মায়ের গয়নার বাক্স, পর্ব–৩

: রাহেলা। মা, আজ সন্ধ্যায় কোথাও বেরুস না। পাত্র পক্ষ তোকে দেখতে আসবে।
রাহেলা চলে গেছে ১৯৭১ এর ফেব্রুয়ারি মাসে। তখন ফাল্গুনের ছোঁয়া লেগেছে প্রকৃতিতে। মনোরোম প্রকৃতির রূপ চারপাশে তার সৌন্দর্য জানান দিচ্ছে।
এমন এক ফাল্গুনের রঙিন সকালে রাহেলার মামা সরফরাজ আলী রাহেলাকে এই কথা বললেন। এলাকার সবাই ওনাকে বলে ফুরফুরে মাস্টর। সবসময় ফুরফুরে হাসিখুশি মেজাজেই থাকেন তিনি। অকৃতদার বয়স প্রায় আটচল্লিশ ছুঁইছুঁই। একমাত্র ছোট বোনের মৃত্যুর পর তার মেয়ে রাহেলা ওর কাছেই মানুষ। মামার কাছে নিজের বিয়ের কথা শুনে রাহেলা লজ্জায় লাল হয়ে উঠে। আশেপাশের সব বান্ধবীদের মাঝে হাসি ঠাট্টা শুরু হয়ে যায়।
সেদিন সন্ধ্যা বেলা ইয়াসিরকে এক দেখাতেই ভালো লেগে যায় রাহেলার। ভীষণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন আকর্ষণীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী স্বল্প ভাষী এই মানুষটার চোখের দিকে তাকিয়েই রাহেলার মনে হলো ওর সাথে সারাটা জীবন পার করা যায় বেশ নির্বিঘ্নে। যেন ইয়াসির ওর অনেক দিনেরই চেনা, জানা। হৃদয়ের গাঁথুনি বুঝি এভাবেই গাঁথা হয়ে যায়। ধুমধাম করে এক সপ্তাহের মাঝেই ফাল্গুনের এক স্নিগ্ধ দিনে রাহেলা ইয়াসিরের বিয়ে সম্পন্ন হয় কিশোরগঞ্জের ধবল পাড়া গ্রামে। বিকেলের মাঝেই আনুষ্ঠানিকতা শেষে পালকিতে করে রাহেলা তার শ্বশুর বাড়ি আসে। সাথে নিয়ে আসে একডালি অনাগত রঙিন স্বপ্ন। বিয়ের রাতে রাহেলা লাল টুকটুকে শাড়িতে বউ সেজে বসে রয়েছে খাটে। ইয়াসির সেখানে প্রবেশ করে আচমকাই বলে ওঠে
: এই যে শুনছেন? আমি আপনাকে অনেক ভালবাসি। যেদিন প্রথম আপনাকে দেখেছি ঠিক সেই দিন থেকেই। সত্যি! কিছু মনে করবেন না। আমি আবার একটু সরাসরি কথা বলে ফেলি।
লজ্জায় রাঙা হয়ে যায় রাহেলার মুখ। কেউ যে ভালোবাসার প্রকাশ এত সরাসরি ভাবে করতে পারে তা তার জানা ছিল না। মাথা নিচু করে রইল সে।
: কি ব্যাপার? কিছু বলছেন না যে?
: কি বলব?
: বা রে ! বলে দিতে হবে এটাও!
: আমিও। একটু আস্তেই বলল কথাটা রাহেলা।
:হ্যাঁ? মাফ করবেন, বুঝতে পারি নি কথাটা।
: আমিও ।আবার বলে রাহেলা
: হা হা হা ।”আমিও “এটা বলতে মানুষ এত লজ্জা পায় আমার জানা ছিল না
ইয়াসির হাসতে থাকে লজ্জায় রাহেলা আরও একাকার হয়ে যায়।
:হা!হা!হা! ইয়াসির হেসেই যাচ্ছে। মানুষটার হাসির আওয়াজ যেন এখনও স্পষ্ট শুনতে পেল রাহেলা। গা ছমছম করে ওঠে ওর। স্মৃতির দাগ কি এত তাজা হয়?
শ্বশুর বাড়িতে মানুষ বলতে রাহেলার শ্বশুর, ইয়াসির আর ওর ছোট ভাই কাজল। বাবাকে কোনোদিন দেখে নি রাহেলা। ও যখন তিনমাসের পেটে তখন কি এক দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে ওর বাবার মৃত্যু হয়। শ্বশুর ফকরুল আলম যেন সেই অপূর্ণতাকে ঘোচালেন খুব সুন্দর করে। সবসময় রাহেলার খেয়াল করতেন। মাথায় হাত রেখে বলতেন
: তুই আমার ছেলের বউ নস; আমার মা হস রে মা। আমার মেয়ে তুই।
দুচোখ ছলছল করে উঠত রাহেলার এ সময়। দেবর কাজল কেমন যেন একটু উড়নচন্ডী গোছের ছিল। ওর চলা ফেরা, চাহনি সবকিছুতেই কেমন একটা যেন অস্বস্তির ছাপ ফেলত মনে। রাহেলা খেয়াল করত ইয়াসির আর ওর শ্বশুর সাহেব খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করত না কাজল আশেপাশে থাকলে। কিন্তু তারা রাহেলাকে এ নিয়ে কিছু বলত না সেজন্য এসমস্ত জানার জন্য রাহেলাও প্রয়োজন অনুভব করে নি কখনও খুব একটা।
দিন বেশ সুখেই কাটছিল ওর তখন! ১৯৭১ এর ফেব্রুয়ারি মাস। দেশের রাজনীতির পালে তখন পরিবর্তনের হাওয়া লাগবে লাগবে করছে। ঢাকাতে প্রায় প্রতিনিয়তই কিছু না কিছু ঘটছে। সেখানে চারদিকে মিটিং মিছিলের সরগোল নাকি লেগেই রয়েছে। জাতীয় পত্রিকাগুলো এসব খবরেই এখন ভরপুর থাকে। শোনা যাচ্ছে, পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে শান্তি পূর্ণ বৈঠকের মাধ্যমে সকল রাজনৈতিক সমস্যাগুলো নিরসন হওয়ার চেষ্টা চলছে। ভালোয় ভালোয় হয়ে গেলেই ভালো বাবা। দেশের মাঝে এসব ফ্যাসাদ গণ্ডগোল কেই বা চায়! শেখ সাহেব নিশ্চয়ই কোনো না কোনো উপায় করে ফেলবেন। সাত কোটি জনতার এই আমূল সমস্যা নিরসনে। সামনে মার্চের তিন তারিখে অ্যাসেম্বেলি বসার কথা। প্রতিদিনই খাবার টেবিলে বসে ফকরুল সাহেব আর ইয়াসিরের মাঝে এসব নিয়ে কথা হয়। চায়ের টেবিলে যেন তর্কের ঝড় বয়ে যায় প্রতি বিকেল বেলা।
: এবারে আর না…পূর্ব পাকিস্তানের আর উচিত ই না
পশ্চিমাদের কোনো অন্যায় মেনে নেওয়া। বাঙালিরাও জবাব দিতে জানে। উত্তেজিত হয়ে ফকরুল আলম বলেন
: হুম, বাবা। ঠিক বলেছ।
ইয়াসিরের কপালে চিন্তার ভাঁজ। দেশের আপাত পরিস্থিতিতে আসলে কেউ শান্তিতে নেই। মফস্বল এলাকা হওয়াতে ঢাকার খবরগুলো এখানে এতটা তড়িৎ গতিতে এসে পৌছুত না ঠিকই। তবু দেশের সংকটময় অবস্থা দেশের সমস্ত প্রান্তেই সাধারণ মানুষের মধ্যে কঠিন উদ্বেগের সৃষ্টি করে নিত। এর মাঝে নতুন চাকরির খাতিরে ইয়াসিরের ঢাকায় যাওয়ার কথা। কিন্তু রাহেলা সাহস পাচ্ছে না কোনো অবস্থাতে ওকে ঢাকা পাঠাতে। ইয়াসির রাহেলাকে বুঝিয়ে বলে
: আরে পাগলী ! ব্যাস, যাব আর আসব। যদি পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়, তখন না হয় ফিরে আসব! ঠিক আছে?
রাহেলার তাও মন মানে না। দ্বিধা দ্বন্দের মাঝেই ইয়াসির পাড়ি জমায় ঢাকাতে। ঢাকা তখন এক অনন্য ইতিহাসের সাক্ষী হবার পথে। উত্তাল ঢাকা তখন বাঁধন হারা জন সমুদ্রে পরিণত। এক কাক ডাকা ভোর বেলা রাহেলার থেকে বিদায় নিয়ে ইয়াসির এক মহা ইতিহাসের সাক্ষী হবার হাতছানির দিকে পা বাড়াল।
স্মৃতির পাতা থেকে অধ্যায়গুলো যেন জীবন্ত উপাখ্যান হয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে রাহেলার। আচমকা ওর দৃষ্টি বিঁধল জানালার দিকে। কাউকে মনে হয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল রাহেলা ওখানে? না। কেউ নেই সেখানে! কিন্তু ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে বিপরীত কথা। কে দাঁড়িয়ে ছিল ওখানে? সিরাজ না আয়ান?
[চলবে]
আরও পড়ুন :
মায়ের গয়নার বাক্স, পর্ব–১
মায়ের গয়নার বাক্স, পর্ব–২