বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ১০

আজ বাসায় একটু তাড়াতাড়িই ফিরলেন ইন্সপেক্টর জিলানী। বিকেলটা এখনও লালচে হয়নি। বাইরে ঝিরি ঝিরি হাওয়া। ঘরে ঢুকে হাতের ব্রিফকেসটা চেস্ট অব ড্রয়ারসের উপরে তুলে রাখলেন। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে গুণ গুণ গাইতে শুরু করলেন….ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু। পেছন থেকে তাঁর স্ত্রী সাজিয়া যোগ করলো….পড়ি যদি পিছিয়ে। এবার উভয়ে এক সাথে মেলালো….পিছিয়ে পড়ি কভু।
দুজনার আলাপ চলল :
‘তোমার মুডটা আজকে বেশ ভালো মনে হচ্ছে !’
‘রাইট। কেন, তোমার মুড ভালো নেই ?’
‘তা না, আসল কথা হলো, তোমার মুখটা হাসি হাসি দেখলে আমার মনটাও ভালো হয়ে যায়। আবার গোমড়ামুখ দেখলে মনটা খারাপ হয়ে যায়।’
কথাগুলো জিলানীর ভালো লাগলো। ঠিকই তো, এতে একটা মনস্তাত্বিক দিক রয়েছে। বললেন,
‘আমারও তাই হয়।’ এরপর স্ত্রীর চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘অবশ্য তোমাকে আমি গোমড়ামুখ করতে তেমন একটা দেখিই না।
এ কথা শুনে সাজিয়ার চোখে মুখে স্মিতহাসি। সে জানে তার স্বামীর সাথে কথায় পেরে উঠা মুশকিল।
জিলানী সাজিয়াকে স্বত:স্ফূর্তভাবে বললেন,
‘একটা গান শোনাও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’
সাজিয়া খুশি হলো অনুরোধটা শুনে। গানের শ্রোতা পাওয়া গেলো। শ্রোতা না থাকলে শিল্পীর মূল্য কী ! বলল,‘তাই ? আচ্ছা, এই ফাঁকে আমি তোমার চা’ও করে আনছি।’
দুজন বেডরুমে খাটের উপর বসে পড়ল। স্ত্রীর সামনে হারমোনিয়াম, স্বামীর হাতে এক মগ চা।
সাজিয়া জিজ্ঞেস করলো, ‘কোনটা গাইবো বলোতো ?’
‘ওইটা— একটুকু ছোঁয়া লাগে।’ জিলানী বললেন।
সাজিয়া হারমোনিয়ামের টিউন ঠিক করে গাইতে শুরু করল—
একটুকু ছোঁয়া লাগে
একটুকু কথা শুনি,
তাই নিয়ে মনে মনে
রচি মম ফাল্গুনী ।।
মায়ের গানের কন্ঠ শুনতে পেয়ে পাশের রুম থেকে ছেলে নাভিদও এসে যোগ দিলো। জিলানী মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সাজিয়ার গান শুনলেন। গান শেষ হলে হাততালি দিলেন। নাভিদও।
জিলানী বললেন, ‘দেখো এই যে কথা- ‘রচি মম ফাল্গুনী’— এখানে ফাল্গুনী সুরটা, ফাআআ..লগুনী, সিম্পলি অসাধারণ ! তুমি এটা কতো সুন্দর করে তুললে ! অনেকেই এভাবে পারে না।
জিলানীর কথায় সাজিয়া খুশি হলো। সাথে সাথে ধন্যবাদ জ্ঞাপণ করলো। উভয়ের কথা চলল :
‘মনে আছে তোমার প্রথম কোন্ গানটা আমি শুনেছিলাম ?’
‘হ্যাঁ। নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থপাখিরা বুঝিবা পথ ভুলে যায়।’
‘ঠিক।’
ছেলেকে বললো, ‘আব্বু তুমি একটু টাইম দাও।’
নাভিদ বুঝল। সে উঠে নিজের রুমে গেলো এবং তার ডেস্কটপে মনোনিবেশ করল।
জিলানী সাজিয়াকে বললেন,‘এক অনুষ্ঠানে ওই গানটা শুনেই তো তোমার প্রেমে পড়েছিলাম। কী যে মিষ্টি করে গেয়েছিলে !’
সাজিয়ার ঠোঁটে তরুণীর মতো সলজ্জ হাসি। বলল,‘আমার মনে আছে। এটা তুমি আগেও বলেছো। এখন তো রবীন্দ্র সঙ্গীতই শোনো বেশি।’
‘তার মানে কি বুড়িয়ে গেছি ?’
‘না, সঙ্গীতবোদ্ধা হয়েছো। বুড়ো হওয়াটা শরীরে নয়, মনে।’
জিলানী মৃদু হাসলেন। স্ত্রীকে বললেন, ‘থ্যাংকস্। আসলে তুমি আমার চেয়ে বেশি ইন্টেলিজেন্ট।’
সাজিয়ার মনে পড়লো যে একটা ফোন এসেছিল। বলল,‘শোনো, লাঞ্চ আওয়ারে তোমার একটা কল এসেছিল ল্যান্ডফোনে।’
‘কে করেছিল ?’
‘নাম বলে নি। তুমি আছো কিনা জিজ্ঞেস করেছিল। আমি নাম্বার টুকে রেখেছি।’
সাজিয়া জিলানীকে নাম্বারটা দেখাল। সে সব সময় ল্যান্ডফোনে অপরিচিত কল এলে তার ফোন নাম্বার টুকে রাখে। পাশে সময়টাও লিখে রাখে। এ অভ্যাসটা সে তার গোয়েন্দা স্বামীর কাছ থেকে পেয়েছে। অবশ্য তাদের ল্যান্ডসেটে কলার আইডি সিস্টেম রয়েছে।
জিলানী ওই নাম্বারে কল করলে। ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো।
‘স্যার আমি। এখন যাচ্ছি। স্যার, যদি অ্যাক্সেপ্ট না করে ?’
‘আমাকে মিসকল দেবে। যাও।’
ইন্সপেক্টর জিলানী রিসিভার রেখে দিলেন।
শেষ বিকেলে নিধি দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। একটু আগে টবের গাছগুলোতে পানি দেওয়া শেষ করেছে। সকালে দিতে পারে নি। পানি না পেলে গাছগুলো নেতিয়ে পড়ে। খাবার চায়। ঠিক শিশুর মতো। শুধু কান্নাটাই জানে না।
আজ পিন্টু এসেছিল। তার মায়ের হার্টে একটা রিং পরানো হয়েছে। মা এখন বাসায়। পুরো টাকা খরচ না হওয়ায় নিধিকে এক লক্ষ টাকা ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। ইন্সপেক্টর জিলানী তাকে সিআইডি অফিসে যেতে বলেছেন। সে কারণে পিন্টুর চিন্তার শেষ নেই।
নিধি দেখে গেট দিয়ে এক লোক হেঁটে আসছে। সুঠামদেহী।
কিন্তু কে সে ?
লোকটা কাছে এসে নিধিকে সালাম করলো। বলল,‘ম্যাডাম, আপনাদের গেট আছে কিন্তু দারোয়ান নেই। নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। আমি সিকিউরিটি গার্ডের কাজটা করতে চাই। আমার বিভিন্ন বাড়িতে সিকিউরিটির কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। ট্রেনিংও আছে। আপনি খুশি হয়ে যা দেবেন তাই নেবো।’
কথাগুলো শুনে নিধি বললো, ‘আমার তো প্রয়োজন নেই।’
লোকটা বলল, ‘একটু ভেবে দেখুন ম্যাডাম।’
নিধি উত্তর দিল, ‘ভাবার কিছু নেই। আমাদের লোক আছে। তাছাড়া আপনাকে তো আমি চিনি না।’
লোকটি পকেট থেকে এনআইডি কার্ড বের করে দেখালো। নিধি বলল, ‘ঠিক আছে, ফোন নাম্বার দিয়ে যান, প্রয়োজন হলে বলব।’
লোকটি তার মোবাইলে একজনের নাম্বার মিলিয়ে কেটে দিল। পরমুহূর্তেই নিধির মোবাইল সেটে রিং বাজল। নিধি নতচোখে দেখলো ওটা ইন্সপেক্টর জিলানীর কল। সে কলটা রিসিভ করল।
‘সালাম আলাইকুম।’
‘কেমন আছেন ?’
‘এই তো, ভালো আছি। খালুজানের সন্ধান কতদূর স্যার ? কোনো ক্লু পেলেন ?’
‘আপনি আমার সাথে আছেন তো ?’
‘এটা কী কথা বললেন ? অবশ্যই আছি। ঘটনার পর থেকে একলা এই বাড়িতে কিভাবে দিন কাটছে বোঝাতে পারব না !’
‘আমি জানি। শুধু দিন তো নয়, দিন গেলে রাতও তো আসে ! সেটাই আপনার জন্য বেশি ইনসিকিওরড।’
‘ঠিক বলেছেন। সাংবাদিকসহ অনেকেই আসে। হ্যাঁ, সন্ধ্যার পরও আসে। কলিং বেল চাপে। তখন বেশ বিরক্ত লাগে।’
‘আপনার নিরাপত্তা নিয়ে আমরাও চিন্তিত। সে জন্য সিকিউরিটি ট্রেনিং নেয়া আছে এমন একজনকে বলেছিলাম আপনার সাথে দেখা করতে। তার নাম রুস্তম। এসেছে ?’
নিধি তার সামনে দন্ডায়মান লোকটার দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করল,‘আপনার নাম কী ?’
‘রুস্তম।’
‘আপনাকে কে পাঠিয়েছে ?’
‘জিলানী স্যার।’
নিধি এবার জিলানীকে বলল, ‘ওনাকে আপনি পাঠিয়েছেন ?’
‘হ্যাঁ। গেটম্যানের কাজ ছাড়াও সে আপনার বাড়ির নিরাপত্তার কাজও করবে।’
নিধি একটু হাসল। বলল,‘আমার বাড়ি বলছেন কেন ? আমি তো এ বাড়ির কেয়ারটেকার মাত্র। এটা হলো আমার কর্মস্থল।’
‘বাহ্! সুন্দর করে বলেছেন।’
‘শুনুন, রাতে গেট বন্ধ করা এবং সকালে খুলে দেওয়ার কাজ তো অলরেডি একজন করছে।’
‘কে ?’
‘রিফাত সাহেবের কাজের ছেলে।’
‘ওইটুকুতে আপনার সিকিউরিটি এনশিওর করা যাবে না। ক্রিমিনালরা আপনার ক্ষতি করতে পারে। এমন কি আপনার জীবনের ঝুঁকিও রয়েছে। রুস্তমকে রেখে দিন। তাকে যত দ্রুত দায়িত্ব দেবেন ততোই মঙ্গল। অন্য কিছু হলে পরে আমাকে কিন্তু বলতে পারবেন না। আচ্ছা এখন রাখি।’
জিলানী ফোন রেখে দিলেন। তাঁর বিশ্বাস, নিধি তাঁর কথার বাইরে যাবে না।
নিধি কিছুক্ষণ ভাবল। রিফাতকে রিং করে বিষয়টা জানাল। তার মতামত চাইল। সব শুনে রিফাতও অসম্মতি জানাতে পারল না।
নিধি অতঃপর রুস্তমকে বলল,‘ঠিক আছে। আপনি কাজ বুঝে নিন।’
‘থ্যাংক ইউ ম্যাডাম! কবে থেকে?’
‘এই সন্ধ্যা থেকেই।’
চলবে…..