বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৪

চলে এসেছে গৃহকর্মী সালেকা বুয়া। দারুণ ত্রস্ত ব্যস্ত হয়ে কাজে লেগেছে। তার প্রবণতা হলো, ছুটি কাটিয়ে আসবার পর তীব্র মনোযোগ দিয়ে কাজ করে। কিন্তু দিন দুয়েক পার হলে আবার ঢিলেঢালা ভাব। বলে বলে কাজ করাতে হয়। ভুল ধরলে মুখটা কালো করে রাখে। বিড় বিড় করে। অজুহাত দেয়।
গতকাল থেকে তার বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না। এটা কী হলো ! জলে ফোটা পদ্মফুলের মতো সুন্দর তার জেরিন ম্যাডাম একদম নাই হয়ে গেলো ! দু’দিন পর অসুস্হ খালুজানও গুম ! ব্যাপারটা তার বিশ্বাসের দরজা দিয়ে ঢুকতে পারছে না। শিষ্ট, নির্ঝন্ঝাট ও নিরিবিলি একটা পরিবারে এভাবে বিপর্যয় নেমে এলো !
‘বুয়া ! বুয়া ! এইদিকের বারান্দায় আসো।’ নিধির ডাক শুনে বুয়া পেছনের বারান্দায় গেলো। নিধি বারান্দাটা ভালো করে ঝাড় দিয়ে মুছে ফেলতে বললো। সালেকা বুয়া পেছনের কর্ণারে টাঙানো বিশালকায় ফ্রেমের ছবিটা দেখে বললো, ‘এইডা দেহি জেরিন ম্যাডামের ছবি ! এইখানে ক্যান ! এইডা না ম্যাডামের বেডরুমে আছিল ! আফা !’
নিধি জবাব দিলো, ‘ছবিটা এখানে আমিই এনে রেখেছি। এই বারন্দায় আমার বেশি আসা হয়। এখানে ম্যাডামের মুখটাকে বেশি করে দেখতে পাবো। ওনার রুমে তো আমার খুব একটা যাওয়া হয় না। কী, ভালো করেছি না বুয়া ?’
সালেকা বুয়ার চোখে পানি এলো। আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে বললো, ‘হয়, ভালোই করছেন। আল্লাহ য্যান ওনার আত্মায় শান্তি দেয়।’ শুনে নিধি বললো, ‘আমিন।’
একটা তেলোপোকা এঁকেবেঁকে ফ্লোরের টাইলস দিয়ে যাচ্ছিল। নিধি দেখলো। তারপর একটা জুতা এনে ঠাস করে ওটার গায়ে মারলো। অমন জোরে আঘাতটা পেয়ে বেচারা তেলাপোকা একেবারে থেতলে মরল। পড়ে রইলো তার রক্তাক্ত লাশ। তেলাপোকার রক্তে হিমোগ্লোবিন নেই বলে রক্ত সাদা।
‘বুয়া, আমি একটু কাছের দোকান থেকে আসছি। তেল শেষ হয়ে গেছে। তুমি খেয়াল রেখো। আর, দরজাটা বন্ধ করে দাও।’ নিধি বলল।
‘আফা গুড়া সাবানও নাই।’ বুয়া জানালো।
‘মানে সার্ফ এক্সেল ? পুরো এক প্যাকেট ছিল তো ?’
‘শেষ হইছে।’
‘আচ্ছা নিয়ে আসবো।’
নিধি বেরিয়ে গেলে বুয়া দরজা বন্ধ করে দিলো।
গেটের বাইরে যেতেই নিধি দেখলো তিনতলার রিফাত ইসলাম আসছে। সে তাকে দেখেও না দেখার ভাণ করে চলে যেতেই রিফাত বলে উঠলো,
‘কোথায় যাচ্ছো ?’
‘একটু দোকানে যাচ্ছি।’
‘খবরটা ওইদিনই ফেসবুকে পোস্ট করেছি। দুটো বড় পত্রিকাতেও ওনার ছবিসহ নিখোঁজ সংবাদ দিয়েছি। ছেপেছে। দেখেছো ?’
‘হ্যাঁ, একটাতে দেখেছি।’
‘পরিস্হিতি তো দেখি জটিল হচ্ছে !’
‘জটিল বানালেই জটিল।’
‘বুঝলাম না।’
‘আপনি নাকি পুলিশকে বলেছেন সেদিন খালুজান বাগানেই বের হন নি !’
‘হ্যাঁ। তো ?’
‘তার মানে আমি মিথ্যা জিডি করেছি?’ নিধি রেগে গেলো।
‘আমি তো একথা বলি নি ! যা বলার তাই বলেছি।’
‘বলার তো আমারও আছে। এটা মনে রাখবেন।’
একথা বলে নিধি হন হন করে চলে গেলো।
বিনয়দার দোকান। দোকানটা পাকা। এক লাইনে মোট পাঁচটি দোকান। মুদি দোকান দুটি। বিনয়দারটা বেশ বড়, মালামালও অনেক। এটা সড়ক থেকে সামান্য ভেতরে গলির মুখে। বাড়ি থেকে তিন মিনিটের দূরত্বে। নিধি তাদের সুপরিচিত। ফোন করলেই বিনয় বাবু তার দোকানের কর্মচারী দিয়ে সদাইপাতি ওই বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।
সড়কে জ্যাম লেগেছে। একটার পর একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে। পিঁ পিঁ করে ঘন ঘন ভেঁপু বাজছে। সড়কের আরেক প্রান্তে একটি মেডিক্যাল সেন্টারের কাছে একটা ট্রাক নষ্ট হয়ে ঠিক রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। ওটার এক্সএল ভেঙে গেছে। আটকে পড়া গাড়িগুলো না এদিক যেতে পারছে, না ওদিক। কেবল মাত্র মোটরবাইকগুলো ফাঁক খুঁজে খুঁজে এঁকেবেঁকে এগুচ্ছে। কোন কোনটি আবার ফুটপাতেও উঠেছে।
বিনয়দার দোকানের কাছেই জ্যামে আটকে আছে রডবোঝাই ঠেলা। ঠেলাওয়ালারা সংখ্যায় দুই। দুজনেরই ঘেমে নেয়ে যাচ্ছে তাই অবস্থা। তাদের পায়ে পুরনো রঙচটা রাবারের স্যান্ডেল, একজনেরটা বেশ ছেঁড়া। তপ্তসড়কের উত্তাপ ওদের পদযুগলে। অসহ্য হয়ে ওরা সমানে মায়ের ভাষায় বকাবকি করে যাচ্ছে।
দোকানে গিয়ে কেবল দাঁড়িয়েছে, অমনি নিধির মোবাইল বেজে উঠলো। ড্রাইভার পিন্টুর ফোন।
নিধি একটু আড়ালে গিয়ে সেখানে একটা সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষে দাঁড়ালো। কলটা রিসিভ করল।
‘হ্যালো। কী খবর ?’
‘আর বলো না। কী জিডি করলে ! পুলিশ তো পিছু ছাড়ছে না। একটু আগে আবার কত কী জিজ্ঞেস করল।’
‘যেমন ?’
‘সেদিন থানায় কী হয়েছিল, আমার বাসায় কী হয়েছিল সবই তো তোমাকে বলেছি।’
‘হুঁ।’
‘ফোনে জিজ্ঞেস করলো ঘটনার দিন বিকেলে আমি ক’টায় ও বাড়িতে পৌঁছেছিলাম, গিয়ে বাড়ির মালিককে দেখেছিলাম কিনা, সর্বশেষ কথন কী অবস্থায় দেখেছিলাম, যিনি ভালো করে চলাফেরাই করতে পারেন না তিনি নিজে কিভাবে গায়েব হয়ে যান, তাঁর কোনো শত্রু আছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি।’
‘আর ?’
‘রিফাত সাহেব সম্পর্কে, তোমার সম্পর্কে, মালিকের সহায় সম্পত্তির বিষয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করছিল।’
‘পুলিশের কাজই তো তদন্ত করা। জেরা না করলে ঘটনাটা বের হবে কী করে বোঝো না? নিখোঁজ ব্যক্তিকে খুঁজে তো বের করতে হবে।’
‘তুমি বলছো নিখোঁজ, পুলিশ অফিসার তো বলছে কিডন্যাপ, এমনকি মার্ডারের গন্ধও নাকি পাচ্ছে !’
‘শোন,পুলিশের কাজ পুলিশকে করতে দাও। তুমি বোকার মতো ঘাবরাবে না।’
‘সে তো সন্দেহ করেই ফেলেছে এর সঙ্গে বাড়ির লোকেরা, মানে আমরা জড়িত !’
‘বলুক। সন্দেহ সন্দেহই। এটা মাথায় রাখতে হব যে— খালুজান নিখোঁজ। ওনাকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে পুলিশকে আমাদের সবরকম সহযোগিতা করতে হবে। ঠিক আছে ?’
‘ঠিক আছে।’
একটা ট্রাফিক সার্জেন্ট এসে ফ্রু ফ্রু করে বাঁশি বাজানো শুরু করলো। ট্রাফিক জ্যামটা ছাড়ানোর প্রয়াস।
‘শোন, তুমি কি রাত দশটা পর্যন্ত এ বাড়িতে থাকতে পারবে !’ নিধির অনুরোধ।
‘কেন ?’
‘এত বড় বাড়িতে আমি একা। রাতে আমার কেমন যেন ভয় ভয় লাগে।’
‘আচ্ছা দেখি। বিকেলে এলে পরে কথা হবে।’
‘সম্ভব হলে বিকেলের নাস্তার জন্য চিকেন পাফ নিয়ে এসো।’
‘আচ্ছা।’
নিধি দোকানে অর্ডার করে ফিরে এলো। বিনয়দা বলেছে পাঠিয়ে দেবে। এতটুকু সময়ে নিধিও গরমে অতিষ্ঠ। ঋতুটা গ্রীষ্মের, কিন্তু দাবদাহ এমন প্রচন্ড যে টেকাই দায়। হঠাৎ আকাশে গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ। নিধি ভাবে, বৃষ্টি হবে তো ? মাঝে মাঝেই মেঘ গর্জে, কিন্তু বর্ষে না। একটা ঝুমবৃষ্টির ভীষণ প্রয়োজন।
নিধি বাড়িতে ঢুকে ফ্রিজ খোলে। এক গ্লাস শীতল পানিতে এক টুকরো লেবু চাপে। সামান্য লবন ছাড়ে। এরপর চামচ দিয়ে গুলিয়ে পান করে। বুয়াকে ডাক দেয়, ‘বুয়া ! রান্না কি শেষ ?’
বুয়া বলে, ‘না আফা। ডাইল বাকি।’ নিধি ডাল রাঁধতে নিষেধ করে— ‘শোন, টক রান্না করো।’
আবহাওয়ার পরিবর্তনে মানুষের ইচ্ছেরও পরিবর্তন ঘটে।
বিকেল চারটায় পিন্টু এলো চিকেন পাফ নিয়ে। নিধি পিন্টুর একটা হাত ছুঁয়ে বললো, ‘শোন, তুমি রাতে যতোটা পর্যন্ত পারো, আমার কাছে থাকবে।’
পিন্টু নিধির চুলে হাত বুলিয়ে বললো, ‘ঠিক আছে। আর ?’
‘পারলে পুরো রাত।’
‘অ্যাঁ ! লোকে কী বলবে ?’
নিধি একটা ধাক্কা মেরে বললো, ‘ও, লোকনিন্দা ! তাহলে যাও কাজী নিয়ে এসো।’
পিন্টু হেসে বললো, ‘ঠিক তো ?’
‘হুঁ ঠিক।’ নিধিও হেসে দিল।
পিন্টুর জন্য চা করে নিয়ে আসা হয়েছে। আদা মেশানো লেবু চা। সাথে রয়েছে চিকেন পাফ। নিধি এক কাপ চা পিন্টুকে তুলে দিলো। নিজেও এক কাপ নিলো। পিন্টু নিধির চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। নিধি চায়ে এক চুমুক দিয়েছে, তার মোবাইলে রিং বাজল। ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো—
‘ধানমন্ডি থানা থেকে এসআই রাজিব বলছি। শুনুন, আপনার জিডির উপর প্রাথমিক তদন্তশেষে একটা রেগুলার মামলা দায়ের হয়েছে। মামলার বাদী এখন রাষ্ট্র— রাষ্ট্রের পক্ষে পুলিশ। আর, মামলার তদন্ত করবে সিআইডি।’
[চলবে….]