একটি ঐহিত্যবাহী জনপদ : তালগাছি

প্রথমেই বলে রাখি তালগাছি আমার নিজের গ্রাম নয়। আবার কর্মস্থলও নয়। তবে, একটি ভাড়াটে বাড়িতে গত পাঁচ বছর যাবত আমি তালগাছিতে বসবাস করি। প্রথম প্রথম ভীষণ খাপছাড়া লাগত। নতুন একটি জায়গা। অচেনা অজানা মানুষ। কোনো বন্ধু নেই। নেই কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী। ভীষণ একাকীত্ব অনুভব করতাম। এখন অনেকটা মানিয়ে গেছে। এ কথা সত্যি যে এখানকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য প্রথম দিন থেকেই আমাকে আকৃষ্ট করেছে।
তালগাছি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের গাড়াদহ ইউনিয়নের অন্তর্গত একটি প্রাচীন গ্রাম। এই জনপদের বয়স আনুমানিক প্রায় দুইশত বছর। ধারণা করা হয় তদান্তীন কালে এখানে অনেক তালগাছ ছিল। তালগাছের সংখ্যাধীক্য থেকেই এখানকার নামকরণ হয় তালগাছি। তবে বিগত একশত বছরের মধ্যে এখানে কোনো তালগাছের অস্তীত্ব খুঁজে পাওয়া যায় নি। জনশ্রুতি রয়েছে যে উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে তালগাছিতে বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ের একজন খ্যাতিমান কবি এসেছিলেন। যিনি এখানে কোনো তালগাছ খুঁজে না পেয়ে মনের আক্ষেপে বলেছিলেন—‘এসেছিলাম তালগাছি ভাই
কিন্তু সেথায় কোনো তালগাছ নাই।’

তালগাছি মূলত একটি গ্রামের নাম হলেও, তালগাছিকে শুধু গ্রাম বললে ভুল হবে। তালগাছিকে শাহজাদপুর উপজেলার উপশহরও বলা যেতে পারে। কেননা গাড়াদহ, কায়েমপুর, নরিনা এমন কী পাশবর্তী উল্লাপাড়া উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের অনেক গ্রামের সদর বাণিজ্যিক কেন্দ্র তালগাছি। আশপাশের প্রায় পঞ্চাশটি গ্রামের লোকজন দৈনন্দিন কেনাকাটার জন্য তালগাছিতে যাতায়াত করে। সেই সুবাধে তালগাছি হয়ে উঠেছে একটি সমৃদ্ধিশালী বাণিজ্যিক কেন্দ্রবিন্দু। তালগাছি ও তার পাশ্ববর্তী অঞ্চল এমনকি সমগ্র শাহজাদপুর উপজেলা গবাদিপশু বিশেষ করে গাভী পালনের জন্য বিখ্যাত। ফলশ্রুতিতে তালগাছি বাজার হয়ে উঠেছে গো খাদ্য ক্রয় বিক্রয়ের এক প্রসিদ্ধ স্থান। এছাড়া এখানে রয়েছে একাধিক দুগ্ধ সংগ্রহ এবং দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্র। গো খাদ্য পাশাপাশি তালগাছি তেল ও সরিষা ক্রয় বিক্রয়ের এক জনপ্রিয় আড়ৎ। সরিষার মৌসুম ছাড়াও এখানে সারা বছর সরিষা ক্রয় বিক্রয় হয়। সরিষা থেকে তেল উৎপাদনের জন্য এখানে রয়েছে একাধিক তেলের মিল। এই সকল তেলের মিলে উৎপাদিত তেল দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়ে থাকে।
তালগাছি গাড়াদহ ইউনিয়ের একটি গ্রাম হলেও তালগাছিকে গাড়াদহ ইউনিয়নের সদর দপ্তর বললে অত্যুক্তি হবে না। কেননা গাড়াদহ ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, ইউনিয়ন ভূমি অফিস এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ ছোট বড় ১৩টি সরকারি অফিস/স্থাপনা তালগাছিতে অবস্থিত। এছাড়া এখানে রয়েছে একটি সরকারি ভোকেশনাল, রয়েছে একটি কলেজ এবং একটি হাইস্কুল। ১৯৪১ সালে জনৈক আবু ইসাহাক মিয়ার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং সার্বিক সহযোগিতায় এই হাইস্কুলটি নির্মিত হয়। যিনি তার নিজস্ব পাঁচ–সাত বিঘা জমির উপর উক্ত হাই স্কুলটি স্থাপন করেন। তাই তাঁর নামনুসারে এই স্কুলের নামকরণ করা হয় ‘তালগাছি আবু ইসহাক উচ্চবিদ্যালয়’। উল্লেখ্য, আবু ইসহাক মিয়া তালগাছি হাটের সর্বপ্রথম ইজারাদার ছিলেন এবং একজন জনদরদী মানুষ হিসেবে অত্র অঞ্চলে তার যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। তালগাছি আবু ইসহাক উচ্চবিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র-ছাত্রী প্রমিথযশা বরেণ্য মানুষ হিসেবে দেশ-বিদেশে সুনাম অর্জন করেছেন। তাঁদের মধ্যে আর্ন্তজাতিক ফোকলরবিদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপচার্য এবং বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ড. মযহারুল ইসলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপচার্য ড. মুহাম্মদ আব্দুল খালেক, রাজশাহী বিশ্বাবিদ্যালয়ের ফোকলর বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ আব্দুল জলিল, প্রকৌশলী মো. মোখলেছুল হক প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৩ সালে তালগাছিতে প্রায় ১০ বিঘা জমির উপর ড. মযহারুল ইসলাম একটি কলেজ প্রতিষ্ঠিত করেন। যাঁর নামকরণ করা হয় ‘করতোয়া কলেজ’ । এছাড়া এখানে ১০-১২টি কিন্ডার গার্টেন এবং ১২-১৫ টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান (ব্যাংক/এনজিও) রয়েছে।

তালগাছি বাণিজ্যির কেন্দ্রবিন্দুর হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো এখানকার পশুর হাট। ব্রিটিশ শাসনামলে থেকে তালগাছি পশুরহাট বিখ্যাত ছিল। সিরাজগঞ্জ জেলা হওয়ার পূর্বে তদকালে পাবনা জেলার সর্ববৃহৎ হাট হিসেবে তালগাছি হাটের বেশ সুনাম ছিল। প্রায় ২০-২৫ বিঘা জমির উপর অবস্থিত তালগাছি হাট। হাট বসে সপ্তাহে একদিন। প্রতি রবিবার। তালগাছি হাট নিয়ে অনেক মিথ প্রচলন আছে। স্থানীয় প্রবীণ লোকজন বলে থাকেন—তালগাছি হাটে একসময় পরী নামত। যখন হাটে পরী নামত তখন হাটের ভেতর এক ধরণের গুম গুম আওয়াজ হত। দুই চার পাঁচ মাইল দূরে থেকে সেই গুম গুম আওয়াজ শোনা যেত। যেদিন হাটে পরী নামত সেদিন হাটের কোনো সদাই (দ্রব্যাদি) থাকত না। সকল দ্রবাদি বিক্রি হয়ে যেত। কেউ কেউ বলেন—হাটের দিন মিষ্টির গন্ধে বড় বড় বিশেষ এক ধরণের মৌমাছি আসত। তবে সেই মৌমাছি কাউকে কামড় (হুল ফুটানো) দিত না। হাটের পরেরদিন দুপুর পর্যন্ত সেই মৌমাছির আনাগোনা থাকত। তারপর আর খুজে পাওয়া যেত না। আবার রোববারের হাটের দিনে সেই মৌমাছিগুলো ফিরে আসত। একসময় অনেক দূর দূরান্ত থেকে গরুর ব্যাপারি তালগাছিতে আসত। বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, পলাশবাড়ী, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, মুন্সিগঞ্জ প্রভৃতি এলাকা হতে অনেক ব্যাপারি গরু ক্রয়ের জন্য তালগাছি হাটে আসত। অর্থাৎ পাকিস্তান শাসনামলে বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তান) ১৭টি জেলার মধ্যে প্রায় ১২–১৩টি জেলার লোক গবাদিপশু (গরু/ছাগল) এবং পাট ক্রয়ের জন্য তালগাছি হাটে আসত। ব্যাপারিরা পশু ক্রয় করে উল্লাপাড়া স্টেশন থেকে ট্রেনযোগে বাড়ি ফিরে যেত এবং তাদের রাখালগণ পায়ে হেঁটে সেই পশুগুলো নিয়ে যেত। দূর-দূরান্তের ব্যাপরিগুলো হাটের আগের দিন অর্থাৎ শনিবার বিকেলে ট্রেনযোগে এসে উল্লাপাড়া স্টেশনে নেমে তারপর তারা সেখান থেকে পায়ে হেঁটে তালগাছিতে যেত। তালগাছিতে আসার পর তারা রাতযাপন করত। তালগাছি হাটের ইজারাদ্দার ছিলেন আবু ইসহাক মিয়া। যিনি শুধু তালগাছি হাটের ইজারাদার নয় তালগাছি হাটের উন্নয়নের রূপকার। আবু ইসহাক মিয়ার পূর্বে জমিদারও এই হাটে দায়িত্ব ছিলেন। আবু ইসহাক মিয়া হাটটি ইজারা নেওয়ার পর হাটটি ক্রমান্বয়ে একটি প্রসিদ্ধ হাটে পরিণত হয়। দূর-দূরান্তে থেকে ব্যবসারা আবু ইসহাকের কাছে টাকার তহবিল (কাপড়ের তৈরি এক ধরণের টাকা রাখার ব্যাগ) রেখে পরেরদিন সকালে তার কাছে নিয়ে যেত। টাকার তহবিলগুলো নাম লিখে আবু ইসহাক সিন্দুকে রাখা হত। তালগাছি হাট নিয়ে এই এলাকায় একটি আঞ্চলিক লোক ধুয়া গান প্রচলন আছে। গানটি হলো—
এ… রে তালগাছি মোকামের কথা কি বলিবো আর
ঠাকুর বাবু হাট বসাইছে এছাক মিয়া এজাদ্দার
এ… রে বাড়ি তাহার সরিষাকোলে তালগাছি করে কারবার
টিনের তিনহান ঘর তুলছে দেখতে কি বাহার
একখান হয় তার বৈঠকখানা আর দুইখান কারবার
এ… রে আরেকখান ঘর তুলছে অনাথ পোদ্দার নাম
ও… রে জগবালা ঘর তুইলা করত্যাছে মিটের দোকান
হাটের উত্তরেতে বসত বাড়ী পুবে খরিদ্দারের ছাহাম
রোজ হাজী ঘর তুলিয়া করলো বড় নাম
এই হাটেতে কতজনা করে কত কাম
এ… রে হাটের দক্ষিণেতে খেলার ফিল্টার জানে সকলেই
ওই গাড়াদহ আর বারই টেপরি ওরাই খেলে ফাইনালে
এ… রে করে সব দৌড়াদৌড়ি মারে গুড়ি গোল দেওয়ার আশা করে
মানুষ মরার কথা শুইনা খেলে না ভয়ে
বারইটেপরির রুস্তম উল্লাহ গোলে বল দিলো শট করে।
তালগাছি গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে খরস্রোতা করতোয়া নদী। বর্ষা মৌসুমে এই নদীতে পানি থৈ থৈ করে। সেই সঙ্গে পানিতে প্রবল স্রোত বইতে থাকে। বর্ষা মৌসুম ছাড়াও সারা বছর নদীতে পানি থাকে। এই নদীর মাছের আলাদা এক ধরণের স্বাদ রয়েছে। যা সচরাচর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এই নদীতে অনেক ধরণের মাছ ধরা পড়ে। তন্মধ্যে গলদা চিংড়ি, বাগদা চিংড়ি, বোয়াল, বায়াম, রুই, কাতল, কালবাউস, শিং, মাগুর, নন্দই, পুটি, চান্দা, চেলা, মলা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। করতোয়া নদীতে মাঝেমধ্যে ইলিশ মাছও ধরা পড়ে। নদীতে মাছ ধরার জন্য ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন লোক প্রযুক্তি যেমন, হড়কা, বড়শি, ফাসি জাল, তোইরা জাল, ঠেলা জাল, দিয়াল প্রভৃতি।
আশরাফ খান, সম্পাদক, আবেগ (সাহিত্য বিষয়ক ছোট কাগজ)