সুফিয়া কামাল আজীবন দেশকে ভালোবেসেছেন

কারও মৃত্যুতে যখন রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়, মরদেহ যখন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়, পুলিশ আর মিলিটারি যখন অস্ত্রসহ সালাম জানায়,কবরস্থানটি দেশের পতাকা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। এমন সম্মান ক’জনই বা পায়। বাংলাদেশের প্রথম যে নারীকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়েছিল তাঁর নাম বেগম সুফিয়া কামাল। আজ ২০ জুন, এই মহীয়সী নারীর জন্মদিন।
বাংলার নারী সমাজের এক আলোকবর্তিকা বেগম সুফিয়া। কিন্তু আমরা কতটুকুই বা জানি এই মহামানবী সম্পর্কে।

বেগম সুফিয়া কামালের জন্ম হয়েছিল ১৯১১ সালে, বরিশালের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তৎকালীন মুসলমান মেয়েদের স্কুলে যেতে বিস্তর বাঁধা থাকায় তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্ভব হয়নি। তবে গৃহশিক্ষকের কাছে অন্দরমহলে তিনি হিন্দি, উর্দূ, আরবি, ফার্সিসহ অনেক ভাষাই শিক্ষালাভ করেন। কিন্তু বাংলা ভাষাটা তিনি নিজ আগ্রহে মায়ের কাছেই শেখেন। মাতুলালয়ে অবস্থান করার সুবাদে তিনি সাহিত্য চর্চার অনন্য সুযোগ লাভ করেন। কারণ মামাবাড়িতে বিশাল লাইব্রেরী ছিল।
মাত্র ১৩ বছর বয়সেই মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয় সুফিয়ার। সাহিত্যপ্রেমী নেহাল হোসেনের কাছে পরবর্তীতে বাংলা ভাষা শিক্ষা এবং সাহিত্য ক্ষেত্রে অনেক সহযোগিতা পান তিনি। ১৯৩২ সালে তার স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেন মারা গেলে ২১ বছর বছর বয়সেই তিনি বিধবা হয়ে যান। পরবর্তীতে ১৯৩৭ সালে কামালউদ্দিন আহমদের সঙ্গে তাঁর আবার বিয়ে হয়। ছোটবেলা থেকেই নারীদের অবহেলার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল। কলকাতায় বেগম রোকেয়ার সঙ্গে দেখা হয়। বেগম রোকেয়ার সংস্পর্শে তাঁর চিন্তার জগতের বিশাল পরিবর্তন ঘটে। তাঁর কথাবার্তা কাজকর্ম সুফিয়ার কোমল শিশু মনে বিশেষ জায়গা করে নেয়। আর এর পরেই সাহিত্য রচনা করা শুরু করেন যা মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত অব্যহত ছিল।
বাংলাদেশের প্রথম যে নারীকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়েছিল তাঁর নাম বেগম সুফিয়া কামাল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং প্রশংসা করেছিলেন বেগম সুফিয়া কামালের কবিতার। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামেরও ভীষণ স্নেহধন্য ছিলেন সুফিয়া কামাল।
১৯২৫ সালে দেখা হয় মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে। গান্ধীজীর কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন বেগম সুফিয়া। ঐ দেখার পর থেকে ভীষণ সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন তিনি। বিলাসিতাকে স্থান দেননি তাঁর চলার পথে।
বেগম সুফিয়া কামাল আজীবন দেশকে ভালোবেসেছেন, নারীদের উন্নয়নে কাজ করেছেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় হিন্দু-মুসলিম দাঙার বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করেছেন। ১৯৪৭ সালেই তিনি পরিবার সহ ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় সমর্থন দিয়েছেন। যে কারণে পাকিস্তানের সামরিক সরকার তার উপর কড়া নজরদারীর ব্যবস্থা করে।

১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধের ঘোষণা দিলে তিনি এরঘোর বিরোধিতা করেন। সে বছরই তিনি ছায়ানটের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন, গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ইতিপূর্বে প্রদত্ত তমঘা-ই-ইমতিয়াজ পদক বর্জন করেন। ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন।
১৯৭১ সালে সপরিবারে পাকিস্তান সরকারের নজরবন্দি থাকাসত্বেও তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সহোযোগিতা করেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধি আন্দলনেও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তার।
সুফিয়া কামাল ৫০টির বেশি পুরস্কার লাভ করেছেন। উল্লেখযোগ্য হলো— পাকিস্তান সরকারের তমঘা-ই-ইমতিয়াজ (১৯৬১) (প্রত্যাখান করেন ১৯৬৯), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬২), সোভিয়েত লেনিন পদক (১৯৭০), একুশে পদক (১৯৭৬), নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৭৭), সংগ্রামী নারী পুরস্কার, চেকোশ্লোভাকিয়া (১৯৮১), মুক্তধারা পুরস্কার (১৯৮২), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬), জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার (১৯৯৫), দেশবন্ধু সি আর দাস গোল্ড মেডেল (১৯৯৬), স্বাধীনতা দিবস পদক (১৯৯৭)

সারা জীবন সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। বাংলার নারী সমাজের আজকের এতটুকু অগ্রগতির পেছনে বেগম রোকেয়া যেমন এক অবিস্মরণীয় নাম পাশাপাশি সুফিয়া কামালের অবদানও অনস্বীকার্য।
নুসরাত জাহান : লেখক ও সংগঠক, কুড়িগ্রাম।
খুব সুন্দর হয়েছে নুসরাত
ধন্যবাদ দাদা