বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১৪

পিস্তল গুলিভর্তি ছিল। কিন্তু গুলি একটাও খরচ করতে হয়নি।
রুস্তম সিআইডি’র এজেন্ট। আদিলও তাই। ওরা দুজন একত্রে ‘কভারে’ রয়েছে রেজাউদ্দিন সাহেবের বাড়ির গেটের নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে। সাসপেক্ট রিফাতকে আটকাতে রুস্তম যে উপস্হিত বুদ্ধি ও দক্ষতা দেখিয়েছে তার জন্য ইন্সপেক্টর জিলানী তাকে সোর্স মানি থেকে ইতোমধ্যে কিছু নগদ অর্থ পুরস্কার হিসেবে দিয়েছেন।
দেশের প্রায় সব ক’টি দৈনিকে এসেছে সন্দিগ্ধ আসামি রিফাত ইসলামের গ্রেফতারের খবর। পত্রিকায় দেখে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব রিফাতের মোবাইলে অনবরত রিং দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মোবাইল তো বন্ধ। উদ্ধারকৃত কাগজের সাথে তার মোবাইলও সিআইডি জব্দ করেছে। ইতোমধ্যে তার অফিসের এবং তার ঘনিষ্ঠজনদের কেউ কেউ দেখা করতে থানায় এসেছে। কিন্তু সে রিমান্ডে থাকায় তার সাথে কারও সাক্ষাত হয় নি।
অপরদিকে বিবিসি নিউজ চ্যানেলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, ১৩ জানুয়ারি সিডনির কাছাকাছি ২৮৪ জন যাত্রী নিয়ে যে ৭৪৭ বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে পড়ে গিয়েছিল তার কোন যাত্রী এবং ক্রু বেঁচে নেই। বিমানের ব্ল্যাক বক্স অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেছে। বিমানে সংঘটিত বিস্ফোরণটি সন্ত্রাসবাদীদের অন্তর্ঘাতমূলক কাজ ছিল বলে জানা গেছে।
ইন্সপেক্টর জিলানী অনলাইনে ওই খবরটা দেখেছেন। তিনি ভেবেছিলেন জেরিন মেয়েটা হয়তো কোন একদিন ঘরে ফিরে আসবে। সে আশার ইতি ঘটলো। নিধি তাহলে ওই বাড়িটার পাকাপোক্ত তত্ত্বাবধায়ক হয়ে যাচ্ছে ! বোধ হয় একেই বলে ‘কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ’।
খবরটা শুনে জেরিনের ইউনিভার্সিটির বেশ কয়েক জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী এ বাড়িতে এসেছেন। এসে শুনতে পেয়েছেন, জেরিন ম্যাডাম তো গেছেনই, তাঁর বৃদ্ধ ও অসুস্হ বাবারও কোনো সন্ধান নেই ! এসব শুনে তাদের আফসোসেরও শেষ নেই।
নিধি পর্যায়ক্রমে সবার সাথে সৌজন্য দেখা দিচ্ছে। সমব্যথীও হচ্ছে। যদিও নিধি নিজেই অন্য কারণে মানসিকভাবে অনেকটা ভারাক্রান্ত।
পিন্টু এসেছে নীলক্ষেতে। ছোট বোন স্বর্ণা একটা পাঠ্য বইয়ের নাম দিয়েছে, সেটা কিনতে। বইটা কিনে পিন্টু বাসে ওঠার জন্য রাস্তার ওপারে গেছে, এমন সময় মুষলধারে বৃষ্টি। ছাতা সাথে নেই। পিন্টু এক মিনিটেই ভিজে চুবচুবা ! বইটা পলিথিন ব্যাগের ভেতরে থাকায় খুব একটা ভেজে নি।
বাসের দেখা নেই। পিন্টু ভাবছে কী করবে, এসময় কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। হঠাৎ পাশে একটা গাড়ি এসে ব্রেক করল।
‘আপনি পিন্টু না ?’
পরিচিত কন্ঠ। পিন্টু দেখলো জীপে ইন্সপেক্টর জিলানী। দেখে একটু ভয়ই পেলো। রিফাতের গ্রেফতার হওয়ার ঘটনা শুনেছে সে। ভাবল, ইন্সপেক্টর সাহেব তাকে ফলো করছে না তো !
পিন্টু ইন্সপেক্টর জিলানীকে সালাম দিয়ে বলল,‘স্যার আপনি !’
‘গাড়িতে উঠুন।’ জিলানী কোমলস্বরেই বললেন।
পিন্টু গাড়ির পেছনদিকে উঠে বসল। তার মনে শঙ্কা। গাড়িতে উঠিয়ে তাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবে না তো !
‘এভাবে ভিজলেন যে ? এক জায়গায় শেল্টার নিলেই তো পারতেন !’ জিলানী জিজ্ঞেস করলেন। তিনি একাই গাড়িতে।
‘সময় পেলাম না স্যার। বৃষ্টিটা হঠাৎ নামল।’
জিলানী টিস্যু বক্স থেকে কয়েকটা টিস্যুপেপোর তুলে পিন্টুকে দিয়ে বললেন, ‘মাথাটা মুছে ফেলুন।’ নিজের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট এবং লাইটার বের করলেন। একটা সিগারেট ধরিয়ে তাঁর দুই ঠোঁটের ভেতরে রাখলেন। এরপর খোলা সিগারেটের প্যাকেটটা পেছনে পিন্টুর সামনে মেলে ধরলেন।
‘আমি সিগারেট খাই না স্যার।’ পিন্টু হেসে তার প্রতিক্রিয়া জানাল।
গাড়ি নিউমার্কেট পার হয়ে ধীরগতিতে ধানমন্ডি অভিমুখে চলল।
কিছুক্ষণ পর ইন্সপেক্টর জিলানী জিজ্ঞেস করলেন—
‘ওই বাড়িতে কি আপনি প্রতিদিন যান ?’
‘না। এখন দু’দিন পর পর যাই।’ পিন্টু উত্তর দিল।
‘গাড়ি তো চালাতে হয় না, তাহলে গিয়ে কী করেন?’
‘জী ওই, তেল-মবিল, টায়ার-টিউব চেক করতে হয়, ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে রাখতে হয়। আবার নিধি বাইরে থেকে কিছু আনতে বললে নিয়ে আসতে হয়।’
‘এ মাসে বেতন পেয়েছেন ?’
‘জী স্যার।’
পিন্টু মনে মনে বললো— এই ভদ্রলোকের প্রশ্ন করা ছাড়া আর কোন কাজ নেই নাকি ?
‘জেরিন ম্যাডাম নেই, তার বাবা নেই, আপনাকে বেতন কে দিয়েছে ?’ জিলানী প্রশ্ন করলেন।
‘নিধি দিয়েছে, স্যার ।’
‘সে তো নিজেই বেতনভুক কর্মচারী। আপনাকে দিলো কোত্থেকে ?’
‘হয়তো ম্যানেজ করেছে।’ পিন্টু ইতস্তত কন্ঠে জবাব দিলো।
‘ইউ আর রাইট। ম্যানেজ করেছে। ম্যানেজ করতে পারাটা একটা একটা বিশাল দক্ষতা। কী বলেন ?’ জিলানী পেছন ফিরে বললেন।
পিন্টু এবার কোন উত্তর দিলো না। স্মিত হাসি দিয়ে চুপ করে রইল।
‘আচ্ছা, নিধি কি আনম্যারেড ?’ জিলানী প্রশ্ন করলেন।
‘না, তার বিয়ে হয়েছিল। পরে তালাক হয়ে যায়।’
‘আপনি তার স্বামীকে দেখেছেন ?’
‘না স্যার শুনেছি, তার কাছে।’
‘রিফাতের সাথে তার কী সম্পর্ক ?’
‘রিফাত তো মালিকের ভাড়াটিয়া। নিধি গিয়ে ভাড়ার টাকা নিয়ে আসে।’
‘তাদের ভেতরে গোপন কোন রিলেশন নেই ?’
‘মনে হয় না। আসলে আমি জানি না স্যার।’
জিলানী সিগেরেটে শুখটান দিলেন। তারপর গোড়াটা গাড়ির অ্যাশ-ট্রেতে রাখলেন। পিন্টুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনিও কি ডিভোর্সি ?’
একথা শুনে পিন্টু যেন লজ্জা পেল। জিলানী লক্ষ্য করলেন তার চোখ-মুখের অভিব্যক্তিতে লাজুক ভাব।
‘কী যে বলেন স্যার ! আমি তো বিয়েই করি নি !’ পিন্টু জবাব দিল।
‘ও তাই !’ এমন করে বললেন যেন জিলানী জানেনই না ! তারপর আবার বললেন,‘শুনেছি আপনি নাকি নিধিকে বিয়ে করতে চান ?’
‘চাইতাম।’
‘এখন চান না ? কেন ?’
‘আসলে ও এমনিতে শান্ত, কিন্তু হঠাৎ রাগ উঠলে খুব ভয়ংকর হয় ! ভেবে দেখলাম, আমার সাথে তার মিল খাবে না।’
‘হুঁ, এ বিষয়টা আমিও লক্ষ্য করেছি। তার বিয়ে কি তাহলে এ কারণেই ভেঙ্গেছে ?’
‘সেটা আমি জানি না স্যার। এ ব্যাপারে নিধি কিছুই বলে না। খুব শক্ত পার্সোনালিটির।’
‘নিধি ও আপনার মধ্যে একটা বোঝাপড়া হয়েছে না ?’
‘বিয়ের ব্যাপারে ?’
‘কোন্ ব্যাপারে সেটা আপনিই বলুন।’
‘বিয়ের ব্যাপারে হয়েছিল যে, একটা ভালো সময় দেখে দুজন ঘর বাধব। কিন্তু সময়টা তো ভালোর জায়গায় আরও খারাপ হয়ে গেলো স্যার।’
‘আপনার আয় কেমন ?’
‘আয় তো বেশি না। বিশ হাজার টাকা বেতন পাই। আট হাজার টাকা বাসা ভাড়াতেই চলে যায়। ছোট বোন কলেজে পড়ে। মা অসুস্থ। সংসারের খরচ মেটানোই দায় !
‘তার মানে বিয়ের পর আপনারা ওই বাড়িতে সবাই একসঙ্গে থাকবেন, এরকমই তো কথা হয়েছে তাই না ?’
‘জী তাই।’ পিন্টু পরে বলল, ‘না স্যার। বিয়ের পর তো স্বামীর বাড়িই স্ত্রীর বাড়ি।’
জিলানী বললেন- ‘হুঁ তাতে বটে…ই।’ এরপর কিছুক্ষণ কোনো কথাবার্তা নেই। আবার জিলানী জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, জেরিন ম্যাডামের ফ্লাইট তো রাতে ছিল, তাই না ?’
‘জী। রাতের ফ্লাইট ছিল।’ পিন্টু জবাব দিল।
‘আপনি যখন তাঁকে গাড়িতে এয়ারপোর্ট নিয়ে যান তখন তিনি সুস্হ ছিলেন তো ?’
‘এয়ারপোর্টে গাড়ি নিয়ে আমি যাই নি স্যার।’
‘সে কি ! আপনি যান নি কেন ? আপনি না তাঁদের নিয়োগপ্রাপ্ত গাড়িচালক !’ জিলানী আশ্চর্য হলেন।
‘বলছি স্যার। আমি এসেছিলাম। কিন্তু তিনতলা থেকে নামতে গিয়ে আমি হঠাৎ সিঁড়ি থেকে পড়ে যাই। আমার ডান হাত বেশ মচকে গিয়েছিল। মাথায় এবং পায়েও খুব ব্যথা পেয়েছিলাম।’
‘তিন তলায় কেন গিয়েছিলেন ?’
‘ম্যাডাম বিদেশ যাচ্ছেন, ওইদিন নিধি কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না করেছিল। পরে আমাকে বলেছিল এক প্লেট রিফাত সাহেবকে দিয়ে আসতে। আমি নিয়ে গিয়েছিলাম।’
‘তারপর ?’
‘রিফাত সাহেব সে সময় সিঁড়ির নিচ থেকে উপরের দিকে উঠে আসছিলেন। আমাকে প্লেটসহ দেখে একটা হাসি দিয়েছিলেন। পরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে ঠিক মাঝামাঝি যখন আসি, পা পিছলে পড়ে যাই।’
‘তারপর ?’
‘আমার অসহ্য ব্যথা হচ্ছিল। কাজের ছেলে মোচন আমাকে ধরে ধরে কাছের একটা ফার্মেসিতে নিয়ে যায়। ডাক্তার আমাকে দেখে অষুধ দেন এবং ফুল রেস্টে থাকতে বলেন। অবস্থা দেখে রিফাত সাহেব নিজের গাড়ি নিজেই চালিয়ে জেরিন ম্যাডামকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেন।’
‘ও তাই !’ জিলানীর অবাক প্রতিক্রিয়া। বললেন, ‘শুনুন, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনটা আমাকে দেখাবেন।’ একথা বলে জিলানী আবার জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, নিধি সাথে গিয়েছিল না ?’
‘জী। জেরিন ম্যাডামকে এগিয়ে দিতে গিয়েছিল।’
ইন্সপেক্টর জিলানী চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকালেন। পিন্টু তার চোখ নিচে নামাল। ভাবল, না জানি কী কথা বের করতে চাচ্ছে এই গোয়েন্দা অফিসার !
গাড়ি চলে এলো সিটি কলেজের কাছে। সামনে ইউ-টার্ণের মোড়টাতে একটা বিশ্রী ট্রাফিক জ্যাম লেগে রয়েছে।
জীপের ড্রাইভার বলল,‘স্যার পেট্রল কি ফেরার পথে নিয়ে নেব ?’
‘হুঁ।’ ইন্সপেক্টর মাথা নাড়লেন।
‘আমি সোজা থানার দিকে যাবো। আপনি বাম দিক থেকে মোহাম্মদপুরের বাসে উঠে শংকর নামতে পারবেন।’ জিলানী বললেন।
পিন্টু ‘থ্যাংক ইউ স্যার’ বলে নেমে পড়লো। নেমে যেন সে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে !
বৃষ্টি এখন গুঁড়িগুঁড়ি। থেমে থেমে আকাশের গর্জন শোনা যায়।
চলবে…
আরও পড়ুন :
বিধ্বংসী প্রহর,পর্ব-১
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ২
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ৩
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৪
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৫
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৬
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৭
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৮
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৯
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ১০
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১১
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১২
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১৩