মায়ের গয়নার বাক্স, পর্ব–২

সকাল হতেই কাজের নানা ব্যস্ততা থাকে রাহেলার। একদণ্ড যে ফুরসত মিলবে সংসারের কাজের ঝামেলা থেকে তা আর হওয়া হয়ে উঠে কই? সংসার বলতে এই বিশাল চাতাল বাড়ি, কিছু সমাজ সেবা মুলক কাজ আর আয়ান।
আয়ান! ছেলেটা ধরতে গেলে একাই বড় হচ্ছে। মা হিসেবে তেমন খুব একটা সময় রাহেলার আয়ানকে দেওয়া হয়ে উঠে না। আসলেই কি রাহেলা সময় দিতে চান আয়ানকে? নাকি ওর সামনে ব্যস্ততার নিপুণ অভিনয় আর কঠিন ব্যক্তিত্ব নিয়ে আরও প্রকটভাবে মূর্তমান হতে চান? রাহেলা নিজে কোনো উত্তর খুঁজে পান না এই প্রশ্নের।
‘মা। নিচে আয়ান বাবুর স্কুল থেকে শিক্ষক এসেছে।’ একজন আপনার সাথে দেখা করতে চান।
দরজায় সিরাজ দাঁড়িয়ে। রাহেলার শ্বশুর ফকরুলের ওকে নিয়ে এসেছিল। শুরু থেকে ওদের সঙ্গেই থাকে। তিনকূলে তেমন কেউ নেই। মা বাবা গত হয়েছেন আগেই। ভাই বোন ও নেই। রাহেলা ওঁকে সাথেই রেখেছে জমি জমা যা একটু আছে টুকটাক সেগুলো দেখা শোনা করা, রাহেলার বিভিন্ন কাজকর্মের কাগজপত্রের খেয়াল রাখা আর বদলে একটু পিঠ ফেলার জায়গা, তিনবেলা সামান্য খাওয়া আর পড়ার কাপড় এই ওর চাহিদা।
কলেজ পাশ দিয়েছে ভালোভাবেই। ছেলেটা মেধাবি প্রচুর! যে কোনো কাজ খুব সহজে গুছিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে রক্ষণাবক্ষণ করার কাজটাও খুব নিঁখুতভাবে করতে পারে। কোনো কাজের দায়ভার তার ওপর দিয়ে শতভাগ নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন রাহেলা। সিরাজ এক বাক্যে নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বস্ততার প্রতীক। রাহেলা শুনেছে ঢাকায় চলে যাবার চেষ্টায় আছে সিরাজ। ও চলে গেলে ওর শূন্যস্থান পূরণ করতে বেশ ভুগতে হবে। মনে মনে তাই ভাবে ও। সিরাজ একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক নজর ওর দিকে তাকায় রাহেলা। সিরাজ কেমন কাঁচুমাচু হয়ে যায়। চোখেমুখে স্পষ্ট অস্বস্তির ছাপ! মনে হয় যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে সরতে পারে ততই ওর জন্য ভালো। কালো মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে রাহেলা নিজের দৃষ্টি আড়াল করলে সিরাজ যেন কিছুটা স্বস্তি পেল। ঠান্ডা বরফ কন্ঠে রাহেলা বলল,
— ওনাকে বসিয়ে ঠান্ডা শরবত আর হাল্কা নাস্তা দেওয়ার ব্যবস্থা কর। আমি আসছি।
—জ্বী, আচ্ছা।
সিরাজের চঞ্চল পায়ের ফিরে যাওয়ার আওয়াজ কানে বাজে রাহেলার। আসলে ও ওর নিজেকে এতটা নিস্পৃহ করে তুলেছে যে সবাই ওর সামনে এক অদ্ভুত অস্বস্তিতে ভুগে। ও অবশ্য নিজেও চেয়েছেও তাই। স্বেচ্ছা নির্বাসন বুঝি এমনই কিছু কে বুঝানো হয়। উঁচু খাট থেকে নেমে পৌরাণিক আয়নার কাঁচে নিজেকে ঠিক করে নেয় রাহেলা। সাদা গরাদের শাড়ীর আচঁল পেচিয়ে পিঠ থেকে কাঁধ অবধি টেনে নেয়। আয়নায় নিজেকে আরেক পলক দেখে। আয়নাতে ওকেই তো দেখা যাচ্ছে, না কি? কি জানি? এখন নিজের চেহারাও ওর নিজের কাছেই মাঝে মাঝে কেমন অদ্ভুত লাগে।
বৈঠক খানার দিকে পা ফেলে রাহেলা।পুরোনো পাকিস্তান আমলের বাসা। অনেক দিক থেকেই জরাজীর্ণ দশা। দেওয়ালের গায়ে অনেক ফাঁক ফোকড়। রং চটা দেয়ালগুলোর অনেক জায়গাই একাত্তরের ভয়াবহ স্মৃতির কিছু ক্ষত চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সামান্য কিছু মেরামত করা হয়েছে এই যা। শোনা যায়, পাকিস্তানি বাহিনি এখানে মাঝে মাঝে নিরীহ লোক ধরে এনে নির্যাতন চালাত।কালের গর্ভ সেসব এখন ইতিহাস।
রাহেলার শ্বশুর ফকরুল আলম স্বাধীনতার পরে কী করে যেন এই বাড়িটা আর কিছু জমিজমার ব্যবস্থা করেছিলেন। এসব দিয়েই রাহেলার মোটামুটি চলে যায়। শ্বশুর গত হয়েছেন তা আজ প্রায় অনেক দিন। জীবনে ওনাকে ই নিজের বাবা হিসেবে জেনেছে রাহেলা।ফকরুল সাহেব তার কাছে বাবার চেয়েও বেশি কিছু। উনি না থাকলে বুঝি জীবিত লাশ হিসেবেই থাকতে হতো আজ ওঁকে! জীবিত লাশ কি আর? ওর মনে হয় এপর্যন্ত বেঁচে থাকাটাই আর হতো না।
রাহেলাকে আসতে দেখে মাস্টার খলিল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ছোট করে একটা সালাম দিল রাহেলা ওনাকে এরপর তার সেই হিম শীতল কন্ঠেই জানতে চাইল,
— বলুন। খলিল মাস্টার কি জন্য এখানে আসা?
হালকা গলা ঝেড়ে খলিল মাস্টার বলা শুরু করলেন
—কি আর বলব মা, আয়ানের লেখাপড়ার দিকে দিন দিন মনোযোগ কমতির দিকে যাচ্ছে। এবারেও অংকে আর ইংরেজীতে একই হাল।এর মাঝে…খলিল মাস্টার ইতস্তত করতে থাকে।
—বলুন, এর মাঝে কি? রাহেলা প্রশ্ন করে।
—ইয়ে মানে, গত পরীক্ষায় চুপিচুপি খাতা দেখে লিখতে গিয়ে ধরা খেয়েছিল। দিন দিন ওর অমনোযোগী হবার মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও ক্লাসে প্রায় এর সঙ্গে ওর সঙ্গে ঝামেলা পাকাচ্ছে। আপনার সন্তান। আপনাকে আমরা আলাদা চোখে দেখি। তাই হেড স্যার বললেন স্কুলে ওঁকে নিয়ে টানা হিচড়া না করে আপনার সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে। এমন অবস্থা হলে মাধ্যমিক পর্যায়ে উঠলে ওর জন্য সামাল দেওয়াটা মুশকিল হয়ে যাবে।
: হুম। ঠিক আছে। আমি দেখব।
শীতল উত্তর ভেসে আসে বিপরীত প্রান্ত থেকে।
: জ্বী। আজ তবে ওঠি। ব্যাপারটা একটু দেখবেন।
খলিল মাস্টার যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে বাড়ির গেট পার করেন তিনি। বাইরে প্রচণ্ড রোদের তাপ। ভাদ্রের অসহনীয় গরম এবার জীবন অতিষ্ট করে তুলছে। অতিরিক্ত রোদের কারণে বাইরের দিকে দৃষ্টি ফেললে কেমন যেন তাপের হলকানি নজর পড়ে। খলিল মাস্টার তাপ থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য কালো ছাতাটা মাথার ওপর মেলে ধরেন। বেশ পুরোনো ছাতা। খুলতেও খলিল মাস্টারের বেশ বেগ পেতে হলো। দূরে ঘর থেকে তা নজরে পরে রাহেলার।
রাহেলা খুব তীক্ষ চোখে আয়ানকে চারধারে খুঁজে নেন। নাহ! আয়ানকে কোথাও দেখা যায় না। কিন্তু তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে আয়ান খুব কাছাকাছি আছে। রাহেলা গাঢ় স্বরে ছেলেকে ডাক দেন
: আয়ান…
ডাকতেই পুরোনো বইয়ের তাকের পেছন থেকে আয়ান বেরিয়ে আসে। পরনে গেন্জি আর কালো হাফপ্যান্ট, তাড়াহুড়া করে বের হওয়াতে প্যান্টের পকেট থেকে তিনটে মার্বেল গড়িয়ে নিচে পড়ে যায়। রাহেলা সেইদিকে নিষ্পলক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। পট পট পট শব্দ তুলে মার্বেল গুলো মেঝের বিভিন্ন প্রান্তে পড়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।
রাহেলা আবার আয়ানের দিকে তাকান। কী হিমশীতল দৃষ্টি! আয়ানের রক্ত যেন শীতল হয়ে যায়। চোখ নামিয়ে ফেলে ও। একই ভাবে রাহেলা খুব আস্তে। কিন্তু খুব কড়া ভাবে আয়ানের দিকে তাকিয়ে বলেন
: এদিকে এসো।
আয়ানের শরীর অবশ হয়ে আসে। এক পা দু’পা করে সে তার মায়ের দিকে এগিয়ে আসে।
: সিরাজকে বলে দিচ্ছি মাস্টার সাহেবের জন্য একটা নতুন ছাতি নিয়ে আসতে। নিয়ে এলে মাস্টার মশাইকে পৌঁছা দিবে।
নিষ্পৃহ ভাবে কথাগুলো আয়ানকে বলল রাহেলা। যেন একথাটা বলার জন্যই সে আয়ানকে খুজেছিল। একবারের জন্যও খলিল মাস্টার মশাইয়ের আয়ানের সম্পর্কে করা অভিযোগ নিয়ে কিছু বললেন না। যেন তিনি কিছুই জানেন ই না। কথাটা শেষ করে ভাবলেশহীন ভাবে রাহেলা তার ঘরের দিকে চলে গেল।
আয়ান অবাক দৃষ্টিতে তার মায়ের চলে যাওয়া পথের দিকে তাঁকিয়ে থাকে। তার চোখে রাজ্যের বিস্ময়।
[চলবে]
সোনিয়া তাসনিম খান : কথাসাহিত্যিক
পড়ুন : মায়ের গয়নার বাক্স, পর্ব–১
খুব ভালো লাগছে, কাহিনী আর লেখনী।