর ড. শাহানারা হোসেন।
‘শেষ বেলার পাঁচালি’ শাহানারা হোসেনের বিখ্যাত জীবনীগ্রন্থ, বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছে। বিশেষত ‘প্রাচীন বাংলার ইতিহাস’, `Ancient History of Bengal’ তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থ।
প্রফেসর ড. শাহানারা হোসেন ২০১৯ সালে ৩১ আগস্ট তিনি প্রয়াত হন। এই ঐতিহাসিক দম্পতির এক ছেলে, এক মেয়ে কানাডার ও আমেরিকা প্রবাসী, তাঁরা উভয়েই অত্যন্ত মেধাবী এবং এক সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষতা করেছেন। বড় ছেলে ঢাকায় থাকেন, খ্যাতিমান ব্যাংকার।
শাহানারা হোসেনের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার নবীনগর উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবদুল হাফিজ শাহানারা হোসেনের পিতা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মমতাজ উদ্দীন আহমেদ (তিনিও ব্রাহ্মাণবাড়ীয়ার মানুষ) তাঁর মামা।
জানা যায়, ড. মমতাজ উদ্দীন আহমেদ তখন নতুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার প্রত্যয়ে অনেক মেধাবী শিক্ষককে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসেন; এরই ফলশ্রুতি এবিএম হোসেন দম্পতির লন্ডন ছেড়ে রাজশাহীতে আসা।
বরেণ্য শিক্ষাবিদ, সনৎকুমার সাহা এক লেখায় এক লেখায় এ বি এম হোসেন দম্পতির সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। অবশ্য লেখাটি প্রকাশ হয়েছিল শাহানারা হোসেন মৃত্যুর একমাস আগে। সনৎকুমার সাহা বলেন, ‘তাঁকে (শাহানারা হোসেন) প্রথম দেখি ১৯৬০ সালে। একা নন। স্বামী ডক্টর এ. বি. মোশাররফ হোসেনও তাঁর সঙ্গে। দুজনই এসেছেন আমাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দিতে। আমি তখনো ছাত্র। তাঁদের বিষয়ে কিছুই জানি না। কিন্তু চোখে পড়াতেই মুগ্ধ। দুজনেই সাধারণের তুলনায় দীর্ঘদেহী-দিব্যকাস্তি। শাহানারা হোসেন যেন রাজহংসী। লালিত্যের সঙ্গে গাম্ভীর্যের মিশেল। দেবী প্রতিমার মতো। আপনা থেকে মাথা নত হয়। গুণের কথা জেনে অবাক হই আরো। দুজনেই লন্ডন-স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ থেকে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে এসেছেন। এ. বি. এম হোসেন ইসলামের ইতিহাসে ডক্টরেট। আর শাহানারা হোসেন পরে গিয়ে খুব অল্প সময়েই সাধারণ ইতিহাসে এমএ। অবশ্য তার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নজরকাড়া ফল দেখিয়ে যোগ্যতার ছাপ রাখতে পারেন বলেই লন্ডনের সেরা স্কুলে তাঁরা ভর্তি হতে পারেন। শাহানারা হোসেন পরে আবার ওখান থেকে ডক্টরেট করেন। সেটা ১৯৬৬ সালে। ডক্টর এ. বি. এম হোসেন এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর এমেরিটাস। ক’বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ডক্টর শাহানারা হোসেনকেও তাঁদের বিশেষ মর্যাদার ইউজিসি-প্রফেসর পদে বরণ করে তাঁর মেধার প্রতি সম্মান জানান। দুজনই আমাদের অশেষ শ্রদ্ধার। এ. বি. এম হোসেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসলামিক সংস্কৃতি, বিশেষ করে স্থাপত্যকলার ওপর একজন বিশেষজ্ঞ বলে নন্দিত। শাহানারা হোসেনের অবিসংবাদী দক্ষতা প্রাচীন বাংলার ইতিহাস‘ (মাসিক কালি ও কলম, ‘শাহানারা হোসেনের শেষ বেলার পাঁচালী’, ২৩ জুলাই ২০১৯) ।
বরেণ্য ইতিহাসবিদ জ্ঞানতাপস এ বি এম হোসেনের ষাট বছরের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা জীবনে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী তাঁর দীক্ষা পেয়েছেন। আমিও সরাসরি স্যারের একজন নগন্য সাধারণ ছাত্র। স্যারের প্রজ্ঞা-জ্ঞানসাধনা, নীতি-আদর্শ ও পাণ্ডিত্যস্পর্শে আমরা চেতনাদীপ্ত হয়েছি। আমাদের মধ্যে প্রগাঢ় অহংকার আছে স্যারের ছাত্র হওয়ার। যে অহংকারের চেতনা আমাদের দেশমাতৃকাকে ভালবাসতে শিখিয়েছে; সত্যনিষ্ঠ করেছে; সত্য-মিথ্যার প্রভেদ শিখিয়েছে।
আমি যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যারের সরাসরি ছাত্র হই, ১৯৮৭ সালে। পরিচিত হতে চেম্বারে যাই। নবিয়াবাদ গ্রাম বলতেই আমার দিকে স্যার তাকালেন (স্যারের পাশের গ্রাম)। আমি অবাক হয়ে যাই, কারণ আমার আব্বার চেহারার সাথে স্যারের চেহারা যেন হুবহু মিল, তখন আব্বা বেঁচে ছিলেন। স্যার বসালেন, আমার উদ্দেশে পণ্ডিত-উক্তি, ‘শীলভদ্রের নাম শুনেছো, ময়নামতি সম্পর্কে জান’। ময়নামতিকে সামান্য জানি, শীলভদ্রের নাম তো শুনিনি। মাথা নিচু করে রাখলাম। স্যার হাসিমুখে বললেন, ‘যাও সন্ধান কর।’
পরে জেনেছি, শীলভদ্রের জীবনঘনিষ্ঠ হই। প্রাচীন বাংলার সপ্তম শতকের বিশ্ববিশ্রুত পণ্ডিত শীলভদ্র। শীলভদ্রের জন্ম ৫২২ খি. মৃত্যু ৬৫৪। তিনি প্রাচীন ভারতের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ছিলেন। নালন্দায় শীলভদ্রের ছাত্র ছিলেন বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ। শীলভদ্রের আগে এতবড় বাঙালি পণ্ডিতের নাম জানা যায় না। কবিগুরু কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ’ প্রবন্ধে পণ্ডিত শীলভদ্রের প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।
আমি তিন দশক ধরে শীলভদ্রকে সন্ধান করছি; খুজে ফিরছি অন্তহীনভাবে; জীবনভর খুঁজে ফিরবও। ড. এ বি এম স্যারকে আমি শীলভদ্রের সাথেই তুলনা করি। পাণ্ডিত্যে ও মনীষায় তিনি এ যুগের শীলভদ্র।
জ্ঞানতাপস প্রফেসর ড. এ বি এম হোসেন স্যার একজন মহৎপ্রাণ বিশ্ব-বরেণ্যবাঙালি। বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতি এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। বাঙালি জাতির গৌরবদীপ্ত সন্তান।
পরিশেষে বলি, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রফেসর এ বি এম হোসেন হোসেন দম্পতি সপরিবারে রাজশাহীতেই আটকা পড়েছিলেন। তাঁকে একাধিকবার সামরিক বাহিনীর লোকেরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল। মৃত্যুভয়ে পালিয়ে যাননি। তাঁর গভীর অনুরাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি। আজীবন তিনি জ্ঞানসাধনা, গবেষণা আর জ্ঞান বিতরণে নিবেদিত ছিলেন। পদ-পদবী তাঁকে তাড়িত করেনি কখনও। স্যার অতিশয় সত্যব্রতী মানুষ। এমন সন্তান জন্ম দিয়ে বাংলা মায়ের স্বর্নজঠরও যেন ধন্য।
মো. সফিকুল ইসলাম : উপ-রেজিস্ট্রার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।