বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১৬

নিধি এই একটু আগে ইচ্ছেমতো গালমন্দ করেছে পিন্টুকে।
সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে পিন্টু সত্যিই জ্বরে ভুগছে। ছোট বোন স্বর্ণার কলেজ বন্ধ। সে প্রয়োজন মতো সেবা দিয়ে যাচ্ছে। মাও ছেলের দেখাশুনা করছে। ক’দিন ধরে ছেলেকে নরম খাবার দিচ্ছে। এই ছেলের উপরই পুরো সংসার।
স্বর্ণা থার্মোমিটার এনে ভাইর তাপমাত্রা মেপে দেখলো ১০২ ডিগ্রি। বলল,‘মাথায় আবার পানি দেবো ভাই ?’
‘না, পানি বেশি দিলে ঠাণ্ডা লাগতে পারে। কপালে জলপট্টি দে।’ পিন্টু বলল।
স্বর্ণা একটা রুমাল ভিজিয়ে কয়েক ভাঁজ করে ভাইর কপালে রাখল। পিন্টুর আরাম বোধ হচ্ছে। কিছুক্ষণ নীরবতার পর স্বর্ণা বলল,‘ভাই একটা কথা বলি ?’
‘হ্যাঁ বল।’
‘নিধি আপাকে তো দেখলাম। স্লিম ফিগার। ফর্সা না হলেও কালো না। চলাফেরা, কথাবার্তায় একটা ব্যক্তিত্ব আছে।’
‘আচ্ছা ! এখন আসল কথা বলে ফেল।’
‘তুমি না ওনাকে বিয়ে করবে ? দেরি করছো কেন ?’
‘শোন, বিয়ে-শাদি সব আল্লাহর ইচ্ছা। মানুষ চাইলেই হয় না।’
‘তোমরা চাও তো ?’
পিন্টু কোনো জবাব দিল না। কেবল পাশ ফিরে শু’লো। তারপর বলল,‘সুপের প্যাকেট কি সব শেষ ?’
‘কর্নের প্যাকেট শেষ। থাই একটা আছে।’
‘থাই সুপ এক কাপ করে নিয়ে আয়। যা।’
স্বর্ণা তো খুকি নয়। সে বুঝতে পেরেছে ভাই এড়িয়ে গেছে। কিন্তু কেন ? নিধি কতগুলো টাকা দিয়ে হেল্প করল মা’র এনজিওপ্লাস্টির সময়ে। মনটা তো ভালো, পরোপকারী। ক’জন আছে যে ঝটপট দু’লাখ টাকা নিয়ে আসে !
ইন্সপেক্টর জিলানী এখন অফিসরুমে। তাঁর সহযোগীকে বলে উঠলেন,‘কী সব শুরু হলো ! খসরু গা ঢাকা দিয়ে আছে। এখন মোচনকেও তোমরা পাচ্ছো না ?’
‘স্যার সম্ভাব্য সব জায়গায় সন্ধান করলাম, পেলাম না।’
‘ওর গ্রামের বাড়িতে খোঁজ করেছো ?’
‘না স্যার। ওটাই বাকি।’
‘গ্রামের বাড়িতে সোর্স লাগাও। এজেন্ট পাঠাও। আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতেও খোঁজ নিতে হবে। মোচনের বক্তব্য এখন আমাদের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। যেমন গুরুত্বপূর্ণ খসরুর বক্তব্য।’
‘ঠিক স্যার। আমি সব ব্যবস্হা নিচ্ছি।’ সে জিলানীর রুম থেকে চলে গেল।
অফিস সহায়ক দিদার ভেতরে এসে বলল,‘স্যার, সকাল থেকে তো চা খান নি ! এক কাপ এনে দেবো ?’
জিলানী ভাবলেন, তাই তো ! বারোটা বেজে গেছে অথচ চা খাচ্ছি না ! সে জন্যই কি মাথাটা কাজ করছে না ! দিদার তো দেখি ভালোই বোঝে !
‘হ্যাঁ, নিয়ে এসো জলদি।’ জিলানী গম্ভীর গলায় বললেন। হঠাৎ মনে পড়লো, তাকে এক্ষুনি পুলিশ প্লাজায় যেতে হবে। সেখানে এক ইম্পর্টেন্ট সোর্সের সাথে দেখা করবেন।
জিলানী ঢকঢক করে চা গিলেই দিদারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ড্রাইভার কোথায় ?’
‘জীপে স্যার।’
জিলানী উঠলেন। নিচে নামলেন। দেখেন ড্রাইভার জীপ নিয়ে রেডি।
‘পুলিশ প্লাজায় যাও। হাতির ঝিল হয়ে।’ ইন্সপেক্টর জিলানী বললেন।
‘জী স্যার’ বলেই ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিল।
গাড়িতে জিলানী একা। সিগারেট ফুঁকছেন। গাড়ি হাতির ঝিলে ঢুকে এগুচ্ছে। সাথে ছুটছে আরও জীপ, কার, সার্কুলার বাস, মোটরবাইক, অটোরিক্সা। রাস্তাগুলো বেশ সুন্দর, মসৃণ। এসময় জ্যাম নেই। দুই রাস্তার মাঝখানের সড়কদ্বীপে চমৎকার বৃক্ষের সারি ! রাস্তার পাশে বেশ সুন্দর ফুটপাথ। অনেক জায়গায় ফুটপাথের পাশ দিয়ে বড় বড় বৃক্ষরাজি। শান্ত-স্নিগ্ধ ও মনোরম পরিবেশ। রাস্তার পাশে ঝিল। এই ঝিলটার নামই হাতির ঝিল। ঝিলের বুকের ওপর নির্মিত হয়েছে প্রশংসনীয় নকশার বেশ কয়েকটি সেতু। সেতুগুলো প্রকৃতই হাতির ঝিলের শোভা বর্ধন করেছে।
পুলিশ প্লাজায় ইন্সপেক্টর জিলানীর সোর্সের সাথে সাক্ষাত হলো। ফুডকোর্টে বসে কফি খেতে খেতে দরকারি আলাপ হলো। ফেরার পথে একটা কল এলো। তাঁর এক সহযোগীর। জিলানী কল রিসিভ করলেন।
‘কী খবর ?’
‘স্যার রুস্তম জানালো, ড্রাইভার পিন্টু কয়েকদিন ধরে ও বাড়িতে আসছে না। সে সন্দেহ করছে পিন্টু মোচনকে কোথাও লুকিয়ে থাকতে বলেছে।’
‘পিন্টু এরকম কেন করবে ?’
‘হতে পারে সে সিঁড়ি দিয়ে পড়ে যাওয়ার কথাগুলো বানিয়ে বলেছে। মোচন সত্যিটা বললেই তো ধরা পড়ে যাবে !’
‘রুস্তমের মনে এ সন্দেহ হলো কেন ?’
‘স্যার সে পরদিনই পিন্টুকে দেখেছে মোচনের সাথে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আলাপ করতে।’
‘ওকে। তুমি এখনই পিন্টুর বাসায় যাও। নিশ্চিত হয়ে আমাকে জানাও।’
গাড়ি ছুটছে। সামনে একটি সাদা মাইক্রোবাস। পাশ দিয়ে যাচ্ছে একটি মোটরবাইক। জিলানী দেখেন মোটরবাইকের পেছনে একজন মহিলা বসে আছে। হাতে লেডিস ব্যাগ। দেখতে সুদর্শনা ও শিক্ষিতা মনে হচ্ছে। মোটরবাইকের চালক হয়তো তার স্বামী।
মাইক্রোবাসটা মোটরবাইকের কাছাকাছি যেই গেলো, অমনি মাইক্রোবাসের জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে মোটরবাইকে থাকা মহিলার ব্যাগ ধরে দিলো এক হ্যাচকা টান। মহিলা এমন ঝটকা খেলো যে আরেকটু হলেই মোটরবাইক থেকে নিচে পড়ে যেতো। মোটরবাইকটা থেমে গেলো। মহিলা ‘আমার ব্যাগ নিয়ে গেছে’ বলে দিলো এক চিৎকার !
মাইক্রোবাসটা মোটরবাইকের কাছাকাছি যেই গেলো, অমনি মাইক্রোবাসের জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে মোটরবাইকে থাকা মহিলার ব্যাগ ধরে দিলো এক হ্যাচকা টান। মহিলা এমন ঝটকা খেলো যে আরেকটু হলেই মোটরবাইক থেকে নিচে পড়ে যেতো। মোটরবাইকটা থেমে গেলো। মহিলা ‘আমার ব্যাগ নিয়ে গেছে’ বলে দিলো এক চিৎকার !
এ দৃশ্য দেখে ইন্সপেক্টর জিলানীর মেজাজ গেলো চড়ে। তিনি মোটরবাইকচালককে বললেন, ‘আপনারা আমাকে ফলো করুন।’ তারপর ড্রাইভারকে বললেন, ‘মাইক্রোবাসটাকে ধরো। ফাস্ট।’
জীপ চললো দ্রুতগতিতে। মাইক্রোবাসের প্রায় কাছাকাছি এসে পড়লো। এটা দেখে মাইক্রোটা স্পিড বাড়িয়ে দিলো। জিলানী ড্রাইভারকে বললেন, ‘আরও জোরে।’
হাতির ঝিলের বোটগুলো যেখান থেকে ছাড়ে তার বিপরীত দিকের সড়কে এলে জিলানীর জীপ সাদা মাইক্রোবাসকে কেটে সামনে গেলো। পথ আটকে ব্রেক করলো। জিলানী জীপ থেকে নেমে দাঁড়ালেন। মাইক্রো থেকেও দুই যুবক নামলো। একজন জিলানীকে বলল,‘এই মিয়া কী পাইছেন ? পথ আটকাইলেন ক্যান ?’
‘আগে ওই মহিলার ব্যাগটা দাও।’ জিলানী বললেন।
‘কোন্ ব্যাগ ? কী কইতাছেন ? যান, রাস্তা মাপেন।’
‘ব্যাগটা বের কর হারামজাদা !’ জিলানী চোয়াল শক্ত করে জোরগলায় বললেন।
যুবক দুইজনই ‘এই মিয়া চিনোছ আমগোরে !’ বলেই তেড়ে আসলো। জিলানী একজনকে সজোরে ঘুষি মেরে মাটিতে ফেলে দিলেন। এটা দেখে অপরজন পকেট থেকে একটা চাকু বের করে জিলানীর দিকে ধরলো। এবার জিলানী কোমর থেকে রিভলভার বের করে দুজনের দিকে তাক করলেন। ধমক দিয়ে বললেন, ‘ক্রিমিনালের বাচ্চা, এই মুহূর্তে যদি ব্যাগটা না দিস গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেবো। আমি সিআইডি ইন্সপেক্টর।’
ছিনতাইকারী দুজন এবার ভয় পেলো। একজন চোখ ইশারা করলে আরেকজন মাইক্রো থেকে ব্যাগটা নিয়ে এলো। জিলানীকে বলল, ‘আমরা চিনতে পারি নাই স্যার। এই নেন ব্যাগ।’ জিলানী ব্যাগটা নিয়ে বললেন, ‘খবরদার ! তোমরা এখান থেকে নড়বে না।’ এর মধ্যে সেই মোটরবাইকটিও চলে এলো মহিলাকে নিয়ে। জিলানী ব্যাগটা মহিলার হাতে দিয়ে বললেন,
‘এই নিন আপনার ব্যাগ।’
‘আপনি যা করলেন, এটা কোনদিন ভুলবেন না।’ মহিলা কৃতজ্ঞকন্ঠে বলল। সে তার ব্যাগের চেইন খুলে দেখলো, সব ঠিক আছে।
‘এটা আমার দায়িত্ব। আমি সিআইডি অফিসার।’ জিলানী বললেন।
‘ও, তাইতো বলি ! থ্যাংক ইউ স্যার। উনি আমার হাসবেন্ড।’ মহিলা মোটরবাইক চালককে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
ইন্সপেক্টর জিলানী রামপুরা থানার ওসিকে ফোন করে নিজের পরিচয় দিয়ে ঘটনাটা জানালেন। তারপর ফোর্স পাঠাতে বললেন। ইতোমধ্যে সেখানে বেশ লোক জড়ো হয়ে গেছে।
ছিনতাইকারীরা ক্ষমা চাইতে শুরু করলো। জিলানী অনড়, ওদের ছেড়ে দেওয়া যাবে না। হঠাৎ মাইক্রোবাসটা স্টার্ট দিয়ে ব্যাক করতে আরম্ভ করলো। ইন্সপেক্টর জিলানী রিভলভার দিয়ে গুলি করে মাইক্রোর সামনের চাকা বার্স্ট করে দিলেন। গুলির শব্দে ওরা আরও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো।
ইত্যবসরে সেখানে পুলিশভর্তি পিক-আপ এসে থামলো। তারা ক্রিমিনালদের ধরে গাড়িতে উঠালো। থানাকে বলা হলো রেকার পাঠিয়ে মাইক্রোবাসটাকে নিয়ে যেতে। মাইক্রোটাও ছিল চোরাই গাড়ি।
জিলানী জীপে উঠলেন। তখনই ফোন এলো তার সহযোগীর। জিলানীর টিমে দু’জন সহযোগী- একজন সোহরাব, অন্যজন রাইস।
‘স্যার আমি সোহরাব।’
‘তাতো বুঝতেই পারছি। যা বলবার ঝটপট বলো।
‘মোচনকে পেয়েছি স্যার।’
‘কোথায় ?’
‘ওর দাদার বাড়িতে।’
‘নিয়ে আসো।’
‘কোথায় আনবো স্যার ?’
‘কোথায় বোঝো না ? মাথাকে আরও উর্বর করো। আমার অফিসে।’
‘অ্যারেস্ট করবো স্যার ?’
‘আবার প্রশ্ন ! আমি কি বলেছি সেকথা ?’
সোহরাব একটু অবাক। মনে মনে বললো, ‘ব্যাপার কী ! বসের মেজাজ দেখি হেভি গরম !’
সে তো জানে না, তার বস জিলানী ইতোমধ্যে সত্যিকারের হিরোর ভূমিকা পালন করে ফেলেছে !
চলবে….
আরও পড়ুন :
বিধ্বংসী প্রহর,পর্ব-১
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ২
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ৩
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৪
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৫
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৬
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৭
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৮
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৯
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ১০
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১১
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১২
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১৩
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১৪
বিধ্বংসী প্রহর,পর্ব— ১৫