মায়ের গয়নার বাক্স, পর্ব-৮

—-মামী, আমি ঢাকা যেতে চাচ্ছি। কলেজে ভর্তি হতে চাই, সেই ব্যাপারে একটু খোঁজ করে আসব ভাবছি।
রাহেলা বারান্দার ইজি চেয়ারে চোখ বন্ধ করে আধশোয়া হয়ে ছিল। আগুন্তকের কথাতে এবারে চোখ মেলল। ওর বুকের ওপর একটা বই। সেটার ওপর রেখে দেওয়া বইয়ের ওপরে রাখা চশমাটা চোখে এঁটে নেয় আর বইটা পাচার করে দেয় পাশের ছোট টেবিলটার ওপরে।
“বেশ তো যাবে। তা কবে ইচ্ছে আছে যাবার?” ঠাণ্ডা নিস্পৃহ গলার প্রত্ত্যুত্তর শোনা গেল এবার।
— জ্বী…সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী পরশু সকালে। ধীরে উত্তর করে সিরাজ।
“হুম।” সিরাজ দাঁড়িয়ে থাকে। সেখান থেকে সরে যায় না।
“কিছু বলবে আর?” রাহেলা প্রশ্ন করে সিরাজকে। আর তাতে যেন সিরাজ খুব সংকুচিত হয়ে যায়।
— জ্বী মামী। বেয়াদবি নেবেন না। যাওয়া আসার জন্য কিছু খরচা পাতি লাগবে। তাই…
—বেশ তো, হিসেব তো সব তুমিই দেখাশোনা কর। ওখান থেকে প্রয়োজনমত নিয়ে হিসেবের খাতায় টুকে রেখ।
“জ্বী। ইয়ে মামী…” ইতঃস্তত করতে থাকে সিরাজ।
—আরও কিছু বলবে?
—মানে বলছিলাম, কত নিব তা যদি একটু বলতেন?
হিমশীতল চোখের দৃষ্টি ঘুরে যায় সিরাজের দিকে, ‘ সিরাজ, আমার মনে হয় আমার সাথে তোমার প্রয়োজনীয় কথা শেষ হয়েছে। এবার তুমি আসতে পার। সাবধানে থেক। শীতল দৃষ্টি পাশ বদল করে নেয়।
“জ্বী!” মৃদু স্বরে উত্তর করে সিরাজ দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়। ছেলেটা বড় ভয় পায় রাহেলাকে। কিন্তু রাহেলা কখনও ওকে বকেনি পর্যন্ত। তাহলে কিসের এত ভীতি ওর কে জানে? রাহেলা ভাবতে ভাবতে দৃষ্টি সামনের দিকে প্রসাারিত করে নেয়। সামনের উঠোনে বড় বড় ঝুমকো জবা ফুটেছে। শীত আসি আসি ভাব এখন। বিকেলের এ সময়টা বড় স্নিগ্ধ লাগে চারপাশটা। কেমন না রোদ, না ছায়া। একটা আলোছায়ার লুকোচুরি। এক চড়ুই পাখি কলা গাছের গোড়ায় মাটিতে গড়াগড়ি করে স্নান সারছে। কি সুন্দর দৃশ্য! শেষ বিকেলের এক ফালি নরম রোদ গেটের সামনে খেলা করছে। গাঁদা ফুলের গাছগুলো ফুলের ভারে মাটিতে নুঁইয়ে পড়ছে। আচমকা একটা মৃদু বাতাস রাহেলার কান স্পর্শ করে যায়। চোখ বুঁজে ফেলে ও। আর খুব স্পষ্টভাবে কানে ভেসে আসে একটা ভরাট কন্ঠস্বর— গাঁদা ফুল তোমার খোপায় গুঁজলে এর মোহনীয়তা যেন অসীম সৌন্দর্য্যকে ছুঁয়ে যায়। সত্যি, রাহেলা৷
“জ্বী!” মৃদু স্বরে উত্তর করে সিরাজ দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়। ছেলেটা বড় ভয় পায় রাহেলাকে। কিন্তু রাহেলা কখনও ওকে বকেনি পর্যন্ত। তাহলে কিসের এত ভীতি ওর কে জানে? রাহেলা ভাবতে ভাবতে দৃষ্টি সামনের দিকে প্রসাারিত করে নেয়। সামনের উঠোনে বড় বড় ঝুমকো জবা ফুটেছে। শীত আসি আসি ভাব এখন। বিকেলের এ সময়টা বড় স্নিগ্ধ লাগে চারপাশটা। কেমন না রোদ, না ছায়া। একটা আলোছায়ার লুকোচুরি।
এত জীবন্ত কন্ঠস্বর! রাহেলা চোখ খুলে ধীরে। নাহ, কেউ নেই কোথাও। থাকবেও না কোনোদিন। দৃষ্টির নাগালে সে ইয়াসিরকে কখনই পায় না। কিন্তু রাহেলার হৃদয়ে সে সদাজাগ্রত, অম্লান, অমর এক সত্ত্বা। হঠাৎ রাহেলার গম্ভীর মুখে হাল্কা একটা হাসির রেখ ফুটে উঠে আবার তা মিলিয়ে যায় অচিরেই। খানিক চিন্তিত হয় ও। সিরাজ ছেলেটা চলে গেলে হিসাব কিতাব রাখা একটু মুশকিলই হয়ে যাবে। ও থাকা অবস্থাতেই দক্ষ একজনকে খুঁজতে হবে। গণিত মাস্টার নির্মল বাবুকে বলতে হবে বিশ্বস্ত কাউকে খোঁজ করে দিতে। নির্মল বাবুর কথা ধরে মনে হলো, স্কুলের হেডমাস্টার সেদিন বলছিলেন আসছে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে স্কুল মাঠে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আর সাংস্কৃতিক উৎসব আর শহীদদের স্মরণে এক স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ব্যাপারে আবার কিছু ফান্ডিং চেয়েছে তারা। পাশাপাশি খুব করে অনুরোধ করেছে, একজন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার সহধর্মিনী হিসেবে রাহেলাকে সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন গ্রহণ করতে। প্রতিবারই বলে রাহেলা রাজি হয় না। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে, অনুরোধটা রক্ষা করতেই হবে। হঠাৎ রাহেলার চোখ গেটে নিবদ্ধ হলো। আয়ান ঢুকছে। সারা শরীরে ময়লা কাপড়। চুল উস্কোখুস্কো। কাঁধের স্কুল ব্যাগের চেইন হাট করে খোলা, অযত্নে রেখে দেওয়া বই খাতাগুলো উঁকি মারছে সেখান থেকে। কি ব্যাপার, ও কি স্কুল থেকে অন্য কোথাও গিয়েছিল নাকি? মাস্টারদের হাজারো অভিযোগ আয়ানকে নিয়ে। কেন জানি সেসব নিয়ে রাহেলা তেমন আলোড়িত হয় না। আচম্বিত সেদিনের খাওয়ার টেবিলে আয়ানের সেই প্রশ্নের কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়তেই মনটাতে আবার অস্বস্তি তৈরি হয়। আয়ান শীষ বাজাতে বাজাতে আসছে। রাহেলা খুব বিরক্ত হয়। শিষ বাজানো তার খুবই অপছন্দের একটা জিনিষ। আয়ান গেটে ঢুকেই গোলাপ গাছ থেকে গোটা দু গোলাপ ছিঁড়ে নেয়। এরপর মাটি থেকে নুড়ি পাথর কুড়িয়ে পাশে শুয়ে থাকা হুলোটার গায়ে ঢিল মারে। ” মি..য়া…ও” বলে হুলোটা লাফ দিয়ে উঠে তিন লাফ প্রাচীর টপকে অদৃশ্য হয়ে যায়। আয়ান হাসতে থাকে। আয়ানের হাসি কেমন অস্বস্তিকর লাগে রাহেলার। মনে হয়, হাসির শব্দে ওর মাথার রগ গুলি ফেটে যাবে। রাহেলা তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে যায়।
সারা শরীরে ময়লা কাপড়। চুল উস্কোখুস্কো। কাঁধের স্কুল ব্যাগের চেইন হাট করে খোলা, অযত্নে রেখে দেওয়া বই খাতাগুলো উঁকি মারছে সেখান থেকে। কি ব্যাপার, ও কি স্কুল থেকে অন্য কোথাও গিয়েছিল নাকি? মাস্টারদের হাজারো অভিযোগ আয়ানকে নিয়ে। কেন জানি সেসব নিয়ে রাহেলা তেমন আলোড়িত হয় না
রুমে এসে সিরাজ তার ব্যাগ গোছানো শুরু করে। ব্যাগ বলতে ওর গুটি কয়েক জামা পাজামা আর পাঞ্জাবি। ক্যাশবাক্স থেকে প্রয়োজন মত কিছু টাকা আলাদা করে নেয় এবার। এরপর লাল আর প্রিন্ট কাপড়ে মোড়ানো দুটি সরু লম্বা খাতা বের করে কলম নিয়ে লিখতে বসে। দুটোই হিসেবের খাতা। একটা জমা খাতা আরেকটা খরচের খাতা। সুন্দর করে তারিখ অনুযায়ী সব সাজিয়ে লিখা আছে খাতাতে। খুব সুন্দর হাতের লিখা সিরাজের। গোটা গোটা একদম বইয়ের ছাপা অক্ষরের মত। হিসাব লিখতে বসে একটু আনমনা হয়ে যায় সিরাজ।অতীতের সাদাকালো কিছু খন্ড চিত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বড় কঠিন আর বেদনাবিজরিত ছেলেবেলা ওর। খোলা মাঠে ফুটবলের পিছনে দৌঁড়ে চলা, আকাশের বুকে ঘুড়ি উড়ানো, দলবেধে পুকুরের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে গোসল করা, লুঙ্গির কোচড় ভরে ছোটমাছ ধরা এসব কিছুরই উপস্থিতি নেই ওর বাল্যস্মৃতিতে। আছে শুধু জীবন যুদ্ধে জীবন বাঁচানোর জন্য দৌড়ে চলার লড়াই।ওর ছেলেবেলা মানে রক্ত, হাহাকার, চিৎকার, আগুন, নিষ্ঠুরতা। ওর ছেলেবেলা মানে, মৃত্যুকে দু’হাত দুরত্ব থেকে চিনে নেওয়া। ওর ছেলেবেলা মানে ৭১। নিঃশ্বাস ফেলে সিরাজ।যুদ্ধের সময় ও তখন ছোট আট নয় বছর হবে, তখন ওর। সেদিন যেন আজও মাঝে মাঝে ওর সামনে তাজা হয়ে উঠে। হানাদাররা ওদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। মা-বাবা দুজনকেই গুলি করে হত্যা করে। এসব স্মৃতি মনে করে কেমন যেন লাগে ওর। বাড়ির পেছনের জঙ্গল থেকে লুকিয়ে সব দেখছিল সিরাজ। হানাদাররা কেমন বাবাকে পিছমোড়া করে বেধে ফেলল। হাঁটু গাড়িয়ে বসিয়ে দিল সামনে। একজন লাথি মেরে বাবাকে ফেলে দেয় আর এলোপাথারি লাথি মারতে থাকে গায়ে। মা খুব কাঁন্না করছিল দৌঁড়ে বাবার কাছে যেতে চাইলে ওদের মাঝে একজন মাকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুলতে যায়। রাগে অন্ধ হয়ে মা কামড় বসিয়ে দেয় ঐ মিলিটারির হাতে। ক্রুদ্ধ সেনা তখন গুলিতে মা কে ঝাঁঝড়া করে দেয় এরপর বাবাকে। কেউ মুখে কোন আওয়াজ করার ফুরসত টুকু পেল না। এরপর বাড়িতে ওরা আগুন ধরিয়ে দিয়ে লাশ দুটিকে সেই আগুনে নিক্ষেপ করে। এরপর হাসতে হাসতে ওরা জীপ নিয়ে বেড়িয়ে যায়। আজ বহুদিন পর আবারো সেই আগুনে পুড়তে থাকা হাড়ের মটমট শব্দ সিরাজের কানে বেজে উঠে। শিউরে ওঠে সিরাজ। সেইদিনের পর থেকে শুরু, ওর রাস্তায় রাস্তায় ছন্নছাড়া জীবনের। এসবের মাঝে একদিন ফকরুল নানার সাথে পরিচয়। উনি সিরাজকে বুকে টেনে নেন। সেই সময় উনি নিজেই নিঃস্ব ছিলেন। তখন ওনার আপন বলতে যে কেউ ছিল সিরাজ তা জানতই না। দেশ স্বাধীন হলে একদিন নানা ওকে একা এ বাড়িতে রেখে কোথায় যেন গেলেন। আসবার সময় সাথে নিয়ে এলেন এই মামীকে। তখন মামী এমন…
—সিরাজ ভাই, চল একটু বাইরে যাই। তুমি নাকি পরশু ঢাকা যাচ্ছ?
সিরাজের চিন্তা থেমে যায়। আয়ান সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
‘এই তো, তুমি যাও আসছি।’ হাসি দিয়ে বলে সিরাজ। মাগরিবের নামাজ আদায় শেষে আয়ান আর সিরাজ গায়ের মেঠোপথ ধরে হাটছে। বাতাসে শীত শীত ভাব। গ্রামাঞ্চলে তাই সন্ধ্যা থেকে একটু হাল্কা একটু শিশির পড়ে। সিরাজ গায়ের পাতলা চাদরটা ভালভাবে টেনে নেয়।
— সিরাজ ভাই, তুমি কি একেবারে চলে যাচ্ছ, আর আসবে না?
আয়ানের প্রশ্নে সিরাজ হেসে ফেলে বলে, ‘তা কেন? অবশ্যই আসব।’
আয়ান একটু স্বস্তি পায় কথাটাতে। ফের দুজন চুপচাপ হাটতে থাকে। হঠাৎ আয়ান বলে ওঠে, ‘আচ্ছা সিরাজ ভাই, তুমি কি মা সম্পর্কে কিছু জান?’
সিরাজ প্রচণ্ড থতমত খেয়ে বলে, ” না তো! কী জানব?” কিন্তু ওর মনে কিছু বিক্ষিপ্ত খাপ ছাড়া চিত্র ভেসে ওঠে। তবে দৃশ্যপট এক সুঁতোয় এ পর্যন্ত ও কখনই মেলাতে পারে না। মনে হয়, কোনোদিন পারবেও না। গাঁয়ের মেঠোপথে ওদের পায়ের ছাপ আঁকতে আঁকতে চুপচাপ ওরা দুজন এগিয়ে যায় সম্মুখে। নিকষ সাঁঝের আঁধারের ঢেউ সাঁতরে খালি শোনা যায়, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক।
(চলবে)
আারও পড়ুন:
মায়ের গয়নার বাক্স, পর্ব–১
মায়ের গয়নার বাক্স, পর্ব–২
মায়ের গয়নার বাক্স, পর্ব–৩
মায়ের গয়নার বাক্স, পর্ব-৪
মায়ের গয়নার বাক্স, পর্ব–৫
মায়ের গয়নার বাক্স, পর্ব-৬
মায়ের গয়নার বাক্স, পর্ব-৭