বিধ্বংসী প্রহর,পর্ব— ১৫

প্লান অব অ্যাকশনের নাট-বল্টুই যেন ঢিলেঢালা করে দিচ্ছে !
নতুন করে এ কী বললো পিন্টু ! রিফাতের সিঁড়ি দিয়ে পড়ে সে আহত হলো তখনই যখন তার জেরিন ম্যাডামকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবার কথা! ব্যাটা পড়ে যাবার আর সময় পেল না ! যে রিফাতের সাথে জেরিনদের শীতল সম্পর্ক সেই রিফাতই নিজের গাড়ি ড্রাইভ করে তাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিল!
রিফাতের কাজের ছেলে মোচনের বক্তব্য খুব গুরুত্বপূর্ণ এখন। ড্রাইভার পিন্টুর কথা মতে, মোচন তাকে নিকটবর্তী ফার্মেসিতে নিয়ে গিয়েছিল প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য।
রিফাত এবং নিধিকেও জিজ্ঞেস করতে হবে। এ দুজন যে পিচ্ছিল ! আগে পিন্টুর কথার সঙ্গে মোচনের বক্তব্যের সামঞ্জস্য পাওয়া যায় কিনা তা দেখে পরবর্তীতে নিধিকে জিজ্ঞাসাবাদের কৌশল বের করতে হবে। রিফাত তো এখন মুঠোর ভেতরেই রয়েছে।
ইন্সপেক্টর জিলানী সিআইডি অফিসে। তাঁর এক সহযোগীকে ফোন লাগালেন।
‘রিফাত ইসলামের কাজের ছেলেকে তো তুমি দেখেছো ?’
‘জি স্যার, মোচন নাম।’
‘হ্যাঁ। তাকে এখানে নিয়ে এসো। তার আগে সিকিউরিটি ম্যান আদিলকে ফোন করে বলো যেন মোচনকে ওয়াচে রাখে। নিধিকে তো রাখছেই।’
‘ওকে স্যার।’
জিলানীর ডাকে অফিস সহায়ক দিদার ভেতরে এলো। সে সাধারণত দরজার বাইরে বসে। জিলানী বললেন,‘শোন, ক্যান্টিনে এখন কী পাওয়া যাবে ?’
‘এ সময় ক্যান্টিনে গরম গরম সিঙ্গাড়া ভাজে স্যার। অনেক মজা !’ দিদার জবাব দিল।
‘অনেক মজা ! আচ্ছা যাও নিয়ে এসো।’
‘কয়টা আনবো স্যার ?’
জিলানীও ভাবছে কয়টা সিঙ্গাড়া আনাবে। এমনিতে ডুবোতেলে তৈরি খাবার তাঁর তেমন পছন্দ নয়, তবে গরমাগরম সিঙ্গাড়া বলে কথা ! জিলানী ভাবে, যদি মোচনকে আগে একটা সিঙ্গাড়া খাওয়ানো হয় তাহলে উৎফুল্ল হয়ে সে সত্যিটা বলে দেবে। এটাও একটা কৌশল। সব সময় ভয় দিয়ে জয় করা যায় না।
জিলানীও ভাবছে কয়টা সিঙ্গাড়া আনাবে। এমনিতে ডুবোতেলে তৈরি খাবার তাঁর তেমন পছন্দ নয়, তবে গরমাগরম সিঙ্গাড়া বলে কথা ! জিলানী ভাবে, যদি মোচনকে আগে একটা সিঙ্গাড়া খাওয়ানো হয় তাহলে উৎফুল্ল হয়ে সে সত্যিটা বলে দেবে। এটাও একটা কৌশল। সব সময় ভয় দিয়ে জয় করা যায় না।
‘চারটা আনো।’ জিলানী ওয়ালেট থেকে ২০/-টাকা বের করে দিলেন।
কিছুক্ষণ পর কল এলো।
‘স্যার মোচন ওই বাসায় নেই। বাসায় তালা।’ সহযোগী জানালো।
‘মানে কী ? সে কোথায় ?’ জিলানী জিজ্ঞেস করলেন।
‘আদিল জানিয়েছে, মোচন সম্ভবত গভীর রাতে কোথাও চলে গেছে।’
‘কেন, রুস্তমকে তো বলা হয়েছিল কড়া নজর রাখতে। ওই গেট ছাড়া তো বের হওয়ার রাস্তা নেই! কেন এমন হলো?’ জিলানী রেগে গেলেন।
‘স্যার আমি রুস্তমের সাথে কথা বলে আপনাকে জানাচ্ছি।’
‘যেভাবেই হোক, কালকের মধ্যে মোচনকে এখানে হাজির করবে। দ্যাট’স ভেরি আর্জেন্ট।’
‘রাইট স্যার।’
সিঙ্গাড়া এলো। টেবিলে চারটা সিঙ্গাড়া। জিলানীর মুড অফ। তাঁর খেতে ইচ্ছে করছে না। দিদারকে বলল,‘এগুলো নিয়ে যাও। তুমি খেয়ে ফেলো।’
দিদার তার স্যারের মুড চেনে। কোন কথা না বলে সে একবার জিলানীর দিকে তাকালো, তারপর টেবিল থেকে সিঙ্গাড়ার প্লেটটা নিয়ে গেল। জিলানী ইজি চেয়ারে গিয়ে বসলো। একটা সিগারেট ধরিয়ে মারলো এক টান ! এক টানে সিগারেট লম্বায় আধখান !
রাত ১১টার কাছাকাছি। ঘণ্টাখানেক আগে ডিনার শেষ হয়েছে। এখন ঘুমাতে যাবার সময়। সাজিয়া ড্রেসিং টেবিলের বিশাল আয়নার সামনে। চুল আঁচড়াতে গিয়ে তার হাত থেকে চিরুনিটা পড়ে গেল। সাথে সাথে মনে পড়ল তার নানির কথা। নানি বলত, হাত থেকে চিরুনি পড়ে যাওয়ার অর্থ হলো— ঘরে মেহমান আসছে। সাজিয়ার হাসি পেল। এই রাত্রিবেলা কোন্ মেহমান আসবে ? আবার হাসির কথা উঠলে নানি বলতো, জানিস কোন মেয়ে হাসলে যদি গালে টোল পড়ে, তাহলে সে খুব স্বামী সোহাগী হয়।
ঘোড়ার ডিম হয় ! তার এক কাজিন আছে সিমি। স্পষ্টভাষী ও সুন্দরী। হাসলে দু’ গালে চমৎকার দুটি টোল পড়ে। অথচ দু’ দু’বার বিয়ে ভেঙ্গেছে তার। তের বছরের বিবাহিত জীবনে স্বামী এসেছে তিনজন। পর পর তিনটে স্বামী পাওয়া কি স্বামী সোহাগীর লক্ষ্মণ ? আজ নানি জীবিত থাকলে এ প্রশ্ন সে করেই ছাড়ত।
চুলে সিঁথি করার সময় সাজিয়া আয়নায় পরিষ্কার দেখতে পেলো, সামনের দু’তিনটে চুল কালো থেকে রূপালি হয়েছে। বুঝে নিলো সময় গড়াচ্ছে, বয়সও বাড়ছে। আটত্রিশ বছর কিইবা এমন বয়স ! অবশ্য তার বান্ধবীদের কারও কারও চুল আগেই পেকেছে। কেউ কেউ চুলের কলপ ব্যবহার করে তা লুকিয়েও রাখে। আবার কারও কারও বয়স বেশি হওয়া সত্বেও কেশদাম একেবারে কৃষ্ণকালো।
সাজিয়া তার চুলগুলো পেছনে বেঁধে হেয়ারব্যান্ড লাগিয়ে দিলো। মুখে ও বাহুতে বডি-লোশন মাখলো। এরপর চিরুনিটা তুলতে গিয়ে তাকিয়ে রইলো। কিছু চুল চিরুনিতে দলা পাকিয়ে রয়েছে হাওয়াই মিঠাইর মতো। ইদানিং মাথার চুল পড়তে শুরু করেছে। আগে এমনটা ছিল না। এ নিয়ে তার টেনশন শুরু হয়েছে। এভাবে চুল পড়তে থাকলে তো একদিন কেমো-পেশেন্টের মতো টাক পড়ে যাবে ! চিরুনি থেকে চুলগুলো তুলে ফেলে দেয় সে। ভাবে, নানি দেখলে বলতো এভাবে চুল ফেলা ভালো না, একটু থুথু দিয়ে ফেলতে হয় ! হায়রে নানি ! কেন যে তোমরা এসব সংস্কার-কুসংস্কার বিশ্বাসের সাথে আঁকড়ে ধরতে !’
সাজিয়া ‘নাভিদ ও নাভিদ’ ডাক দিয়ে ছেলের কক্ষে ঢুকল। দেখে, নাভিদ ঘুমোয় নি। সে আপন মনে ড্রয়িং করছে। একটা আর্টপেপারের উপরে এবং নিচে দু’টো ছবি এঁকেছে। উপরে: তিনজন ড্রাগ সাপ্লাইয়ার মাথার উপরে হাত তুলে আছে। তাদের সামনে পিস্তল উঁচিয়ে এক গোয়েন্দা, যিনি একাই তাদের ধরে ফেলেছেন। নিচে : অপরাধীদেরকে পিটুনির দৃশ্য। পাশে, এদের সাথে আরও যারা জড়িত রয়েছে তাদের নামের তালিকা, যে নামগুলো জিজ্ঞাসাবাদের পর অপরাধীরাই বলে দিয়েছে।
সাজিয়া ‘নাভিদ ও নাভিদ’ ডাক দিয়ে ছেলের কক্ষে ঢুকল। দেখে, নাভিদ ঘুমোয় নি। সে আপন মনে ড্রয়িং করছে। একটা আর্টপেপারের উপরে এবং নিচে দু’টো ছবি এঁকেছে। উপরে: তিনজন ড্রাগ সাপ্লাইয়ার মাথার উপরে হাত তুলে আছে। তাদের সামনে পিস্তল উঁচিয়ে এক গোয়েন্দা, যিনি একাই তাদের ধরে ফেলেছেন। নিচে : অপরাধীদেরকে পিটুনির দৃশ্য। পাশে, এদের সাথে আরও যারা জড়িত রয়েছে তাদের নামের তালিকা, যে নামগুলো জিজ্ঞাসাবাদের পর অপরাধীরাই বলে দিয়েছে।
‘ওয়াও ! দারুণ এঁকেছিস বাবা !’ সাজিয়া অবাক চোখে নাভিদকে বলল।
‘দে, তোর আব্বুকে দেখিয়ে আনছি।’
‘পরে আম্মু। আগে রঙ করে নিই।’ নাভিদ বলল। সে খুশি হয়েছে মায়ের প্রশংসা শুনে। অবশ্য সব সময়ই মা ছেলের প্রশংসা করে।
ড্রয়িংটা সাজিয়ার মনে ধরেছে। সে ছো মেরে নিয়ে গেলো কাগজটা তার স্বামীকে দেখাতে। নিশ্চয়ই সে ভালো কমেন্ট করবে! সেও তো একজন ডিটেকটিভ !
‘এটা দেখো। দারুণ না ? ছেলে তার গোয়েন্দা বাবাকে এঁকেছে। ড্রয়িংটা কী মিনিংফুল তাই না?’ সাজিয়া তার স্বামীকে ড্রয়িংটা দেখিয়ে বলল।
ইন্সপেক্টর জিলানী তাঁর কেস স্টাডিতে। নিজের টেবিলে। স্ত্রীর কথা শুনে কাগজটার দিকে একনজর তাকালেন। বললেন, ‘হুঁ।’ মাথাটা ঘুরিয়ে আবার নিজের কাজে দৃষ্টি দিলেন। বললেন, ‘তোমার ছেলে তোমার মতোই জিনিয়াস !’
‘আমার ছেলে মানে কী ! তোমার ছেলে না ?’ সাজিয়া বলল।
‘হ্যাঁ, আমাদের ছেলে। তবে তোমার আগে। তুমি মা। পেটে ধরেছো, জন্মের পর ভীষণ কষ্ট করে লালন-পালন করেছো, এখনও করছো। পড়ালেখাসহ সবকিছু তুমিই দেখছো। আমি বাবা কী করি, সকালে বের হয়ে যাই আর রাতে ঘরে ফিরি। পুরো সংসারের দায়িত্ব তোমার মাথায়। সত্যি, তোমার অবদানের কোন মূল্য হয় না।’
সাজিয়া খুশি হলো। সে কষ্ট পায় এমন কথা বা কাজ থেকে জিলানী দূরে থাকার চেষ্টা করে। অবশ্য সে নিজেও পারস্পরিক সৌহার্দ্য এবং ভালোবাসা অটুট রাখার ব্যাপারে যতোটা সম্ভব সতর্ক।
‘আরেকবার দেখি তো !’ এই বলে জিলানী কাগজটা নিয়ে তার চোখের সামনে ধরলেন। নিচের ছবিটা মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকলেন, যেখানে একটি তালিকার চিত্র আঁকা হয়েছে। ছেলের ছবি দেখে জিলানী একটা আইডিয়া পেয়ে গেলেন। ভাবলেন, তাই তো ! একটা তালিকা চাওয়া খুব জরুরি।
ইন্সপেক্টর জিলানী তাঁর স্ত্রীকে বললেন, ‘তোমাকে থ্যাংকস সাজিয়া।’ পরে বললেন,
‘ম্যাডাম একটুখানি সময় দেবেন ?’
সাজিয়া বুঝলো। বলল, ‘ওকে। টেক ইওর টাইম।’
রুম থেকে যাবার সময় সে জিলানীর মাথায় মৃদু টোকা দিয়ে বলল,‘বেশি রাত করো না কিন্তু।’
ইন্সপেক্টর জিলানী ভেবে দেখলেন, ১৩ জানুয়ারি তারিখে হঠাৎ বিস্ফোরিত অস্ট্রেলিয়াগামী প্লেনটির ফ্লাইট শুরু হয়েছিল ঢাকা থেকে ১২ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১১-৪৫ মিনিটে। ওই সময়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যেসব যাত্রী ঢাকা-সিঙ্গাপুর-সিডনি ফ্লাইটে চেক-ইন হয়েছিলেন তাদের একটা তালিকা সংগ্রহ করতে হবে।
জিলানী তাঁর ল্যাপটপ অন করলেন। দু-তিনটে ই-মেইল অ্যাড্রেস সংগ্রহ করলেন। তারপর, ১২ জানুয়ারি সিডনির উদ্দেশ্যে সিঙ্গাপুরগামী ফ্লাইটে বোর্ডিং নিশ্চিত করা যাত্রীদের তালিকা চেয়ে ঢাকা এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ এবং ‘গ্যালাক্সি এয়ারলাইনস’এর কাছে জরুরি ই-মেইল পাঠিয়ে দিলেন।
জিলানী তাঁর ল্যাপটপ অন করলেন। দু-তিনটে ই-মেইল অ্যাড্রেস সংগ্রহ করলেন। তারপর, ১২ জানুয়ারি সিডনির উদ্দেশ্যে সিঙ্গাপুরগামী ফ্লাইটে বোর্ডিং নিশ্চিত করা যাত্রীদের তালিকা চেয়ে ঢাকা এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ এবং ‘গ্যালাক্সি এয়ারলাইনস’এর কাছে জরুরি ই-মেইল পাঠিয়ে দিলেন।
ওদিকে কিছুই স্বীকার করছে না রিফাত। প্রতিবার তার একই কথা— এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। জিলানী ভাবছেন, ইন্টাররোগেশনের স্বাভাবিক কৌশলগুলো কাজে লাগছে না। এবার তাঁকে কঠোর কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হবে। প্রকৃত তথ্য তাঁকে পেতেই হবে।
একটা বিষয় তাকে একটু ভাবিয়ে তুলেছে। তিনি ভালো করে পড়ে দেখেলেন, রিফাত যে পাওয়ার অব এটর্নি তৈরি করেছে তাতে লেখা— রেজাউদ্দিন স্বয়ং ভীষণ অসুস্থ বিধায় এবং তার একমাত্র সন্তান জেরিন দুর্ঘটনায় মৃত বিধায় তাঁর প্রিয়ভাজন রিফাত ইসলাম তাঁর পক্ষে কিংবা তাঁর অবর্তমানে তৃতীয় তলাটা নিজ দখলে রাখতে, এর যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণ করতে এবং প্রয়োজনে হস্তান্তর করতে পারবে। তাছাড়া তৃতীয় তলার উপরদিকে আরও তিনটি ফ্লোর নির্মাণ,রক্ষণাবেক্ষণ এবং হস্তান্তর করতে পারবে।
এখন কথা হচ্ছে, রিফাত যখন জাল ডকুমেন্ট তৈরিই করলো তখন সে পুরো সম্পত্তির উপর করলো না কেন ? এর মূল কারণ কী ? তাহলে তো প্রশ্ন থাকে, মালিকের অবর্তমানে ওই ডুপ্লেক্স বাড়ি এবং বাড়িসংলগ্ন ভূমির কী হবে ?
[চলবে]
আরও পড়ুন :
বিধ্বংসী প্রহর,পর্ব-১
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ২
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ৩
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৪
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৫
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৬
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৭
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৮
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৯
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ১০
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১১
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১২
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১৩