বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ১১

সিআইডি অফিস। তিনতলায় ‘হ্যান্ডরাইটিং এক্সপার্ট’এর যে রুমটা, ঠিক তার বিপরীতেই ইন্সপেক্টর জিলানীর রুম। আগে দুইজন ইন্সপেক্টর এই রুমে বসতেন, এখন জিলানী একাই। রুমটা যে খুব ডেকোরেটেড তা নয়, তবে একটু প্রসস্ত। একজন অফিস সহায়ক তাঁর সাথে সংযুক্ত করা আছে।
জিলানীর কক্ষে একটি পুরাতন সেক্রেটারিয়েট টেবিল। টেবিলে নতুন ডেস্কটপ কম্পিউটার। অবশ্য তাঁর ব্যক্তিগত ল্যাপটপও আছে একটি। অতি গোপনীয় এবং অতি গুরত্বপূর্ণ কাজে সেটাই ব্যবহৃত হয়। সাধারণ টাইপিং, প্রিন্টিং, মেইলিং, ওয়েব ব্রাউজিং ইত্যাদির জন্য তিনি ডেস্কটপ ব্যবহার করেন। বিনোদনমূলক কোন কিছুই তিনি অফিসের কম্পিউটারে ব্রাউজ করেন না।
টেবিলের ওপর অগুনতি কাগজপত্র। সব ছড়ানো ছিটানো। ইন্সপেক্টর জিলানী একবার এ কাগজটা দেখছেন, আরেকবার ওটা। আবার নিজের মোবাইলেও ঢুকে যাচ্ছেন। একপাশে রয়েছে একটা টেবিল ল্যাম্প। সেটা জ্বলছে। টেবিলটা চড়া আলোয় আলোকিত। জিলানী টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে কাজ করতে পছন্দ করেন। তাঁর ধারণা, এতে একনিষ্ঠ মনোনিবেশ ঘটে।
জিলানী উঠলেন। ফ্যানের স্পিড কমিয়ে দিলেন। পেছনে গিয়ে ইজি চেয়ারে বসলেন। পা দুটো টান টান করে ঋজু শরীরটা এলিয়ে দিলেন। এতক্ষণ কাজে নিবিষ্ট থাকায় টের পান নি যে তাঁর শিরদাঁড়ায় কিঞ্চিৎ টান পড়েছে। মাথার চুল একে তো অবিন্যস্ত, ফ্যানের হাওয়ায় তা আরও নয় ছয় অবস্হা। এবার একটা সিগারেট ধরালেন।
ধোঁয়া ছাড়ছেন আর ভাবছেন : এটা নিশ্চিত, ওই টাকা খসরুর নিজের উপার্জিত নয়। হয় সে চুরি করেছে নয়তো কেউ তাকে দিয়েছে। কেননা নিজের টাকা হলে, এক— পঞ্চাশ হাজার টাকার বান্ডিল কলসের ভেতরে লুকিয়ে রাখতো না ; দুই— বাবা অথবা দাদিকে জানাতো, তিন— নিজে আত্মগোপন করে থাকতো না।
ফ্রিজ ক্রয়ের টাকা যোগ করলে বোঝা যায় টাকা নিয়েছে এক লাখ। ওই টাকা যখন হাতে আসে তখন খসরু রেজাউদ্দিন সাহেবের বাড়ির বাগানে ড্রেন নির্মাণ কাজে নিয়োজিত ছিল। সেই বাড়ির কারও ঘর অথবা ভাড়াটে রিফাতের ঘর থেকে চুরি করে থাকলে কেউ না কেউ চুরির অভযোগ করতো। কেউ করে নি।
তাহলে টাকাটা কেউ দিয়েছে। কথা হলো, এক লক্ষ টাকা তো একজন শ্রমিকের জন্য অনেক টাকা ! এতো টাকা বিনা স্বার্থে কে দেবে এবং কেন দেবে ? আর সেই স্বার্থ অথবা কু-মনোবৃত্তিটা কী ? এটা বের করার জন্য খসরুকে প্রয়োজন। যে করেই হোক ওই খসরুকে খুঁজে পেতে হবে। তাকে ধরে এনে ‘ট্যাকটিকাল ইন্টাররোগেশন’ করতে হবে।
ইন্সপেক্টর জিলানীর মাথায় ইতোমধ্যে ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে বেশ কয়েকটি ‘পয়েন্ট অব সাসপিশন’।
ফোনের রিং বাজছে। জিলানী উঠে গিয়ে রিসিভারটা তুললেন। ‘এসএস (স্পেশাল সুপারিনটেন্ডেন্ট) ক্রাইম’ সাহেব ইন্সপেক্টর জিলানীকে তাঁর রুমে ডেকেছেন। আর্জেন্ট।
আজ সকালে নতুন সিকিউরিটি গার্ড রুস্তম রিফাতের গাড়ি বের হবার সময়ে গেটে আটকে দেয়। রিফাত তার গাড়ি নিজেই চালায়। তিনি কে, কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন ইত্যাদি প্রশ্ন করে রুস্তম তাকে অফিসে বিলম্ব করিয়েছে। সে নতুন একটা খাতা বানিয়েছে। তাতে রিফাতের নাম, ঠিকানা ও বের হওয়ার সময় লিখিয়ে তারপর তাকে গেট থেকে বের হতে দিয়েছে।
সে কারণে রিফাত ইসলাম চটে আছে। সে নিধিকে ফোন করে বলেছে যে তাকে অসম্মান করা হয়েছে। ওদিক থেকে নিধিও জানিয়েছে যে তাকেও দোকানে যাবার সময়ে নাম-ধাম-সময় এন্ট্রি করে গেট থেকে বের হতে হয়েছে। আবার ফেরার সময়ও খাতায় সময়টা লিখতে হয়েছে। কিছু করার নেই। নিরাপত্তার স্বার্থে এটা মেনে নিয়ে সবাইকে ইন এবং আউট হতে হবে।
সে কারণে রিফাত ইসলাম চটে আছে। সে নিধিকে ফোন করে বলেছে যে তাকে অসম্মান করা হয়েছে। ওদিক থেকে নিধিও জানিয়েছে যে তাকেও দোকানে যাবার সময়ে নাম-ধাম-সময় এন্ট্রি করে গেট থেকে বের হতে হয়েছে। আবার ফেরার সময়ও খাতায় সময়টা লিখতে হয়েছে। কিছু করার নেই। নিরাপত্তার স্বার্থে এটা মেনে নিয়ে সবাইকে ইন এবং আউট হতে হবে।
পূর্বেকার দারোয়ানকে বিদায় করে দেবার পর রিফাতের কাজের ছেলে মোচন রাতে গেট বন্ধ করা এবং সকালে খুলে দেওয়ার কাজ করে আসছিল। রুস্তম এরই মধ্যে মোচনের সাথে ভাব জমিয়েছে। যেন কতো দিনের চেনা !
বিকেলে ড্রাইভার পিন্টু এসে গেটে আটকা পড়ে। তাকে রুস্তম চেনে না। পিন্টু নিধিকে ফোন লাগায়।
‘কে এই নতুন দারোয়ান ? আমাকে ঢুকতে দিচ্ছে না, সাহস দেখো তার !’
‘মাইন্ড করো না। সে গতকাল জয়েন করেছে। ইন্সপেক্টর জিলানী ব্যবস্হা করে দিয়েছে। এ বাড়ির সিকিউরিটির জন্য।’
‘ও তাই ?’
‘আমি তাকে বলে দিচ্ছি। তুমি খাতায় এন্ট্রি করে চলে এসো।’
পিন্টু এসে চা চাইলো। নিধি চা করে দিলো। নিধি আজকের খবরের কাগজটা দেখিয়ে বলল,
‘এসব কী হচ্ছে বলো তো ?’
‘কেন, কী হচ্ছে ?’
‘ইট-সিমেন্টের কাজ করেছে না খসরু ? সে নাকি পলাতক।’
‘তা তো আমিও শুনেছি।’
‘খবর আরও আছে। খসরুর ঘর সার্চ করে নাকি নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা, আর একটা সদ্য কেনা ফ্রিজ উদ্ধার করেছে ! ফ্রিজের দামও নাকি পঞ্চাশ হাজার টাকা !’
‘বলছো কী ? কে উদ্ধার করেছে ?’
‘সিআইডি। নেতৃত্ব দিয়েছে ইন্সপেক্টর জিলানী।’
শুনে পিন্টু চিন্তিত হয়ে পড়লো। মিন মিন করে বলল,‘কাল তো আমাকে সিআইডি অফিসে যেতে বলেছে। এ ব্যাপারে আবার জিজ্ঞেস টিজ্ঞেস করবে নাকি ?’
‘করলে করবে। তুমি কি এ ব্যাপারে কিছু জানো ?’
‘না তো।’
‘তাহলে ? আমিও তো জানি না। দুশ্চিন্তার এমন কী আছে !’
‘শুনেছি খসরুর বাড়ি সাভারে। ইন্সপেক্টর চিনলো কিভাবে ?’
‘সিআইডি’র কতো এজেন্ট থাকে। তারাই হয়তো খোঁজ নিয়ে চিনিয়েছে।’
কিছুক্ষণ দুজনেই নীরব। তারপর আবার কথা চলল।
‘আচ্ছা’, …. পিন্টু কিছু বলতে যেয়ে থেমে গেল। নিধি এটা লক্ষ্য করে বলল,‘থেমে গেলে যে ? কী বলতে চাইছিলে ? বলো।’
‘রিফাত সাহেব খসরুকে টাকা দেয় নি তো ?’ পিন্টু নিচু গলায় বললো।
‘কি জানি ! কিন্তু সে খসরুকে এক লাখ টাকা দিয়ে কী কাজ করাবে ?’
‘রিফাতের সাথে তো রেজাউদ্দিন স্যারের সম্পত্তি নিয়ে অনেক কথাকাটাকাটি শুনেছি। যখন রেজা সাহেবে স্পষ্ট কথা বলতে পারতো।’
‘হ্যাঁ, তো ? খসরু কী করতে পারে ? তুমি কি মনে করো খসরু খালুজানকে সাথে নিয়ে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে ?’
‘জানি না নিধি। আমার মাথা কাজ করছে না।’
‘কাজ করবে কিভাবে ! তোমার যে মাথা !’ নিধি অনেকটা ব্যঙ্গ করে বলল।
পিন্টু আবার টেনশনে পড়ে গেল।
নিধি পিন্টুর দিকে তাকিয়ে তার চোখ মুখের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করছে। এসময় দেখলো ড্রয়িং রুমের খোলা জানালার বাইরে একজনের মুখ। নিধি উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কে ওখানে ?’ তারপর দ্রুত দরজাটা খুললো। দেখে সামনে রুস্তম দাঁড়ানো।
‘তুমি এখানে কেন ?’ নিধি বিরক্তিসহ জিজ্ঞেস করল।
‘ম্যাডাম। এক লোককে আপনার এখানে ঢুকতে দেখেছি কিন্তু বের হতে দেখছি না। ভাবলাম আপনি ঠিক আছেন কিনা।’ রুস্তম উত্তর দিলো।
‘হ্যাঁ আমি ঠিক আছি। তোমাকে তো বলেছি উনি ড্রাইভার সাহেব। আমাদের লোক।’
‘জী আচ্ছা।’
‘আর শোনো। এভাবে জানালা দিয়ে কখনো উঁকি দেবে না। ঠিক আছে ?’
‘ঠিক আছে ম্যাডাম।’
নিধি রেগেমেগে সজোরে ‘ঠাস্’ করে দরজাটা বন্ধ করলো। সশব্দে পুরো ড্রয়িং রুম কেঁপে উঠলো। তারপর জানালা বন্ধ করে পর্দাটা ভালোভাবে টেনে দিলো।
এতে ড্রাইভার পিন্টুর টেনশন আরও বেড়ে গেলো। সে মনে মনে বললো, ‘কার কপালে যে কী আছে !’
চলবে….
আরও পড়ুন :
বিধ্বংসী প্রহর,পর্ব-১
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ২
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ৩
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৪
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৫
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৬
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৭
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৮
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৯
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ১০