বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৬

এখনই যেতে হবে। নিধি তৈরি হওয়ার জন্য ভেতরের রুমে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই ফিরে এসে রাজমিস্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল,
‘আচ্ছা তমিজ, তুমি কি করে নিশ্চিত হলে সে খালুজান ?’
‘কন কী, যার বাড়িতে কাজ করি তারে চিনুম না ?’
‘হাসপাতালে তাকে কী অবস্হায় দেখেছো ?’
‘ওয়ার্ডে দেখছি। একটা বেডে শোয়া। নাকে মুখে অক্সিজেনের ইয়া।
‘ইয়া কী ? অক্সিজেন মাস্ক ?’
‘হয়।’
নিধি মোবাইলে রিফাত ইসলামকে খবরটা জানালো। রিফাত বললো, ‘দারুণ খবর ! তুমি যাবে ?
‘নিশ্চয়ই যাবো। এখনই।’
‘তুমি যাও। আমিও আসছি।’
‘থানায় খবরটা দেওয়া দরকার না ?’
‘অবশ্যই। পুলিশ ওনাকে হেফাজতে নেবে, জিজ্ঞাসাবাদ করবে।’
‘এক কাজ করি। আমরা যাই। যদি খালুজানকে সত্যিই পাই তখন পুলিশকে জানাবো।’
রিফাত একটু ভেবে বললো—
‘ওকে।’
বেলা সাড়ে বারোটা। তিনজন প্রায় একই সাথে এমএমসি হাসপাতালে পৌঁছুলো। রাজমিস্ত্রী তমিজ পেছন পেছন। সে জানালো পুরুষ ওয়ার্ড চারতলায়। এটা শুনে নিধি রিফাতকে নিয়ে লিফ্টে ওঠার জন্য গেলো। তমিজ কোন দ্বিধা না করেই পা চালিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠলো। এরপর চতুর্থ তলায় লিফ্টের সামনে দাঁড়িয়ে রইল।
প্রায় দশ মিনিট পর রিফাত ও নিধি বের হয়ে এলো। লিফ্টটা নিচ থেকে উপরে আসবার সময় চতুর্থ তলায় থামে নি, থেমেছে টপ ফ্লোর থেকে নিচে যাবার সময়ে। তাদের দুজনের সাথে রাজমিস্ত্রীও পুরুষ ওয়ার্ডের দিকে এগুলো। ওয়ার্ডের কাছেই দেখা হয়ে গেলো এসআই রাজিবের সাথে।
নিধি বলল, ‘আপনি এখানে ?’
‘একটা অ্যক্সিডেন্ট কেস। ভিকটিমের অবস্থা দেখতে এসেছিলাম।’ রাজিব জানাল।
‘আচ্ছা।’
‘আপনারা দুজন দেখি একসঙ্গে ! কাকে দেখতে যাচ্ছেন ?’
‘রাজমিস্ত্রী তমিজ আমাকে বলল সে নাকি খালুজানকে এখানে দেখেছে। খবরটা শুনে আমি ওনাকে জানালাম।
তারপর এখানে এলাম।’
‘তাই নাকি ? কোন্ কেবিনে ?’
‘তমিজ বলেছে জেন্টস ওয়ার্ডে।’
‘জেন্টস ওয়ার্ড তো ঐটা। চলুন আমিও যাই।’
ওয়ার্ডের প্রবেশমুখে তমিজ ‘ঐ তো শুইয়া আছে’ বলে ভেতরে ঢুকে বেডের পেছনে দাঁড়িয়ে রইলো। ওরা তিনজনও এসে বেডের পাশে দাঁড়ালো। বেডের দিকে তাকিয়ে নিধি বললো, ‘ইনি তো আমাদের খালুজান না !’ রিফাতও বলে উঠল, ‘তাই তো, উনি তো অন্য কেউ !’ এসআই রাজিব চোখ দুটো মোটা মোটা করে রাজমিস্ত্রীর দিকে তাকালো। তারপর লাগাল এক ধমক !
নিধি তমিজকে বললো, ‘তুমি না বললে রেজাউদ্দিন স্যারকে চেনো ? এটা কী হলো ?’ রিফাতও রেগে বলল, ‘এভাবে তামাশা করার কোন মানে হয় ?’
তমিজ জবাব দিলো, ‘কাইল রাইতে যখন দেখছি তখন মুখে অক্সিজেনের ইয়া লাগাইন্না আছিল। মুখটা সাফ না দ্যাখলেও চুল, থুতনি, বডি দেইখা আমার কাছে মনে হইছিল রেজা স্যার।’
পুলিশ অফিসার আরেকবার তমিজকে ধমক দিয়ে বললো, ‘তুমি হাসপাতালে কেন এসেছিলে ?’ সে জানালো, এসময় যার বাড়িতে কাজ করছে সে এই ওয়ার্ডেই ভর্তি ছিল। আজ সকালে রিলিজ নিয়ে চলে গেছে। এসআই রাজিব এবার তমিজকে চলে যেতে বলল।
প্রকৃতপক্ষে ওই রুগীটা দূর থেকে দেখতে রেজাউদ্দিন সাহেবের মতো। ফিগারটাও তাঁর মতো, মাথার পাকা চুলগুলোও সেরকম। কিন্তু মুখমন্ডল অন্যরকম। কাছ থেকে বোঝা যায়।
একসাথে হাঁটতে হাঁটতে এসআই রাজিব নিধিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘যখন খবরটা শুনলেন তখন তো পুলিশকে জানানো উচিত ছিল।’
নিধি বললো, ‘ভেবেছিলাম হাসপাতালে এসে জানাবো। আগে দেখে নিই।’
‘এরকম ভুল সামনে করবেন না।’
‘ঠিক আছে।’
লিফ্ট থেকে নেমে রিফাত আগেই চলে গেলো। রাজিব নিধিকে বলল, ‘আরেকটা বিষয়। আপনার রাজমিস্ত্রী আমার কাছে এসেছিল। কিন্তু হেলপার ছেলেটা আসে নি। ওকে পাঠান নি কেন ?’
‘আমি তো মিস্ত্রীকে বলে দিয়েছিলাম হেলপারকে সাথে নিয়ে যেতে। সে নেয় নি তাহলে ?’
‘নেবে কী করে ? তাকে তো বাসায় খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না !’
‘সে কী কথা !’
‘জী। সেটাই কথা। কেসটা সিআইডি টেক আপ করেছে, আপনাকে বলেছি না ?’
‘জী বলেছেন।’
‘তদন্তে ফুল কোঅপারেশন দেবেন।’
‘অবশ্যই দেবো। আপনি আর থাকছেন না ?’
‘না।’
এসআই রাজিব চলে গেলো। নিধিও ছুটলো একটা রিকশা নিয়ে। অনেকদিন পর সে একটা আরামদায়ক রিকশায় চড়েছে। রিকশাচালক জানালো— এটা কুমিল্লা বডি।
সালেকা বুয়ার চলে যাবার সময় হয়েছে। এইমাত্র এক ভদ্রলোক এসে ড্রইংরুম রুমে ঢুকে সোফায় বসে গেছে। পোশাক আশাক ভালো, দেখতে শুনতেও মন্দ না। মুখে পুরু গোঁফ। বুয়াকে কিছুই বলছে না সে কে এবং কোত্থেকে এসেছে, কাকে চায়। বুয়া বার বারই অনুরোধ করছে যে, একটু পরে আসেন, ততক্ষণে আপা চলে আসবে কিন্তু বুয়ার কথায় পাত্তাই দিচ্ছে না।
আগন্তুক এক গ্লাস ঠান্ডা পানি চাইলো। বুয়া নিয়ে এলো। সে বুয়াকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এ বাসায় কত দিন ?’ বুয়া জবাব দিলো না। পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি এ বাসায় কতোদিন যাবত কাজ করছো ?’ এবার বুয়া না বলে পারলো না—
‘পরায় ছয় মাস। আমি ছুডা কাম করি।’
‘কতক্ষণ ?’
‘সকালে আহি আর দুইটার পরে যাই আরাক বাসায়।’
‘এ বাড়ির মালিক কোথায় ?’
‘কয়তো হারাইয়া গেছে। আল্লাহ জানে।’
‘তুমি জানো না ?’
‘কেমনে ? আমি আছলাম না তো !’
‘কোথায় ছিলে ?’
‘ছুডি লইয়া বারিত গেছিলাম।’
নিধি এসে ঘরে ঢুকলো। দেখে ড্রয়িং রুমে সিঙ্গেল সোফাটায় বসে আছে মাঝবয়সী এক অপরিচিত ভদ্রলোক। হাতে কিছু কাগজপত্র। নিধি দাঁড়িয়ে গেলো। জিজ্ঞেস করলো,
‘আপনাকে চিনতে পারলাম না। জেরিন ম্যাডামের কাছে এসেছেন কি ?’
আগন্তুকও দাঁড়ালেন। বললেন, ‘আমাকে আপনার চেনার কথা নয়। এ বাড়িতে এই প্রথম এসেছি।’
নিধি ভাবে, ভদ্রলোক কে হতে পারে ! হাতে কাগজ— ইনসুরেন্স কোম্পানির লোক না তো ! নাকি বাড়ির ডেভেলপার ! রিফাত সাহেব পাঠিয়েছে কি !
আগন্তুক বলে উঠল, ‘আমি সিআইডি থেকে এসেছি। আমার নাম জিলানী। ইন্সপেক্টর জিলানী।’
নিধি বলল, ‘ও ! আসসালাম আলাইকুম। আপনি বসেন প্লিজ। আমি একটু চেঞ্জ’ হয়ে আসছি।’
[চলবে….]