বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৯

ইন্সপেক্টর জিলানী। একজন সপ্রতিভ, সাহসী, প্রত্যুৎপন্নমতি, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও দৃঢ়চেতা গোয়েন্দা কর্মকর্তা। যাঁর নিজ পেশার ঝুলিতে ব্যর্থতা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কঠিন রহস্যের জাল নিপুণ হাতে ছিন্ন করতে সিদ্ধহস্ত তিনি। ঠাণ্ডা মাথায় তাঁর গরম খুন।
জিলানী মিশনে। এই কেসের প্রথম মিশন। তাঁর কোমরে রয়েছে ‘কোল্ট’ রিভলভার। ছুটে চলেছেন জীপে। দুই সহযোগী রয়েছে তাঁর সাথে। গন্তব্যস্থল সাভার।
এসআই রাজিব যেদিন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রাজমিস্ত্রী এবং হেলপারকে আসতে বলেছিলেন, সেদিন রাজমিস্ত্রী তমিজ এলেও তার হেলপার খসরু আসেনি। শুধু তাই নয়, সেই দিন থেকে তার মোবাইল সুউইচড অফ। রাজিবের সঙ্গে আলোচনা করে এবং তার নোট পড়ে ইন্সপেক্টর জিলানী নিশ্চিত যে ‘দাল মে কুছ কালা হ্যায়’ !
বরফ ভাঙতে হবে। হেলপার খসরুকে প্রয়োজন। সাভারে তার বাড়ি চেনাবার জন্য সাভারেরই আরেকজনকে জীপে তুলে নেয়া হয়েছে। সে হচ্ছে রাজমিস্ত্রী তমিজ। গোপনীয়তা রক্ষার জন্য তমিজের মোবাইলটা নিয়ে নেয়া হয়েছে। সাভার থানাতেও আগাম কোন ইনফরমেশন দেওয়া হয়নি।
দুপুর একটা বেজে কুড়ি মিনিট। জীপটা সাভার বাজারে রেখে চারশ’ গজ পেছনে গ্রামে হেঁটে এলো চারজন। এই গ্রামেই খসরুদের বাড়ি। আজ দুপুর দু’টার দিকে খসরু আসবে- এ খবরটা ইন্সপেক্টর জিলানী তমিজের কাছ থেকেই সংগ্রহ করেছেন। তারপর ছদ্মবেশী সোর্স লাগিয়ে রেখেছেন বাড়ির আশপাশে।
তমিজ বার বার ভেবেও কূল পায় না রেজাউদ্দিন সাহেবের নিখোঁজ হওয়ার সাথে এই গরিব বেচারা খসরুর কী সম্পর্ক! তার কারণে সে নিজে না আবার বিপদে পড়ে ! যদিও এসব বিষয়ে সে কিছুই জানে না।
ইন্সপেক্টর জিলানী তাঁর সোর্স দুজনকে ফোন লাগালেন। দুজনই বললো যে তারা সকাল থেকে ওয়াচ করছে, খসরু এখনও আসে নি। জিলানী এবার গাছপালার ভেতরে এমন জায়গায় দাঁড়ালেন যেখানে তাঁকে কেউ দেখতে পায় না কিন্তু তিনি দেখতে পান। খসরুর বাড়ির প্রবেশপথও এখান থেকে দৃশ্যমান। সহযোগী দু’জনকে বাড়ির দু’দিকে এরকম অদৃশ্য অবস্থান নিতে বললেন। রাজমিস্ত্রী তমিজকে ইন্সপেক্টর নিজের কাছে রাখলেন।
দুপুর তিনটা। অনেকক্ষণ হয়েছে। খসরুর কোনো খবর নেই। ইন্সপেক্টর জিলানী এবার তমিজকে আগে পাঠালেন খসরুদের ঘরে গিয়ে খোঁজ নেবার জন্য। ঘরটা তার পিতামহের আমলের। টিনশেড, নড়বড়ে। তমিজ ঘরে ঢুকলো।
ঘরের ভেতরে বুড়ো দাদি। দাদির ক্ষীণদৃষ্টি। খসরুর মা নেই। বাবা আছে। আছে ছোট এক ভাই। তমিজকে দেখে দাদি আওয়াজ দিল,
‘ক্যাডা ? তমিজ না ?’
‘হ দাদি। কেমন আছো ?’
‘আল্লায় রাখছে।’
‘চাচায় কই ? নিরু কই ?
‘বাপ-পুতে গ্যাছে উপজেলা হাসপাতালে। নিরুর এট্টা আংগুল থ্যাতলাইয়া গ্যাছে কপাটের বারি খাইয়া।’
তমিজ ঘরের এদিক ওদিক তাকালো। ঘরে আর কেউ নেই। জানালা দুটোই বন্ধ।
হঠাৎ ইন্সপেক্টর জিলানী ঘরের ভেতরে ঢুকলেন। সাথে এক সহযোগী। আরেকজন বাইরে। জিলানী ঘরের ভেতরটা ভালো করে দেখলেন। এই বৃদ্ধা এবং তমিজ ছাড়া আর কেউ নেই। বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘আপনি খসরুর দাদি ?’
‘হ, দাদি।’ বৃদ্ধা বললেন। পরক্ষণেই বললেন,
‘তুমি ক্যাডা ?’
‘আমি ঢাকা থেকে এসেছি। খসরু এবং তমিজকে দিয়ে কিছু ইটের গাঁথনির কাজ করাবো।’
‘খসরুরে পাইবা কই ? হ্যায় এইহানে থাহে না।’
‘তাই নাকি ? এখন কোথায় থাকে ?’
‘ক্যাডায় কইবো !’
‘কতদিন যাবত থাকে না ?’
‘সাতারো/ আডারো দিন হইবো।’
ইন্সপেক্টর জিলানী বৃদ্ধার কথার সাথে সময়ের ব্যবধানের মিল পেলেন। ঠিক সতের দিন আগে হেলপার খসরুকে এসআই রাজিব জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় যেতে বলেছিল। কিন্তু সে যায়নি। তিনি তমিজকে চোখ দিয়ে ইশারা করলেন। তমিজ বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করলো,
‘আইজ এই বেলা না খসরু আইবো কইছিলো ?’
‘আমি জানি না। কার ধারে কইছে ? তয় হ্যায় কই ?’
ইন্সপেক্টর জিলানী বুঝলেন যে ওই সংবাদটা ‘অথেনটিক’ নাও হতে পারে। খসরু কোথাও গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে।
জিলানী লক্ষ্য করলেন, ঘরে একটা নতুন ফ্রিজ। নিজে ফ্রিজটা খুললেন। একেবারে নতুন। ঘরের যে হাল, এবং জিনিসপত্র ও আসবাবের যে শ্রী, তার সাথে এই নতুন ফ্রিজ একেবারেই যায় না ! তিনি তার সহকর্মীকে বললেন, ‘সার্চ করো।’ জিলানী নিজেও তল্লাশী করা শুরু করলেন। এটা দেখে বৃদ্ধা চিৎকার করার আগেই জিলানী বললেন, ‘আমরা সিআইডির লোক।’
বৃদ্ধা চুপ।
পেছনদিকে বাঁশের মাচার নিচে মাটির একটা পুরনো কলস। সেটা তুলে আনা হলো। তার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে কয়েকটি টুকরো কাপড়ের নিচে একটা চওড়া বিস্কুটের প্যাকেট পাওয়া গেলো। ইন্সপেক্টর জিলানী ওটা সবার সামনে খুললেন। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা পাঁচশ’ টাকা নোটের বান্ডিল।
জিলানী বৃদ্ধাকে বললেন, ‘দেখুন, এই প্যাকেটে পঞ্চাশ হাজার টাকা পাওয়া গেছে। আপনি কি এই টাকার কথা জানতেন? আপনার ছেলে জানতো?’
‘কি কও বাবা ! আমি এইডা জানিনা, আমার পোলায়ও না। আমি জিগাইছিলাম এইডা কি ? আমারে কইছিলো দাদি, এই প্যাকেটের ভিত্রে বিস্কুট আছে। পরে আইয়া খামু। আর তো আইলো না !’
বৃদ্ধা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন।
জিলানী জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে বলেছিল ?’
বৃদ্ধা জবাব দিলেন, ‘আমার বরো নাতি, খসরু।’
জিলানী বললেন, ‘এই নতুন ফ্রিজ কে কিনেছে ?’
‘খসরুই।’ বৃদ্ধা জানালেন।
‘কতদিন আগে ?’
‘এই… উন্নিশ/ কুড়ি দিন হইবো।’
জিলানী হিসেব মিলিয়ে দেখলেন, ‘রেজাউদ্দিন সাহেব লাপাত্তা হয়েছেন আজ একুশ দিন। তার মানে তাঁর নিখোঁজ হওয়ার পরদিনই ফ্রিজটা কেনা হয়েছে ! ফ্রিজের বাজারমূল্য আনুমানিক পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা।
ইন্সপেক্টর জিলানী বললেন, ‘একজন লেবারের হঠাৎ এতো টাকা (এক লক্ষ) পেয়ে যাওয়া এবং তারপর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে থাকার অর্থ হলো এ টাকাটা অবৈধ এবং এর পেছনে খসরুর কোন অপরাধমূলক কাজ জড়িত। আমি এ টাকা ও ফ্রিজ জব্দ করলাম। ফ্রিজ আপনার জিম্মায় রেখে যাচ্ছি, টাকাটা সাথে নিয়ে যাচ্ছি।
ইন্সপেক্টর জিলানী একটা জব্দ তালিকা করলেন, জিম্মানামা করলেন। উপস্থিত সবার স্বাক্ষর/আঙ্গুলের ছাপ নিলেন। জিলানী তাঁর স্বাক্ষরিত একটি কাগজ ফ্রিজের গায়ে লাগিয়ে দিলেন। তারপর তমিজকে ফ্রি করে দিয়ে জীপ নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। তখন মসজিদের মাইকে আসরের আযান হচ্ছিল।
রিফাত ইসলাম এইমাত্র নিধির সাথে কথা বললো। তারপর নিধিও বললো পিন্টুর সাথে। রিফাতের হাতে দুটো পত্রিকা। বিলম্বে হলেও পত্রিকায় চোখ পড়েছে। সে বার বার প্রথম পৃষ্ঠার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে।
বিষয়টা হলো— আজ বেশ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার অন্যতম শিরোনাম এইরূপ :
‘মেয়ে নিখাঁজ বাবা গুম: ব্যবধান দুই দিন’
‘বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রেজাউদ্দিন রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ : তদন্তে সিআইডি’
‘গুম না খুন ? নিবিড় অনুসন্ধানে গোয়েন্দা’
‘চাঞ্চল্যকর ঘটনা : নিজ বাড়ি থেকে বৃদ্ধ ও অসুস্হ রেজাউদ্দিনের অপহরণ’
[চলবে]
আরও পড়ুন :
বিধ্বংসী প্রহর,পর্ব-১
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ২
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব- ৩
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৪
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৫
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৬
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৭
বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৮