ব্যক্তিত্ব

‘দস্যু বনহুর’ সিরিজের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক রোমেনা আফাজের মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা..

আবু সাঈদ 2 years ago

‘দস্যু বনহুরের ভয়ে দেশবাসী প্রকম্পমান। পথে-ঘাটে-মাঠে শুধু ঐ এক কথা-দস্যু বনহুর–দস্যু বনহুর! কখন যে কোথায় কার ওপর হানা দিয়ে বসবে কে জানে!

ধনীরা তো সব সময় আশঙ্কা নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। তাদের ভয়ই বেশি। দস্যু বনহুরের জন্য কারও মনে শান্তি নেই। দস্যু বনহুর যে কে, কেমন তার আসল রূপ, তা কেউ জানে না। কোথা থেকে আসে সে, কোথায় চলে যায়, তাও কেউ বুঝতে পারে না। গভীর রাতে জমকালো একটা অশ্বপৃষ্ঠে দেখা যায় তাকে। গোটা শরীরে তার কালো পোশাক। মাথায় কালো কাপড়ের পাগড়ি। মুখে একটা কালো রুমাল জড়ানো। কোমরের বেল্টে গুলিভরা রিভালবার। বিশেষতঃ অন্ধকার রাতেই বনহুর হানা দেয়। শহরে-বন্দরে, গ্রামে, পথে-ঘাটে-মাঠে সব জায়গায় হয় তার আবির্ভাব।’

লেখার অংশটুকু দস্যু বনহুর সিরিজের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক রোমেনা আফাজের প্রথম দস্যু উপন্যাস সিরিজের দস্যু বনহুর উপন্যাস থেকে। সেই প্রখ্যাত গোয়েন্দা ও রহস্য সিরিজের লেখক রোমেনা আফাজের মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তাঁকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

তিনি ১৯২৬ সালে ২৭ ডিসেম্বর বগুড়ার শেরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাড়ি ছিল বগুড়া জেলার জলেশ্বরীতলায়, যা বর্তমানে স্মৃতি জাদুঘর। তাঁর পিতার নাম কাজেম উদ্‌দীন আহম্মদ এবং মায়ের নাম বেগম আছিয়া খাতুন। বগুড়ার ফুলকোট গ্রামের ডাক্তার মোঃ আফাজ উল্লাহ সরকারের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। লেখালেখি শুরু করেন খুব অল্প বয়সে। তখন সবে মাত্র ৯ বছর। লিখে ফেলেন চাষী নামে একটি ছড়া। যা সেই সময়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হত মাসিক মোহাম্মাদী পত্রিকায়।

সেই লেখালেখি শুরু পর থেকে আর থেমে থাকেন নি। লিখে ফেলেন ছোটগল্প, কবিতা, কিশোর উপন্যাস, জনপ্রিয় গোয়েন্দা ও রহস্য সিরিজ মিলে ২৫০টি উপর বই। তুমুল জনপ্রিয়তা পায় রহস্য সিরিজ ‘দস্যু বনহুর’।তাঁর সৃষ্ট এই দস্যু ‘বনহুর’ চরিত্রের জন্যেই বিখ্যাত হয়ে ওঠেন।

তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মগুলো হলো— উপন্যাস: দেশের মেয়ে (১৯৬২), সোনালী সন্ধ্যা (১৯৬৪),হারানো মানিক (১৯৬৮), কাগজের নৌকা (১৯৬৫), কুন্তিবাঈ (১৯৬৬), জানি তুমি আসবে (১৯৬৬),শেষ মিলন (১৯৬৬), প্রিয়ার কণ্ঠস্বর (১৯৬৭),আলেয়ার আলো (১৯৬৭), সাগর সৈকত (১৯৬৭),অভিশপ্ত (১৯৬৮), লেখকের স্বপ্ন (১৯৬৮), নিয়তির চক্র (১৯৬৮), আলোক রশ্মি (১৯৬৯), ভোরের সূর্য (১৯৬৯), রুপালি পর্দা (১৯৭০), নীল আকাশ (১৯৭১), উত্তাল তরঙ্গ (১৯৭৬),মায়ার সংসার, কুমারী বধু, ঘূর্ণি হাওয়া, অভিশপ্ত জীবন, হূসনা, পরশমনি, বাসর রাতের স্বপ্ন, মাটির মানুষ, অনির্বাণ, পদ্ম কন্যা, স্বপ্ন সাধনা, মা ও মাটি, পারুল, প্রায়শ্চিত, মা ও মেয়ে, স্মৃতিরেখা, স্বয়ংবরা, আত্মহূতি, বিবর্তিত বসুন্ধরা, দুলালী, পাহাড়ী মেয়ে, লাইট পোষ্ট, বিদগ্ধা জননী, দুটি চোখ, ঝরা পাতা, খেয়াঘাট, ধূসর পৃথিবী, বড় ভাবি, বাশসী, ভুলের শেষে, পরিণতি, অভিসারিকা, সূর্যাস্তু, মধুর পরিচয়, হীরক খণ্ড, ফাঁসির মঞ্চে, বিষাক্ত তীর, প্রতিচ্ছবি, মধু, মিলন, বধূ। কিশোর উপন্যাস : মান্দি গড়ের বাড়ি, দস্যুরানী সিরিজ (১২টি), দস্যু বনহুর সিরিজ (১৩২ টি)।

রোমেনা আফাজের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয় ৬টি চলচ্চিত্র। সেই চলচ্চিত্রগুলো বেশ জনপ্রিয়। চলচ্চিত্রগুলো হলো— কাগজের নৌকা, মোমের আলো, মায়ার সংসার, মধুমিতা, মাটির মানুষ ও দস্যু বনহুর৷

বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য দেওয়া হয় স্বাধীনতা পুরস্কার।

তিনি শুধু লেখালেখিতেই মগ্ন থাকেনি,ছিলেন একজন সক্রিয় সমাজ সেবক।৩৭টি সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। তারমধ্যে জাতীয় মহিলা সংস্থা, বগুড়ার সাবেক চেয়ারম্যান; ঠেংগামারা মহিলা সবুজ সংঘ, বগুড়ার আজীবন উপদেষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা পৃষ্ঠপোষক; বাংলাদেশ মহিলা জাতীয় ক্রীড়া সংস্থা, বগুড়ার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান; উদীচী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, বগুড়ার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান; বাংলাদেশ রেডক্রস সমিতি, বগুড়ার সাবেক সদস্য; শিশু একাডেমী, বগুড়ার সাবেক উপদেষ্টা; বাংলাদেশ রাইটার্স ফোরাম, বগুড়ার সাবেক উপদেষ্টা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য৷

আমরা দিন দিনে এই জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক, সমাজসেবক মানুষটিকে কতটুকু মনে রেখেছি। ১৯৬৬ সালে লন্ডনের অ্যায়ার হোম (Our Home) পত্রিকা তাঁর ডিটেকটিভ উপন্যাসের রিভিউ করতে গিয়ে, লন্ডনের প্রখ্যাত লেখিকা আগাথা ক্রিস্টি সঙ্গে তুলনা করে নিম্নোক্ত মন্তব্যটি করেছেন—
‘Begum Romena Afaz is a young rising Pakistani authorize. There is a number of books to her credit the one which is already published is one of the series of detective novels. It is called RAKTE-ANKA MAPÕ (Blood drawn map)It seems that she will soon be recognized as one of the most successful novel writers of Pakistan. She may, One day, be known as Agatha Christee of East Pakistan.’

বাংলা সাহিত্যের অসামান্য অবদানের জন্য তাঁকে ২০১০ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়। এছাড়া পেয়েছে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। নারী বিকাশ সংস্থা, বগুড়া বেগম রোকেয়া স্বর্ণপদক -২০০০; বাংলাদেশ রাইটার্স ফোরাম, বগুড়া ২১শে পদক (সাহিত্য)(২০০৩); গণউন্নয়ন গ্রন্থাগার (সি,ডি,এল) নারী ফোরাম থেকে নারী মুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূত সম্মাননা পদক, ২০০৬ (মরণোত্তর) উল্লেখযোগ্য৷

বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় এই গোয়েন্দা লেখকের ৯ সন্তান।এরমধ্যে সাত ছেলে ও দুই মেয়ে। তাঁর হলেন— অধ্যাপক মতিউর রহমান, মোখলেছুর রহমান (কানাডা প্রবাসী), মাহবুবুর রহমান (আমেরিকা প্রবাসী), মাজেদুর রহমান তাজু, মাহফুজ-উর রহমান দুলু (কানাডা প্রবাসী), মোস্তাফিজুর রহমান নিলু, মোন্তেজুর রহমান আঞ্জু এবং দুই কন্যা হেলেনা বেগম হেনা, সেলিনা বেগম স্বপ্না।

২০০৩ সালের ১২ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

আবু সাঈদ : কবি, গবেষক ও সংগঠক