বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৮

মিষ্টি মিষ্টি পাখির ডাক। ভোরের এই পাখির ডাক সাজিয়ার মনকে টানে। আজকের ভোরটা যেন অন্যরকম— হিম হিম, মায়া মায়া। সাজিয়ার ভোরে ওঠার অভ্যেস আগে থেকেই। তার মতে ভোরের স্নিগ্ধ সৌন্দর্যই যে উপভোগ করলো না তার জীবনটা নির্ঘাত অপূর্ণতায় পূর্ণ।
সাজিয়া ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। শীতল হাওয়া গায়ে মাখে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তির তির করে সূর্য উঠতে দেখে। ক্রমান্বয়ে কমলা রঙের রোদে ছেয়ে যায় প্রকৃতি, শক্তিসঞ্চার হয় জীববৈচিত্রে।
সাজিয়া হলো ইন্সপেক্টর আর কে জিলানীর মিসেস। সোজা বাংলায় জিলানীর বউ। রুচিশীল, গতিশীল, মুক্তমনা ও সংস্কৃতিমনা। মুখটা যেমন সুন্দর, গলাটাও তেমন সুন্দর। গলা বলতে গানের গলা। চমৎকার গায়।দুজনে প্রেম করে বিয়ে করেছে। দুজন দুজনকে বোঝে। যদিও জিলানী পেশাগত ব্যস্ততার কারণে সময় কম দেয় তবুও সাজিয়ার মনে কোন খেদ নেই। ভালোর অল্পও ভালো।
ইন্সপেক্টর জিলানীও খুব সকালে ওঠেন। গোসল করেন, কিন্তু চুল আঁচড়ান না। শুধু হাতের চার আঙ্গুল দিয়ে কোনমতে ঠেলেঠুলে সামনের চুলগুলো এদিক ওদিক করেন। আজও তাই। ডাইনিং টেবিলে এসে বসলেন। নাস্তা করবেন। সকালে একটু হেভি ব্রেকফাস্ট, এগারোটার দিকে হাল্কা টিফিন, বিকেলে চা বিস্কুট এবং সন্ধ্যায় ডিনার— এটাই তার নিত্যদিনকার অভ্যেস। অবশ্য ছুটির দিনে যদি ঘরে থাকেন, খান অথবা না খান, দুপুরে স্ত্রীকে লাঞ্চে সঙ্গ দেন।
জিলানীর সামনে ফাইলপত্র, হাতে মোবাইল সেট। একটা ছবির দিকে আনমনে দেখছেন। সাজিয়া দেখে বললো,
‘মেয়েটা কি অফিসের কেউ ?’
‘না। ইনভেস্টিগেশনের।’
‘আসামি ? নাকি উইটনেস ?’
‘বুঝে উঠতে সময় লাগছে। মিস্টিরিয়াস লেডি !’
‘ছবি দেখে মনে হয় বেশ পার্সোনালিটি আছে।’
‘তা আছে। পজিশনের চেয়ে একটু বেশিই।’
জিলানী চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
‘আজকের চা তো ফার্স্ট ক্লাস !’
‘ধন্যবাদ।’ সাজিয়ার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া।
জিলানী বউয়ের হাতটা টেনে দুহাতে মৃদু চাপ দিয়ে বললেন,
‘অবশ্য তুমি মানুষটাই ফার্স্ট ক্লাস। সে প্রাউড অফ ইউ।’
সাজিয়া খুশি হলো। প্রশংসায় কে না খুশি হয় ! তবে প্রশংসা করতে জানতে হয়। সবাই জানে না। একটা স্মিত হাসি দিয়ে বললো,
‘আই অ্যাম সো হ্যাপি। থ্যাংক ইউ স্যার।’
‘ইউ আর ওয়ালকাম ম্যাডাম।’
ইন্সপেক্টর জিলানী ফাইলের সাম্প্রতিক কাগজপত্রে চোখ বুলালেন। এসআই রাজিবের দেওয়া নোট ও রিমার্ক্স মনোযোগ দিয়ে পড়লেন। একবার দুই ভ্রূ কুচকালেন। এরপর তার দুই সহকর্মীকে মোবাইলে ফোন করে একই কথা বললেন— ‘শোনো, মিশন আছে। দুপুর ১২টার দিকে অফিসের সামনে থেকো। আমি এসে নিয়ে যাবো। উইপন সাথে রেখো।’
তাদের সংসারে একটি সন্তান, নাভিদ। ক্লাস এইটে। ক’দিন ধরে স্কুল বন্ধ। তাই সকালে দেরি করে ওঠে।সাজিয়াও ডাকে না। ইন্সপেক্টর জিলানী বের হবার সময় ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। সাজিয়া স্বামীকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলো।
জিলানী বেরিয়ে গেলে সাজিয়া এসে চেতন ভগতের উপন্যাসটা হাতে নেয়। গতকাল থেকে পড়ছে— The Girl in Room 105.
আজ পিন্টুর মাকে এনজিওগ্রাম করানোর তারিখ। নিধি কথা দিয়েছিল সকালে যাবে। মনে আছে তার। ঝটপট রেডি হয়ে গেলো। সালেকা বুয়া দু’ স্লাইস ব্রেড, একটা ডিম পোচ আর এক গ্লাস দুধ এনে টেবিলে রাখলো। নিধি খেতে খেতে বললো,
‘বুয়া ! আমি দরজাটা বাইরে দিয়ে তালা দিয়ে যাচ্ছি। না আসা পর্যন্ত তুমি তোমার কাজ করবে।’
‘আফনে আইবেন কোনসুম ?’
‘তুমি যে সময় যাও তার আগেই আসবো। আর হ্যাঁ, বাইরে থেকে কেউ কথা বললে কোন উত্তর দেবে না। সে পরিচিত হোক কি অপরিচিত। ঠিক আছে ?’
‘হয়।’
হাসপাতালে যেতে যেতেই শোনে, পিন্টুর মাকে এইমাত্র ওটিতে নেয়া হয়েছে। নিধির দেখা হলো না তার সাথে। ছোট মেয়ে স্বর্ণা ওটি রুমের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। মনে মনে দোয়া পড়ছে। নিধিকে দেখে পিন্টু এসে করিডোরে দাঁড়ালো। মুখে কোন কথা নেই। নিধি সেদিনকার ঘটনার জন্য তার কাছে আবারও ক্ষমা চাইলো। পিন্টুর ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি দেখা গেলো। তার চোখ দুটো সকাল থেকেই ছল ছল করছে।
‘টাকার জোগাড় হয়েছে ?’ নিধি জিজ্ঞেস করলো।
‘মোটামুটি।’
‘কোত্থেকে ?’
‘কাল বড় বোনজামাই এসেছিল। এক লাখ টাকা দিয়ে গেছে।’
‘বোন আসে নি ?’
‘আসতে পারে নি। তার বাচ্চা হবে।’
নিধি দু’লাখ টাকা পিন্টুর হাতে দিয়ে বললো, ‘রাখো। রিং পরানোর দরকার হলে কতো লাগে তাতো জানা নেই। এ টাকা কাজে দেবে। আরও লাগলে জানিয়ো।’
পিন্টু স্বর্ণাকে ডেকে আনলো। নিধির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। স্বর্ণার মনটা ভার, মায়ের জন্য। পিন্টু টাকার বান্ডিল দুটো স্বর্ণার কাছে দিয়ে বললো, ‘তোর কাছে রাখ। সাবধানে।’
স্বর্ণা চলে গেলে নিধি বললো, ‘আর রাগ নেই তো ?’
পিন্টু বললো, ‘কী ?’
নিধি আবার বললো, ‘এখনও কি রেগে আছো ?’
পিন্টু বললো, ‘শুনি না তো !’
নিধি বুঝলো দুষ্টুমি করছে। সে এদিক তাকালো, ওদিক তাকালো, তারপর ‘তবে রে‘ বলে হাল্কা করে পিন্টুর কান টেনে দিলো। এবার পিন্টু চোখ বড় বড় করে বললো, ‘আবা..র !’
নিধি হাসলো। হাসলো পিন্টুও।
এসময় নিধির মোবাইল বেজে উঠলো। দেখলো রিফাতের কল। রিফাত বললো—
‘তুমি কোথায় ?’
‘কেন ?’
‘আরে পত্রিকার কয়েকজন সাংবাদিক এসে তো ঘিরে ধরেছে ! তোমাদের বাড়িতে তালা দেখে আমাকে ধরেছে। কতো রকম প্রশ্ন ! আমি কিভাবে এসবের জবাব দেই !’
‘একটু থামুন। কে সাংবাদিক খবর দিয়েছে ? কি বিষয়ে প্রশ্ন করেছে ?’
‘আমি কি জানি কে খবর দিয়েছে ?’ রিফাত রাগতস্বরে বললো। ‘বিষয় তো ওটাই। রেজাউদ্দিন সাহেবকে কে গুম করলো, কেন করলো, নাকি মেরে ফেললো, পুলিশ তদন্তে এসে কী কী করলো, তুমি আমি কী ভূমিকা নিয়েছি, তারপর জেরিনের লেটেস্ট সংবাদ কী পেয়েছি….আরও কতো কী !’
‘আচ্ছা ফোনে তো ডিটেইলস আলাপ করা যাবেনা, আমি আসছি, সব শুনবো। আপনি বাসায় আছেন ?’
‘না, অফিসে চলে এসেছি। আমার মনে হয় এ সময় বাড়ি ছেড়ে তোমার কোথাও যাওয়া উচিত না। রাখি।’
নিধি নীরব। পিন্টু বললো, ‘সাংবাদিকরা টের পেয়ে গেছে ?’
নিধি বললো, ‘ওরা তোমাকেও প্রশ্ন করতে পারে। বুঝে শুনে বলবে। আর, ইন্সপেক্টর জিলানী তো তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেই। খুব ইন্টেলিজেন্ট। দেখো আবার বেহুঁশ না হও !’
পিন্টু আস্তে করে বললো, ‘আগামিকাল পেপারে কী আসে কে জানে !’
নিধি রাস্তায় এসে একটা রিকশা ডেকে উঠলো। একটু আগাতেই সে একটা জীপের দিকে তাকালো। জীপটা কেবল স্টার্ট নিয়েছে। নিধির চেনা চেনা লাগছে। সে চট করে রিকশার হুড ফেলে দিলো। পেছন দিক দিয়ে তাকালো। জীপে দু’জন বসে আছে। আরেকজন হাসপাতাল থেকে এসে কেবলই উঠেছে। ড্রাইভারের পাশের সিটে যে বসে আছে মনে হচ্ছে তাকে সে চেনে।
জীপটা ইউটার্ন নিলো। এবার রিকশার পেছনে প্রায়। নিধি পরিষ্কার দেখতে পেলো— সামনের সিটে সিআইডি ইন্সপেক্টর জিলানী।
চলবে….