কাশ্মীরের জাফরান

জাফরান। হিন্দিতে কেশর আর ইংরেজিতে saffron. বিভিন্ন উঁচুদরের খাদ্য ও পানীয়তে ব্যবহৃত জাফরান পৃথিবীর সবচাইতে দামী মশলাই শুধু নয় এর ঔষধি গুণেরও নাকি শেষ নেই। গ্রীস, স্পেন, আফগানিস্তানসহ অনেক দেশে এবং বেশিরভাগ উৎপাদন ইরানে হলেও স্বাদ, গন্ধ তথা উৎকর্ষের নিরিখে কাশ্মীরের জাফরান সর্বোৎকৃষ্ট।
১৯৮৬ সালে প্রথম কাশ্মীরে এসে জাফরান বিক্রি হতে দেখেছিলাম কিন্তু ফুল সম্বন্ধে কোনো ধারণা ছিল না। বেশ কয়েক বছর পরে শ্রীনগরের পর্যটন দপ্তরে প্রথম তার ছবি দেখে একটা ধারণা তৈরি হয়।
শ্রীনগর থেকে জম্মুগামী রাস্তায় শহরের ঠিকঞ্জ প্রান্তসীমায় বাদামীবাগ ক্যান্টনমেন্ট, উপত্যকার সবথেকে বড় সেনাছাউনি। জাতীয় সড়কের দুপাশেই তার বিস্তার। একদিক থেকে অপর দিকে আপৎকালীন সময়ে যাবার জন্য রাস্তার ওপর দিয়ে তৈরি করা ফুটব্রীজ। চিনার, পপলার, উইলো গাছে সাজানো এই রাস্তায় সবসময়ই এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করে। বাদামীবাগ ছাড়িয়ে আবার স্বপ্নের উপত্যকা, শ্রীনগর থেকে মাত্র বারো কিলোমিটার গেলেই পাম্পোর, অনেকে বলেন পামপুর। ছোট ঘিঞ্জি শহর, পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে ঝিলাম। ৪৪ নম্বর জাতীয় সড়ক দেশের মধ্যে অন্যতম ব্যস্ত সড়কপথ। উপত্যকার বুক চিরে যাওয়া মসৃণ সেই পথে ঘন্টার পর ঘন্টা চললেও বোঝা যায় না যে ছ’হাজার ফুট উচ্চতায় আছি, কোথাও পাহাড়ী পথের স্বাভাবিক চড়াই উৎরাই নেই। পাম্পোর শহর ছাড়ানোর কিছুটা পরেই রাস্তার দুপাশে ধু ধু প্রান্তর। প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ এই জমিতেই চাষ হয় জাফরানের।
পাম্পোর থেকে জম্মুগামী রাস্তায় জাফরান ক্ষেত পেরোনোর পরেই রাস্তার দুপাশে ছোট বড় বহু দোকান, সাইনবোর্ডে ছবিসহ শ্রেষ্ঠ জাফরানের বিজ্ঞাপন, ঠিক যেমন আমড়াতে সারিবদ্ধ শক্তিগড়ের ল্যাংচার দোকান, অনেকটা সেরকম। ছোট এক দোকান ‘নূর কেশর’, তার মালিক বিলালের সঙ্গে প্রথম পরিচয় পরবর্তীতে সখ্যে পরিণত হয়। জাফরানের সঙ্গে আখরোট, কাঠবাদাম, শুকনো আপেল, খোবানি, বিভিন্ন রকমের কাশ্মীরি মশলা, আচারে ঠাসা দোকান। সেখানেই কাওয়া বা কেওয়া চায়ের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। জাফরান ছাড়াও আখরোট, বাদাম, এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি, গোলাপ ফুলের পাপড়ি দিয়ে তৈরি মহার্ঘ্য সেই চা স্বাদে গন্ধে যেরকম অতুলনীয়, দ্রুত কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতেও তা নাকি কাজ দেয়। দোকানের পিছনেই তাদের নিজেদের ক্ষেত, ফুলের সময়ে গেলেই সেই জমিতে যাওয়া হয় ফুল দেখতে।

নিকাশির ব্যবস্থা ছাড়া বাইরে থেকে জমির বিশেষত্ব নজরে পড়ে না। কাছে গেলে দেখা যায় যে ছোট ছোট চতুষ্কোণ ঢিপির আকারে ভাগ করা হয়েছে জমিটাকে। সারা বছর অন্য কোন ফসলের চাষ হয় না। গরমের শুরুতে জমি তৈরি করে বীজ বপন করতে হয়। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে ফুল ফোটে। মাত্র সপ্তাহ তিনেক আয়ু ফুলগুলির। পেঁয়াজের মতন দেখতে গাছেদের উচ্চতা বড়জোড় এক ফুট হয়। উজ্জ্বল বেগুনী বর্ণের ফুলের ভিতর গর্ভকেশরের পরাগবাহী অংশ। ফুলের ভিতর থেকে সেগুলিকে তুলে শুকিয়ে জাফরান তৈরি হয়। প্রায় দু’লক্ষ ফুল থেকে তৈরি হয় এক কিলোগ্রাম জাফরান। স্থানীয় বাজারে তার পাইকারি মূল্য কমবেশী দুই থেকে আড়াই লক্ষ টাকা। সোনার মতন নিক্তিতে মাপা হয় এক গ্রাম, দু’গ্রাম তারপর ছোট ছোট প্লাস্টিকের কৌটায় ভরে বিক্রি হয়।
জমিতে গাছগুলো ঘন সন্নিবিষ্ট নয়, একটু ছাড়া ছাড়া। একসঙ্গে সব গাছে ফুল হয় না। ফুল তোলা থেকে প্রক্রিয়াকরণের কাজে সাধারণত বাড়ির মহিলারাই অংশগ্রহণ করেন।

ভালো করে দেখার জন্য জমিতে বসে পড়তে হয়। ঝুরঝুরে মাটি থেকে বেরোন পেঁয়াজের মতন গাছে অতি উজ্জ্বল বেগুনী বর্ণের ফুলগুলি ফুটে আছে। বেশিরভাগ গাছেরই চিহ্ন নেই, যেন ফুলগুলির অত্যাশ্চর্য রূপের ঘায়ে তারা মূর্ছা গেছে। ছয়টি পাপড়ি বিশিষ্ট ফুলের মধ্যে থেকে সোনালী কমলা যাকে আমরা জাফরানি রঙ বলি, সেই রঙের পরাগ দণ্ডগুলি উঁকি মারে। মাটি ফুঁড়ে বের হয়েছে মনে হলেও তাদের রূপে ঔদ্ধত্যের বদলে এক ধরনের লাজুকতারই প্রকাশ পায়। মাটিতে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাদের রূপ দেখতে থাকি। কয়েকটি সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলকে দেখে পদ্মের কথা মনে পড়ে, চকিতে জায়গাটির নামকরণের কারণ বোধগম্য হয়। আজ যা পাম্পোর প্রাচীনকালে তার নাম ছিল পদমপুর।