বিধ্বংসী প্রহর,পর্ব-১

প্লেন ক্রাশ করেছে ! এ কি বলছে ম্যানেজার সাহেব ! শুনে নিধি নিশ্চুপ। এ জন্যই কি এক সপ্তাহের মধ্যে জেরিন ম্যাডামের কোন খবর আসে নি! তবুও নিধি বিশ্বাস করতে পারছে না।
‘কেন, নিউজ শোনেন নি ? উড়ন্ত অবস্হায় প্লেনে একটা বিস্ফোরণ হয়েছিল। তারপর বিধ্বস্ত প্লেনটা প্রশান্ত মহাসাগরে পড়ে তলিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত কিছুই ট্রেস করা যায় নি।’ ব্যাংক ম্যানেজার জানালেন।
নিধি পেছনে গিয়ে একটা খালি চেয়ারে বসে পড়ল। তার অভিব্যক্ত দেখে যে কেউ বলবে যে, খবরটা শুনে বুকের ভেতর অদ্ভুত তোলপাড় হচ্ছে তার। কান্না পাচ্ছে। ভাবছে, জীবন কি এমনই ! এই আছে এই নেই !
মেধাবী জেরিন অস্ট্রেলিয়ায় একটা নামকরা ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগদানের জন্য ঢাকা ত্যাগ করে। এমনিতে সে বাংলাদেশের একটি শীর্ষস্হানীয় বেসরকাকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজে নিয়োজিত ছিল। যাবার সময় নিধিকে বলে গিয়েছিল যে পৌঁছুবার চার/পাঁচদিন পরই নিধির অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাবে। সেই খোঁজেই এসেছিল সে। এই ব্যাংকেই জেরিন নিধির নামে একটা সেভিং একাউন্ট খুলে দিয়েছে। ব্যাংক ম্যানেজারের সাথে নিধির পরিচয়ও করিয়েছে।
বছর দুয়েক হলো নিধি জেরিন ম্যাডামের বাসায় কাজ করছে। ঘর দেখে, পাশাপাশি জেরিনের বৃদ্ধ ও অসুস্থ বাবার দেখাশুনাও করে। নার্সিং ডিপ্লোমা পাশ করার পর পরই নিধির বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু সে বিয়ে নয় মাসের মাথায় ভেঙ্গে যায়। এরপর পত্রিকায় ‘নার্স কাম কেয়ারটকার আবশ্যক’ বিজ্ঞাপন দেখে সে আবেদন করে। অত:পর জেরিনদের বাসায় কাজ পেয়ে যায়।
জেরিন বয়সে নিধির চেয়ে বছর দুয়েকের বড় হবে। এখনও বিয়ে করে নি। মা নেই, কোন ভাই-বোন নেই। নিজেও জন্মেছিল বাবা-মা’র বিয়ের তের বছর পর। ধানমন্ডিতে এককালের ধনাঢ্য বাবার সুবিশাল বাড়ির বাসিন্দা বাবা আর সে। অত:পর যোগ হয়েছে নিধি। কর্তব্যপরায়ণতা এবং সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে নিধি সবার কাছে বিশ্বস্ততার এক নাম।
রেজাউদ্দিন সাহেব। এক সময়ের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। মেয়ে জেরিন ছাড়া আর কেউ নেই তাঁর। নেই কোন নিকট আত্মীয়-স্বজন। তিনিও তাঁর বাবার একমাত্র সন্তান। পিতার মৃত্যুর তিন বছর পর মাকেও হারান। একেবারে অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন। কেননা তাঁর বাবারও কোন ভাই-বোন ছিল না। পাশের বাড়ির লোকজনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বাড়িঘর, জমিজমা যা ছিল সব বিক্রি করে ঢাকায় চলে আসেন। ব্যবসা শুরু করেন। পরবর্তীতে ধানমন্ডিতে জমি কিনে এ বাড়িটি নির্মাণ করেন এবং ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যান।
গত বছর রেজাউদ্দিন সাহেব স্ট্রোক করলে তাঁর বাম সাইড প্যারালাইজড হয়ে যায়। মুখে কথা বলার চেষ্টা করেন, কিন্তু সে কথা বোঝার সাধ্য কারও নেই। তবে কানে সব শুনতে পান। ডান হাতে লিখতে পারেন। বয়স সত্তর ছুঁয়েছে।
কলাবাগানে বাস থামলো। নিধি নেমে পড়ল। দুপুরের প্রচণ্ড রোদ। ভাগ্যিস ছাতা নিয়েছিল সাথে। সতর্কতার সঙ্গে রাস্তা পার হয়ে ডিঙ্গি কমিউনিটি সেন্টারের পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকে। ভাবে, ঘরে গিয়ে খালুজানকে,অর্থাৎ ম্যাডামের বাবাকে সংবাদটা দেবে কিনা। না, এ খবর শুনে যদি আরেকবার স্ট্রোক করে ! দ্বিতীয়বার স্ট্রোক করলে তো বাঁচানোই যাবে না !
চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢোকে নিধি। বিশাল ঘর, কিন্তু নিস্তব্ধ। নিধি জেরিনের বাবার রুমে যায়। সে ঘুমুচ্ছে। যাবার সময়ে নিধি তাকে খাইয়ে গিয়েছিল। রুমের বাথরুমটা অ্যাটাচড। কখনো তিনি একাই বাথরুমে যান, কখনো নিধি ধরে ধরে নিয়ে যায়।
বিকেলে ড্রাইভার এলো। জেরিন ম্যাডাম তাকে বলেছিল দু’দিন পর পর এসে খোঁজ নিতে। কিন্তু সে রোজ আসে। কখনও সকালে কখনও বিকেলে। ঘন্টাখানেক থাকে। বাড়ির মালিক রেজাউদ্দিন সাহেব যদি বলেন তাহলে তাঁকে ধরে ধরে বাগানে হাঁটায়। আবার কদাচিৎ শরীরে শক্তি পেলে মালিক স্বয়ং হাঁটতে চেষ্টা করেন।
ড্রাইভারের নাম পিন্টু। অনেক আগে এসএসসি পাশ করার আর পড়ে নি। ড্রাইভিং শেখে। তারপর থেকে প্রাইভেট কার চালায়, এটাই এখন পেশা। এ বাড়িতে আছে আজ দুই বছর।
সে এদিক দেখে, ওদিক দেখে আর ফাঁক পেলে নিধির সঙ্গে আলাপ জুড়ে দেয়। এক’দিনে দুজনের অনেকটাই ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। পিন্টুর সঙ্গ পেয়ে নিধির কিছুটা হলেও একাকিত্ব ঘোচে।
বাড়িটা তিনতলা। সত্তরের দশকে চমৎকার ডিজাইনে তৈরি। এক পরিচিত ডেভেলপার অনেক করে অনুরোধ করেছিল যে বাড়িটি দশতলা করে দেবে, কিন্তু রেজাউদ্দিন সাহেব রাজী হন নি। এর একতলা এবং দোতলা মিলিয়ে ডুপলেক্স। তিনতলা পৃথক ইউনিট। ওটা মাসিক পঞ্চাশ হাজার টাকায় ভাড়া দেওয়া। ভাড়াটে অবশ্য রেজাউদ্দিন সাহেবের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তার স্ত্রী এখন লন্ডনে। সবাই জানে বেড়াতে গেছে।
ভাড়াটে রিফাত ইসলাম নিজেকে সফ্টওয়ার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পরিচয় দেয়। বেশ কয়েক বছর ধরে রয়েছে এ বাসায়। কয়েকবার তিনতলাটা কিনতে চেয়েছে, কিন্তু বাড়ির মালিক বিক্রি করে নি। তারপর থেকে সম্পর্ক কিছুটা শীতল। মাঝে মাঝে এসে বাড়ির মালিককে দেখে যায়। আবার নিধির সাথেও আলাপ সালাপ করে।
নিধি লক্ষ্য করেছে ভাড়াটে রিফাতের কথায় রয়েছে প্রগলভতা, দৃষ্টিতে বক্রতা। এই কিছুক্ষণ আগেও সে এসেছিল প্লেন ক্রাশের সংবাদটা নিয়ে। নিধি কঠিনভাবে বারণ করায় তা রেজাউদ্দিন সাহেবকে বলতে পারে নি।
নিধি বারান্দায়। ফুলের টবগুলোতে উপুড় হয়ে পানি দিচ্ছে। টবে টবে নানা জাতের এবং নানা বর্ণের দৃষ্টিনন্দন ফুল। এছাড়া বাগানেও রয়েছে সারি সারি ফুলগাছ। বাগানে পানি দেওয়ার জন্য রয়েছে প্লাস্টিকের লম্বা পাইপ।
নিধির ওড়নার এক অংশ খুলে পড়ছে আর সে আরেক হাতে সামলাচ্ছে। ড্রাইভার পিন্টু বারান্দার গ্রিলের ওপাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল। চোখাচোখি হাওয়ায় নিধি পানির পাত্রটা রেখে দাঁড়িয়ে যায়।
‘ম্যাডামের কোন সংবাদ পেয়েছো ?’ ড্রাইভার জিজ্ঞেস করে। নিধি ইশারায় তাকে কাছে আসতে বললে ড্রাইভার বারান্দায় আসে।
‘শোন, খুব খারাপ খবর !’ নিধি নিচু গলায় বলে।
‘কী ?’
‘ম্যাডামের প্লেনটা আকাশে বার্স্ট হয়ে গেছে। নিচে পড়ে সাগরে ডুবে গেছে।’
‘বলো কী ? কে জানালো ?’
‘ব্যাংকের ম্যানেজার। টিভিতেও খবর এসেছে।’
‘এতো মর্মান্তিক ! আহা জেরিন ম্যাডাম ! কী ভালোমানুষ !’
‘আসলেই। ভীষণ খারাপ লাগছে শুনে।’
পিন্টু চুপ করে থাকে। বলে,
‘কিচ্ছু করার নেই।’
‘এখন কী হবে পিন্টু?’ নিধিকে বিষণ্ন দেখায়।
‘কী হবে, খোদা যা করে ভালোর জন্যই করে।’
‘মানে ?’
‘এখন তো তুমিই বাড়ির মালিক।’ পিন্টুর ঠোঁটে রহস্যময় মুচকি হাসি।
‘এসব কী কথা ?’ নিধি রেগে যায়।
‘ঠিকই বলছি। বুড়োটা তো আছে আর দুই দিন।’
‘তুমি আসলেই একটা বাজে লোক। এমন সময় এ ধরনের কথা কেউ বলে ? তোমার মুখে একটুও বাধলো না ?’
পিন্টু নিধির আরও কাছে এলো। আঙুল দিয়ে তার মাথায় একটা টোকা মারলো। নিধির মাথাভর্তি লম্বা চুল। গায়ের রং শ্যামবর্ণ। ত্বক মসৃণ। মাঝারি উচ্চতা। খাওয়া দাওয়ায় সতর্কতা এবং শারীরিক পরিশ্রমের কারণে ফিগারটা সে ধরে রেখেছে।
পিন্টু বললো, ‘আরে এমনি দুষ্টুমি করলাম, দেখি তুমি কী বলো। আচ্ছা, খালুজানকে বলেছ ?’
‘না, বলি নি।’
‘ঠিক করেছো। দরকার নেই বলার।’
পিন্টু চাইলে নিধি তাকে চা করে দেয়। এমনিতে এ বাড়িতে অতিথি সমাগম খুব কম, তাই আপ্যায়নের সুযোগও কম। নিধি জিজ্ঞেস করলো, ‘চা খাবে ?’
পিন্টু বলল, ‘না। বরং আমি এখন যাই। কাল বিকেলে আসব। বুড়োটা এখন ঘুমে। কালও যদি আমায় ধরে ধরে বাগানে হাঁটতে চায়, হাঁটাব। আর হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে কিছু কথাও আছে।’
‘কী কথা ?’
‘কাল বলব।’ পিন্টু মুচকি হাসে। তারপর চলে যায়।
নিধি বুঝতে পারে পিন্টুর এ হাসির পেছনে কী নিবেদন রয়েছে।
এক মাস পর
………….
রেজাউদ্দিন সাহেব নিখোঁজ। গতকাল বিকেলে ড্রাইভার আসে নি। তিনি নিজেই খুব ধীরপায়ে বাগানে হাঁটছিলেন। এটা দেখে নিধি রেজাউদ্দিন সাহেবকে একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসিয়ে ঘরে চা নাস্তা আনতে যায়। এরপর বাগানে ফিরে এসে দেখে চেয়ার খালি। নিধি মোবাইলে খবরটা দিলে ড্রাইভার পিন্টু দ্রুত চলে আসে। দুজনে মিলে সমগ্র বাড়ি এবং আশপাশের সব জায়গায় তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়ায়। বাড়ির নিকটবর্তী হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোও চেক করে। কিন্তু রেজাউদ্দিন সাহেবের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি।
নিধি এইমাত্র ধানমণ্ডি থানায় এসব কথা বলে একটা জিডি করেছে। জিডির আরেকটা কপিতে প্রাপ্তিস্বীকার নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে। ওসি সাহেব বলেছেন তারা বিষয়টি খুব গুরুত্ব সহকারে দেখবেন।
এখন বেলা এগারটা। রাস্তায় প্রচণ্ড ট্র্যাফিক জ্যাম। আকাশে মেঘ জমেছে, তাই বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে অসহ্য ভ্যাপসা গরম ! নিধি দেখে ৭ নম্বর রোড়ের পাশে একটি ভ্যানগাড়ি ভর্তি ডাব। একটা ডাব কিনে স্ট্র দিয়ে টেনে টেনে ডাবের পানি পান করতে থাকে। পরে ডাবটা দুভাগ করিয়ে ভেতরে নারকেলের সাদা নরম অংশটুকুও খায়। এটা তার খুব পছন্দ, যেমন করে তালের শ্বাসও তার অন্যতম পছন্দের খাবার।
বাড়ি পৌঁছুতেই মোবাইলে কল আসে। পিন্টুর কল।
‘হ্যালো।’
‘কোনো খবর আছে ?’
‘না। থানায় জিডি করেছি। পুলিশ বলেছে ব্যবস্থা নেবে।’
‘বুঝলাম।’
‘কী ?’
‘পুলিশ শামলানোও তো একটা বড় ঝক্কি।’
‘কিছু করার নাই। শোনো, তোমার ডাক পড়তে পারে।’
‘ডাকলে তো যেতেই হবে।’
‘আচ্ছা এখন রাখি।’
নিধি শাওয়ার নেয়ার জন্য বাথরুমের দিকে এগোয়।ঘরময় একা সে। কেমন যেন এক থমথমে অবস্থা !
[চলবে]