আজ কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ৩০তম মৃত্যুবার্ষিকী

আজ কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ৩০তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯১ সালের ২১ জুন ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারের নিজ বাসভবনে আকস্মিক হ্নদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মাত্র ৩৪ বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। এই অল্প সময়ে তিনি লিখে গেছে অজস্র কবিতা,গল্প, কাব্যনাট্য ও গান।
‘ভালো আছি ভালো থেকো/ আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো, দিও তোমার মালাখানি বাউলের এই মনটারে…আমার ভিতর-বাহিরে অন্তরে-অন্তরে, আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।’ সত্তর দশকের অন্যতম জনপ্রিয় গান। যা প্রায় প্রতিটি কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল। এমন অর্ধশতাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন তিনি।
কবিতা চর্চার পাশাপাশি তিনি সঙ্গীত, নাটক, ছোটগল্পের ক্ষেত্রেও ছিলেন সমান উৎসাহী। ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বরিশাল শহরের রেডক্রস হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার শেখ ওয়ালীউল্লাহ এবং মায়ের শিরিয়া বেগম। তাদের স্থায়ী নিবাস বাগেরহাট জেলার মংলা থানার অন্তর্গত সাহেবের মেঠ গ্রামে, তবে পিতার কর্মস্থল ছিল বরিশাল। তাঁর বাবা পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। দশ ভাই বোনের মাঝে তিনিই ছিলেন সবার বড়।
১৯৭৩ সালে ঢাকা ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৭৫ সালে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেন। তিনি ছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৭৫ সালের পরের সবকটি সরকারবিরোধী ও স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। প্রতিবাদী কবি হিসেবে খ্যাত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, দেশাত্মবোধ, গণআন্দোলন, ধর্মনিরপেক্ষতা, ও অসাম্প্রদায়িকতা তার কবিতায় বলিষ্ঠভাবে উপস্থিত। এছাড়া স্বৈরতন্ত্র ও ধর্মের ধ্বজাধারীদের বিরুদ্ধে তার কণ্ঠ ছিল উচ্চকিত।
এই ৩৪ বছরের জীবনে কবি রচনা করেছেন ৭টি কাব্যগ্রন্থ, একটি গল্পগ্রন্থ, একটি কাব্যনাট্য, একটি বড় গল্পসহ অর্ধশত গান।। তা হলো- উপদ্রুত উপকূল (১৯৭৯),ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম (১৯৮১),মানুষের মানচিত্র (১৯৮৬), ছোবল (১৯৮৬),গল্প (১৯৮৭),দিয়েছিলে সকল আকাশ (১৯৮৮), মৌলিক মুখোশ (১৯৯০)। গল্পগ্রন্থ সোনালি শিশির; কাব্যনাট্য বিষ বিরিক্ষের বীজ, বড়গল্প মনুষ্য জীবন।
১৯৮০ সালে পুরস্কার পেয়েছেন মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার।

১৯৮১ সালে তিনি প্রখ্যাত লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে বিয়ে করেন। কিন্তু তাঁদের এই দাম্পত্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৮৬ সালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। ১৯৯১ সালের আজকের দিনে তিনি ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারের নিজ বাসভবনে আকস্মিক হ্নদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
কবির স্মৃতিকে স্মরণ করে কবির বিখ্যাত কবিতা বাতাসে লাশের গন্ধ বইচারিতার পাঠকের তুলে ধরা হলো-
আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই
আজো আমি মাটিতে মৃত্যূর নগ্ননৃত্য দেখি,
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে…
এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দু:স্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময় ?
বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে
মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।
এই রক্তমাখা মটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো।
জীর্ণ জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আধাঁর,
আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।
এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আরষ্ট কুমারী জননী,
স্বাধীনতা – একি হবে নষ্ট জন্ম ?
একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল ?
জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরোনো শকুন।
বাতাশে লাশের গন্ধ
নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দুলে মাংসের তুফান।
মাটিতে রক্তের দাগ –
চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়
এ চোখে ঘুম আসেনা। সারারাত আমার ঘুম আসেনা-
তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকার,
নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ
মুন্ডহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বিভৎস্য শরীর
ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে। আমি ঘুমুতে পারিনা, আমি
ঘুমুতে পারিনা…
রক্তের কাফনে মোড়া – কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে
সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা।
স্বাধীনতা, সে আমার – স্বজন, হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন –
স্বাধীনতা – আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।
ধর্ষিতা বোনের শাড়ী ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।