শ্রদ্ধাঞ্জলি কবি ইন্দু সাহা

কবি ইন্দু সাহা। ছবি : সংগৃহীত
কবি, নাট্যকার, সাহিত্যিক, গীতিকার ইন্দু সাহা। তিনি ১৯৪৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ (তৎকালীন পাবনা) শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ২নং খলিফাপট্টির সংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে উঠা তাঁর। চারণ কবি মুকুন্দ দাসের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল কবির পরিবারে৷ মুকুন্দ দাস কবির পারিবারিক মঞ্চ থেকে দেশপ্রেমকে উজ্জীবিত করতে কাজ করে গেছেন টানা ১০ বছর। সঙ্গত কারণেই ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিলেন। ছাত্রাবস্থাতেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা লেখালেখির কারণে তিনি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। কিশোর উপন্যাস ‘ঘরকন্না’। এটি প্রকাশের পর ব্যাপক সমাদৃত হয়। ১৯৬৩ সালে রচনা করেন নাটক ‘বেকার নিকেতন’। সেটি পূর্ব পাকিস্তানের সাংবাদিক সম্মেলনে মঞ্চস্থ করা হয়। ওই সময়ে সিরাজগঞ্জ থেকে ‘সাপ্তাহিক সমযুগ’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। সঙ্গে ছিলেন সাইফুল ইসলাম ও আসকারুল হক।
তিনি মাত্র ২২ বছর বয়সে উপন্যাস ‘পলাশ কামিনী’ লিখে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়।
১৯৬৪ সালে ৬নং নারিন্দা লেন ঢাকা থেকে প্রকাশিত সে সময়ের প্রগতিশীল মাসিক সাহিত্য পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯৬৬ সালে ‘পাকিস্তান বাই উইকলি’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এরপরে ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘উন্মেষ সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ’ এবং ‘নাট্যফৌজ’ নামে দুটি সংগঠন। সে সময়ে কলকাতার প্রথম শ্রেণির সংবাদপত্র ‘দৈনিক বর্তমান’ এ দীর্ঘদিন সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের মুখপাত্র ‘গণশক্তি’র সম্পাদনা কাজে নিযুক্ত থাকা অবস্থায় কবিকে ১৯৬৮ সালে গ্রেপ্তার করা হয়৷ গণ আন্দোলনের অভিযোগ এনে তাঁকে শারীরিক টর্চার করা হয়৷ কিন্তু ততদিনে কবির আপ্রাণ চেষ্টায় বার্তা এবং কবিখ্যাতি পৌঁছে গেছে শহর ছাড়িয়ে প্রান্তিক গ্রামে। ‘পলাতক’ উপন্যাস থেকে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। তাঁর কবিতা এবং লেখনী সংগ্রামে উদ্দীপ্ত কবিসত্তাকে চিনিয়ে দিয়েছিল দেশবাসী। ‘ঝড় আসছে’ নামের প্রথম কাব্যগ্রন্থ সত্যিই ঝড় এনেছিল বাঙালি পাঠকদের কাছে।
বামপন্থী ঘরানার এই কবি লিখেছেন সাড়ে তিন হাজার গান। তাঁর লেখাগুলো বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে অবিস্মরণীয় অবদান রাখে। তাঁর নামে চলত মুক্তিযোদ্ধাদের সাংকেতিক ভাষা। গল্প, নাটক, প্রবন্ধ, ছড়া, গান সব মিলে রচনা করেছেন এক শিল্প সম্ভার।
তাঁর রচিত প্রায় ১৫০টি গ্রন্থের মধ্যে চতুর্দশপদী কবিতা, পাপপঙ্কিল, গোপনপুরের উপকথা, রূপময় রক্তপাত, কলঙ্কতিলক, বেলা অবেলের কেত্তন, ক্রোধ, সনেট সমগ্র, শ্রেষ্ঠ কবিতা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও গানের পাশাপাশি লিখেছেন ছোটদের জন্যও।
সাংস্কৃতিক পরিবারে জন্ম নিয়ে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন মন ও মননের ঐশ্বর্য। সাহিত্যের ভুবনে রয়েছে তাঁর বিপুল অবগাহন। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে জড়িয়ে পড়েন নানান সংগ্রামে। তাঁর লেখা ফুটে ওঠেছে সাম্যবাদ, শ্রেণিসংগ্রাম, মানবিকতার কথা।জীবনের নানাবিধ অভিজ্ঞতা, গূঢ় দর্শন, প্রেম-প্রকৃতি-ভালোবাসার সহজিয়া অনুরাগ এক আশ্চর্য অভিজ্ঞান হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতায়।
মুক্তিযুদ্ধকালে সাম্যবাদী গেরিলা যোদ্ধারা শত্রুর বিরুদ্ধে বুলেট ছুঁড়েছেন তাঁর গান গেয়ে। তাঁর সাম্প্রতিক নাটক ‘তিস্তাপারের কিসসা’ মঞ্চস্থ করা হচ্ছে।
“তুমি দেশের হৃদয় ছোঁয়া মাটি
তোমার চুলে পরাই দোপাটী।”
ব্যক্তি জীবনের ইন্দু সাহা ছিলেন খুব নিঃস্ব প্রকৃতির মানুষ। দেশের মাটিতে এই একাভাবে জীবনধারণ করতে না পেরে চলে গেলেন কলকাতায়। ২০১০ সালে দেশে ফিরে এলেন। কিন্তু তাঁর একাকীত্ব ও মানসিক স্বস্তিবোধ মিলে নি। দেশ অথবা কোলকাতা—কোথাও তাঁর কাজের উপযুক্ত স্বীকৃতি প্রকাশিত হয়ে উঠে নি। সম্প্রতি করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই তিনি দেশ ছেড়ে কলকাতা চলে যান আবার। সেখানেই গত ১৫ মে পরলোকগমন করেন তিনি। আমৃত্যু সংগ্রামী এই মানুষটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম বেঁচে থাকবেন। তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
কবির প্রতি শ্রদ্ধা। সুন্দর লেখার জন্য লেখককে সাধুবা।
চমৎকার ও প্রশংসনীয়। লেখক ও লেখায় সমৃদ্ধ হোক ‘বইচারিতা’।