বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১৩

টিটি টুটু টিটি টুটু….মোবাইলে অ্যালারাম বেজে উঠল।
ইন্সপেক্টর জিলানীও উঠে গেলেন। এমনিতে রোজ ভোরেই
তাঁর ঘুম ভাঙ্গে, কিন্তু কাল রাতে বিছানায় গেছেন দেড়টায়।
সে কারণে ভোর সাড়ে চারটার অ্যালারম্ সেট করেছিলেন।
তাঁর মোবাইলটাও চার্জ দিয়ে ফুল করা হয়েছে।
বার্থ ডে পার্টি থেকে ফিরে রাতে কেসটা নিয়ে কিছু হোমওয়ার্ক করতে হয়েছিল। যে কোনো মিশনের আগে পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করা জরুরি। who what why where when এই পাঁচটি W সম্পর্কে পরিজ্ঞাত ও পরিতুষ্ট হওয়ার পরই জিলানী তাঁর মিশন পরিকল্পনা করেন।
জিলানীর স্ত্রী সাজিয়াও বিছানা ছাড়ল। বুঝে নিলে যে তার গোয়েন্দা স্বামী জরুরি প্রফেশনাল কাজে বের হবেন। সাজিয়া কখনো একটা কিছু মুখে না দিয়ে তাঁকে বেরুতে দেয় না। ঝটপট রেডি করে ফেললো ব্রেকফাস্ট টেবিল। অরেঞ্জ জুস, তিন স্লাইস টোস্টেট ব্রেড, বাটার, ডিম ওমলেট এবং কলা। এরপর চা তো রয়েছেই।
ইন্সপেক্টর জিলানী ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বেডরুমে ঢুকলেন। মোবাইলটা নিয়ে কল করলেন তাঁর দুই সহযোগীকে। ওরাল ব্রিফিং দিলেন। এরপর ফোন লাগালেন তার অনুচর রুস্তমকে। রুস্তম হাই তুলতে তুলতে ফোন রিসিভ করলো। জিলানী বললেন—
‘তিনতলার নাম জানো তো ?’
‘জী স্যার, রিফাত ইসলাম।’
‘রাতে ফিরেছে ?’
‘ফিরেছে স্যার। রাত ১২ টায়।’
‘এরপর আউট হয়েছে ?’
‘না স্যার। এমনিতে সকাল আটটার আগে বের হয় না।’
‘তোমার ডিউটি ক’টা পর্যন্ত ?’
‘টেন টু টেন স্যার। দশটায় আদিল আসবে।’
‘ওকে, তুমি গেটে থাকো। ওই লোক আটটার আগে বের হয়ে এলে আমাকে জানাবে।’
‘স্যার।’
‘আর এর মধ্যে অন্য কাউকে ইন-আউট করাবে না। এটাই অর্ডার।’
‘রাইট স্যার।’
নাস্তা সেরে চায়ে চুমুক দিলেন। স্ত্রীকে বললেন,
‘সাজিয়া তুমি খেলে না যে ?’
‘একটু পরেই খাই। রাতে ওখানে বেশি খাওয়া হয়ে গেছে।’
‘স্বাভাবিক। ছত্রিশ আইটেমের মেনু !’
‘আমি তো নিয়েছি ছ’টা আইটেম। তাতেই স্টোমাক ফুল !’
‘আমিও ছ’টা। অবশ্য রাইস নিয়েছি খুব সামান্য। ডেজার্ট একদমই নেই নি।’
‘আসলে আমার ডেজার্ট খাওয়াটাই একটু বেশি হয়ে গেছে।’
জিলানী হঠাৎ মৃদু হাসলেন। সাজিয়া এটা লক্ষ্য করে বলল, ‘আমার খাওয়ার কথা শুনে হাসলে ?’
‘আরে না।’
‘তাহলে ?’
‘দেখলাম বাঙালি খাবার পেলে কিভাবে খায় ! প্লেট ভরে ভরে খাবার নেয় , আবার নেয়, আবার..! ছত্রিশটা কেন একশ’টা পদ থাকলেও এরা একশ’টা নেয়ার চেষ্টা করবে। অথচ সবটা খেতে পারবে না। শুধু শুধু খাদ্যের অনিষ্টসাধন ! কেউ যদি পুরোটা খেয়েও ফেলে সেটা তার স্বাস্হ্যের অনিষ্টসাধন !’
জিলানী কালো ট্রাউজার পরলেন। কোমরে রিভলভার সেট করলেন। স্যান্ডো গেঞ্জি পরে তার ওপরে আকাশি হাফশার্ট পরলেন। ঘড়ি পরলেন। পকেটে ওয়ালেট রাখলেন। মোবাইলটা হাতে নিতেই এসএমএস কল এলো— ‘স্যার আমরা জীপ নিয়ে নিচে আছি।’
বাইরে সূর্যটা উঠছে। পুবাকাশে লাল আভা। ইন্সপেক্টর জিলানী ঘড়ি দেখলেন। সময় সাড়ে পাঁচটা। ব্রিফকেসটা তুলে হাতে নিলেন। মোবাইলটা পকেটে রেখে ওয়াকিটকি বাঁ হাতে ধরলেন। স্ত্রীকে বললেন, ‘আসি। একটা মিশন আছে। শহরেই।’
সাজিয়া দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলো। তারপর বললো, ‘বাই। সাবধানে থেকো।’
জিলানী জিপের সামনের সিটে বসলেন। পেছনে তাঁর শসস্ত্র দুই সহযোগী। জিলানী চোখে সানগ্লাস পরলেন। সানগ্লাসে তাঁকে ভালোই লাগে। পেছনে একজন আরেকজনকে ফিস্ ফিস্ করে বললো, ‘স্যার তো দেখি পুরাই জেমস্ বন্ড !’ উইন্ডস্ক্রিনের উপরের লুকিংগ্লাসে জিলানী এটা ঠিকই লক্ষ্য করলেন। একটা ঠোঁটচাপা হাসি দিলেন।
রমনার সড়ক ধরে বেশ স্পিডেই এগুচ্ছে গাড়ি। এই সময়টায় রাস্তা ফাঁকা। বামদিকে রমনা পার্ক। ভোরের হন্টনকারীদের অনেকেই পার্কে। ওয়াকওয়েতে হাঁটছে। ইয়াংদের মধ্যে অনেকে দৌঁড়াচ্ছে। নানান বয়সের মহিলা ও পুরুষ। তবে প্রবীণদের সংখ্যাই বেশি। আবার কেউ কেউ দাঁড়িয়ে পরস্পর খোশগল্পে মত্ত। কেউ কেউ সেলফি তুলতে ব্যস্ত।
বাঁয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল। তাঁর গাড়ি শাহবাগের দিকে এগুচ্ছে। ইন্সপেক্টর জিলানী হোটেলটির অবয়বে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলেন। এই হোটেল আইয়ুব খাঁর আমলে তৈরি। প্রথমে এর নাম ছিল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল। পরে শেরাটন গ্রুপ নিয়ে নেয়ায় নাম হয় শেরাটন হোটেল। ওরা ছেড়ে দেওয়ার পর এটাকে আরও আধুনিক এবং ফাইভস্টার হোটেলের পূর্ণাঙ্গ সুযোগ সুবিধা দেওয়ার জন্য উন্নয়ন কাজের সিদ্ধান্ত হয়। কাজ শুরুর আগ পর্যন্ত দেশীয় ব্যবস্থাপনাধীনে এর নাম রাখা হয় রূপসী বাংলা হোটেল। পরে ইন্টারকন্টিনেন্টাল গ্রুপ এটা নিয়ে নেয়। অত:পর নবরূপে সজ্জিত হোটেলটির পুনরায় নামকরণ হয় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল।
দীর্ঘদেহী হোটেলটি খুব কাছ থেকে দুই চোখ মেলে এবং দুই কান খুলে একাত্তুরে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শুনেছিল।
গাড়ি নিউ এলিফ্যান্ট রোড এবং সায়েন্স ল্যাবরেটরি পার হয়ে ধানমন্ডি ছয় নাম্বার রোড দিয়ে ঢুকে সামনে এগুলো। অল্প কিছুক্ষণ পর জীপটা এসে থামলো রেজাউদ্দিন সাহেবের বাড়ির গেটে। গাড়ি থেকে নেমে পড়ল তিনজন। রুস্তম আছে গেটে। সে জোরে এক সালাম ঠুকল। ইন্সপেক্টর জিলানী তাকে ইশারা করলেন। সেও ইশারায় জানাল যে রিফাত ঘরেই আছে।
জীপটা সিঁড়ির গোড়ায় রেখে জিলানী এবং দুইজন তর তর করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে তৃতীয় তলায় গেলো। এই সিঁড়ি দিয়ে উঠে কেবল তৃতীয় তলাতেই যাওয়া যায়। তিনতলায় একটি ইউনিট। এর নিচে একতলা-দোতলা ডুপ্লেক্স, মালিকের বাড়ি। সে বাড়ির প্রবেশপথ একদম পৃথক।
ইন্সপেক্টর জিলানী কলবেল চাপলেন-টিঁ..ট। একবার, দু’বার। কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে আওয়াজ এলো— ‘কে ?’
জিলানী উত্তর দিলেন, ‘আমি ইন্সপেক্টর জিলানী।’
হাল্কা পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেলো। মনে হলো ওটা ছিল কাজের ছেলে মোচন মিয়ার গলা। সে দরজায় লাগানো ছোট্ট দূরবীনের ফাঁক দিয়ে দেখে আবার ভেতরের দিকে গেছে। সম্ভবত তার মনিব রিফাতকে খবরটা দিতে।
পাকা পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে তিনজন। ভেতর থেকে কান সাড়া নেই। জিলানী উচ্চস্বরে বললেন, ‘দরজা খোলো। আমরা সিআইডির লোক। ডিউটিতে আছি। যদি দরজা না খোলো তাহলে বাধ্য হয়ে দরজা ভেঙ্গে ঢুকবো।’ জিলানীর এক সহযোগী দরজায় জোরে এক লাথি মারল। পরমুহূর্তেই মোচন এসে দরজা খুলে দিল।
ইন্সপেক্টর জিলানী এবং দুইজন খুব দ্রুত ভেতরে ঢুকে গেল। রিফাত তার বেডরুমের সামনে দাঁড়ানো। তিনজনের হাতে অস্ত্র দেখে সে একটু ঘাবরে গেল।
‘এতক্ষণ আমাদের বাইরে দাঁড়া করিয়ে রাখলেন কেন?’ ইন্সপেক্টরের ক্ষুব্ধকন্ঠ।
‘সরি, আমি বাথরুমে থাকায় কাজের ছেলেটা দরজা খুলতে সাহস পায় নি।’ রিফাত নম্রকন্ঠে জবাব দিল।
দুই সসস্ত্র সহযোগীর একজন মূল দরজার কাছে দাঁড়াল, আরেকজন অবস্থা নিলো রিফাতের বেডরুমের দরজার সামনে। জিলানী রিফাতসহ বেডরুমে ঢুকলেন।
‘আমাদের কাছে খবর আছে আপনি রেজাউদ্দিন সাহেবের স্বাক্ষর জাল করে আপনার নামে তাঁর প্রোপার্টির ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ বানিয়েছেন। ওটা এখনই বের করুন।’ জিলানী বললেন দৃঢ় উচ্চারণে।
‘এটা কী বললেন? এসব মিথ্যে কথা। আমি এ ধরনের লোক নাকি !’
‘আপনি কী ধরনের লোক সেটা একটু পরেই পরিষ্কার হবে। বের করুন ডকুমেন্টটা।’
‘বললাম তো, আমার কাছে এরকম কিছুই নেই।’
ইন্সপেক্টর জিলানী ভাব দেখে বুঝলেন যে তাকে কাবু করতে গেলে শক্তি প্রয়োগ করতে হতে পারে। তিনি রুমের দরজায় দাঁড়ানো তার সহযোগীকে বললেন,‘থানায় ইনফর্ম করো। ফোর্স রেডি রাখতে বলো।’
তৎক্ষণাৎ সে ওয়াকিটকিতে ধানমন্ডি থানায় যোগাযোগ করা শুরু করল।
জিলানী রিফাতকে বললেন,‘আপনি বের না করলে আমাকে সার্চ করতে হবে।’
‘আপনি ভুল সংবাদ শুনে আমার ঘরে ঢুকেছেন। যে জিনিসটা নেই সেটা সার্চ করলে পাবেন কী করে !’ রিফাত জবাবে বলল।
জিলানী এবার আলমারির চাবি চাইলেন। রিফাত জানালো সে নিজেই গতকাল থেকে চাবি খুঁজছে, কিন্তু পাচ্ছে না। একথা শুনে জিলানীর মেজাজ গেলো বিগড়ে। চিৎকার করে মোচনকে বলল,‘এই ব্যাটা এদিকে আয়। আলমারি ভেঙ্গে ফেল।’
রিফাত বুঝলো অবস্থা সম্পূর্ণ তার প্রতিকূলে। অগত্যা সে চাবির গোছা এনে ইন্সপেক্টরের হাতে দিলো।
হঠাৎ রিফাতের মোবাইলে রিং বেজে উঠল। সে রিসিভ করার আগেই ইন্সপেক্টর জিলানী মোবাইলটা কেড়ে নিলেন। দেখলেন, নিধি কল করেছে। তিনি বড় বড় চোখ করে রিফাতের দিকে তাকালেন। সাথে সাথে মোবাইলটা ‘সুইচড অফ’ না করে রিংটোন শেষ হওয়ার পর তা করলেন। এরপর মোবাইল সেটটা তাঁর সহযোগীর হাতে দিলেন।
জিলানী আলমারির নিচটা দেখলেন, উপরটাও দেখলেন। টেবিলে ড্রয়ার, ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারও দেখলেন। বিছানার তোষক-জাজিম উল্টে দেখলেন। কিন্তু এসব জায়গায় পাওয়া গেলো না।
এবার আলমারি খোলা হলো। আলমারিতে চারটা রেক। সবগুলো বামদিকে। রেকের ডানদিকের ফাঁকা অংশের উপরের অর্ধেকে স্যুট-কোট, শার্ট-পাঞ্জাবি ঝোলানোর জন্য এবং নিচের অংশ শাড়ি, কামিজ, সোয়েটার ইত্যাদি ঝোলানোর জন্য রয়েছে হোল্ডার।
একেবারে নিচের রেকে মেয়েদের স্যান্ডেল, হিল-জুতো, হ্যান্ডব্যাগ ইত্যাদি। জিলানী ভেতরে উল্টেপাল্টে দেখলেন। এখানে নেই।
দ্বিতীয় রেকে বেশ কিছু শাড়ি, কামিজ-শেলওয়ার এবং লেডিস আন্ডারগার্মেন্টস। এখানে আন্ডারগার্মেন্টস ব্যাতিরেকে অন্যত্র খোঁজা হলো। পাওয়া গেলো না।
তৃতীয় রেকে কিছু ফাইল এবং কাগজপত্র। বেশিরভাগই রিফাতের কোম্পানির এবং ব্যক্তিগত। এখানে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় জিলানী তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন। কিন্তু যা খুঁজছেন তা পেলেন না।
চতুর্থ রেকে রিফাতের জামাকাপড় ও পুরুষের ব্যবহার্য জিনিস। এখানেও তল্লাশী করা হলো, কিন্তু পাওয়া গেলো না।
উপরের রেকের পেছনে বামদিকটায় একটা লকার। ইন্সপেক্টর জিলানী লকারের চাবি চাইলেন। রিফাত বললো চাবি যা আছে সব একই হোল্ডারে। কিন্তু এই হোল্ডারের কোন চাবি দিয়েই লকার খোলা গেলো না। ইন্সপেক্টর যতবার বলেন লকারের চাবি দেন, ততোবার রিফাত ঐ একই কথা বলে। কাজেই তিনি দেখলেন যে লকার ভাঙ্গা ছাড়া কোন বিকল্প নেই।
লকার ভাঙ্গা হলো। বেশ কিছু স্বর্ণ-গয়না আছে লকারে। হীরের অলংকারও রয়েছে। কিন্তু যে জিনিস প্রয়োজন সেটা নেই। লকারের দুটো তাক। নিচের তাকে রক্ষিত আছে তিনটি গয়নার বাক্স। এগুলোর নিচে একটা মসৃণ কাগজ, ক্যালেন্ডারের কাগজ যেমন মসৃণ থাকে সেরকম।
জিলানী গয়নার বাক্সগুলো সরিয়ে কাগজটা উল্টে দেখবার সময়ে রিফাত বলে উঠল,‘আপনি কিন্তু অন্যায়ভাবে আমার স্ত্রীর লকার খুলেছেন ! তার হীরের একটা নেকলেসও এইমাত্র পকেটে রাখলেন !
ইন্সেক্টরের সহযোগী এটা শুনে ‘কি!’ বলে পিস্তল উঁচিয়ে ধরল। জিলানী তাকে শান্ত থাকতে বললেন। তিনি বুঝলেন যে রিফাত তাঁকে রাগিয়ে দিয়ে তাঁর মনোসংযোগ বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস পাচ্ছে।
জিলানী এবার ওই কাগজটা উল্টালেন। দেখেন এর নিচে রাখা আছে লম্বালম্বি ভাঁজ করা কয়েকটি কাগজ। কাগজগুলো স্টেপলার পিন দিয়ে সংযুক্ত।
জিলানী কাগজগুলো হাতে নিয়ে ভাঁজ খুললেন। ৩০০/- টাকার তিন পাতার ননজুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে টাইপকৃত রিফাত ইসলামের নামে ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’। এই তো সেই কাগজ! নোটারি পাবলিক দিয়ে সম্পাদন করানো। এতে রেজাউদ্দিন সাহেবের জাল স্বাক্ষর। তারিখ লেখা আছে ১৮ জানুয়ারি, শনিবার। রেজা সাহেবের গুম হবার ঘটনা ১৯ জানুয়ারি, শুক্রবার। তার মানে, এতে ঘটনার আগের দিনের তারিখ দেওয়া, যাতে মালিকের বাড়িতে অবস্থানকালীন সময়ে ডকুমেন্ট সম্পাদন হয়েছে এটা প্রকাশ পায়।
জিলানী রিফাতকে কাগজগুলো দেখিয়ে বললেন,‘এটা কী ?’
রিফাতের মুখটা কালো হয়ে গেলো। তথাপি স্থির থাকার চেষ্টা করল।
‘নো আইডিয়া। ওই লকার আমি ইউজ করি না।’ রিফাত জবাব দিল।
ইন্সপেক্টর জিলানী বললেন, ‘শুনুন। আমার বিশ্বাস, রেজাউদ্দিন সাহেবের গুম হওয়ার পেছনে আপনার হাত রয়েছে। তাঁর সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়ার জন্য খসরুকে টাকা দিয়ে আপনি এ কাজ করিয়েছেন, কিংবা খসরুকে বা অন্য কাউকে টাকা দিয়ে খুন করিয়েছেন। এসব অভিযোগ এবং জাল ডকুমেন্ট তৈরি করার অভিযোগে আমি আপনাকে গ্রেফতার করলাম।’
ইন্সপেক্টর রিফাতের সহযোগী এসে রিফাতকে ধরলো। রিফাত এবার চুপচাপ। জিলানী কাজের ছেলে মোচনকে জিজ্ঞেস করে অন্যতম সাক্ষী হিসেবে মোচনের নাম ঠিকানা লিখলেন। জিলানী তাঁর মোবাইলে উদ্ধারকৃত ডকুমেন্টের ছবি নিলেন। রিফাতের আলমারি এবং রুমেরও ছবি তুললেন। সহযোগীকে রিফাতের হাতে হাতকড়া পরানোর নির্দেশ দিলেন।
‘আগে একটু ওয়াশরুমের কাজটা সেরে নিই।’ রিফাত বিনীতভাবে বলল।
‘না। থানায় গিয়ে সারবেন।’ জিলানী বললেন।
‘কী বলেন! ঘুম থেকে উঠে তো বাথরুম করিনি।’
‘কেন, আপনি নিজেই তো বললেন বাথরুমে থাকায় দরজা খুলতে দেরি হয়েছে!’
‘বাথরুমে ঢুকেছিলাম ঠিক, কিন্তু কিছু করা হয়নি।’
‘আপনার কথা বিশ্বাস করি না। নিচে চলুন।’
‘ঠিক আছে চলুন। যখন জীপের ভেতর সব ছেড়ে দেবো তখন যেন কিছু না বলেন।’
জিলানী ভাবলেন, বদমায়েশটা সত্যিই যদি তাই করে ! জীপ নষ্ট করার চেয়ে বরং তাকে পাঁচ/ দশ মিনিট সময় দেওয়া শ্রেয়। বললেন, ‘ঠিক আছে। সময় পাঁচ মিনিট।’
রিফাত বাথরুমে ঢুকল।
দশ/ বারো মিনিট পার হয়ে গেছে। রিফাত ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছে না। জিলানী কান পেতে দেখলেন কোন সাড়া-শব্দ নেই। জিলানী তাঁর সহযোগীর দিকে তাকালেন। সে বলল,‘স্যার ব্যাটা সুইসাইড করলো না তো ?’
জিলানীর সন্দেহ হলো। বললেন, ‘দরজা ভাংগো।’
দরজা ভাঙা হলো। ‘কোথায় রিফাত ? ওয়াশরুমে তো কেউ নেই !’ জিলানী চিৎকার দিয়ে উঠলেন। ভেতরে ঢুকলেন দুজন। দেখেন, ওয়াশরুমের থাই অ্যালুমিনিয়াম-গ্লাসের জানালাটা নিচে খুলে রাখা। জানালায় কোন গ্রিল লাগানো নেই। তার মানে সে বুঝতে পেরেছিল যে কোন সময়ে অ্যারেস্ট হতে পারে !
‘রিফাত ওয়াশরুমের পেছনের মেইন পাইপ দিয়ে নেমে যাচ্ছে।’ বলেই জিলানী জীপের ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে উচ্চস্বরে বলল,‘এক্ষুনি গাড়ি নিয়ে পেছনে যাও। সাসপেক্ট বাথরুমের পাইপে আছে। আটকাও।’
জীপটা স্টার্ট দিলো তৎক্ষণাৎ। দরজায় অবস্থান নেয়া সহযোগীও ইতোমধ্যে নিচে নেমে গেছে।
ইন্সপেক্টর জিলানী তাঁর এই সহযোগীকে বললেন, ‘তুমি এখানে থাকো। বলা তো যায় না, সে যদি আবার পাইপ দিয়ে উঠে ওয়াশরুমের জানালা দিয়ে এখানে চলে আসে ! ‘
দুই মিনিটের মধ্যে ইন্সপেক্টর জিলানী বাড়ির পেছন দিকটায় পৌঁছুলেন। জীপটাও সেখানে।
জিলানী দেখেন সিকিউরিটি গার্ড তথা সিআইডি’র এজেন্ট রুস্তম পাইপের নিচে দাঁড়িয়ে উপরে পিস্তল তাক করে আছে। অন্যদিকে পাইপের কিছু উপরে, নিচের দিকে তাকিয়ে ঝুলে আছে জিলানীর সাসপেক্ট রিফাত।
চলবে….