জন্মের কাজ জন্ম করেছে, মৃত্যুর কাজ মৃত্যু করবে : গোলাম মুস্তফা, পর্ব : ১০


সাহাদাত পারভেজ : আপনি তো টেলিভিশনে চাকরি করেছেন, অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করেছেন? বিটিভির কাছে কি আপনার কাজ সংরক্ষণ করা আছে? কিংবা আপনি যে ছবি তুলেছেন, সেগুলো ঠিকঠাকভাবে প্রিজার্ভ করতে পেরেছেন?
গোলাম মুস্তফা : যা অফিসের জন্য তুলেছি সেগুলো অফিসকে দিয়ে দিয়েছি।বিটিভি এসব নিয়ে কোন কেয়ারই করে না। বিটিভি এতোবার ওলোট পালোট হয়েছে, ভেতরের চেহারা এতো পরিবর্তন হয়েছে; অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বিটিভির আর্কাইভে নাই।
আমাদের বিখ্যাত নাটক, যে নাটকগুলোর জন্য আমরা গর্ব করতে পারি। যেমন মুস্তফা মনোয়ারের প্রযোজনায় ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’ বা ‘রক্তকরবী’ এসব রেকর্ড রাখে নাই বিটিভির লোকজন। আমি যে ক্যামেরা ওয়ার্ক ভালো করেছি মুস্তফা মনোয়ারের তিনটা কাজে মুস্তফা মনোয়ারের নৃত্যনাট্য আলীবাবা, শেক্সপিয়ারের মুখরা রমণী বশীকরণ, রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর এগুলোর মেইন ক্যামেরাম্যান আমি। এগুলো বিটিভি রাখে নাই। তবে এর ছিন্ন ছিন্ন টুকরো বোধ হয় কোনো কোনো জায়গায় আছে।
তবে মনের তাগিদে যে ছবি তুলেছি সেগুলো কিছু আছে। তবে ভেরি ব্যাডলি প্রিজার্ভড। ব্যাডলি প্রিজার্ভড মানে নেগেটিভ আকারে আছে। নেগেটিভগুলো স্ক্যান করে কখনো সিস্টেমেটিকালি সাজাইনি। ওটাই বললাম, এই যে বড় গ্যাপটা গেল, ছয় মাসের একটা গ্যাপ, ওইটাই করতে পারা উচিত ছিল।
সাহাদাত পারভেজ : এটা খুব সহজে যাবে বলে মনে হয় না। আপনি গুছিয়ে ফেলেন?
গোলাম মুস্তফা : করব ইনশাল্লাহ। ইচ্ছে আছে। যেটা করে কোথাও দিয়ে যাব আমি। এগুলো তো আমি নিজে রাখতে পারব না।

সাহাদাত পারভেজ : আপনি ডিজিটাল ক্যামেরায় কবে এলেন? আপনি তো সাদাকালো ছবি তুলতেন।
গোলাম মুস্তফা :আমি সবার পরে এসেছি। যখন দেখলাম ডিজিটাল ছাড়া আর উপায় নাই। উপায় নাই এজন্যে যে, ফিল্ম প্রসেসিং খুব খারাপ হওয়া শুরু করল। তুমি অনেক হিসাব নিকাশ করে ছবি তুলবে, কিন্তু সেই ছবিটা প্রসেসিংয়ের কারণে খারাপ হয়ে গেল, সেটা খুব কষ্টকর ব্যাপার। পরে দেখলাম যে, একমাত্র ডিজিটাল ছবি তুললেই ওটা আর প্রসেসিং করতে হয় না। অটো প্রসেস হয়ে যাচ্ছে আর ফিল্মও কিনতে হচ্ছে না। বারবার ফিল্ম কেনা অনেক খরচের ব্যাপার। আর ওই সময়ে ফিল্ম পাওয়াও যেত না। শেষের দিকে কিন্তু পাওয়াই যেত না। কিন্তু যখন ফিল্ম ছিল তখন ফিল্ম কিনতাম, প্রসেসিং এবং প্রিন্টও নিজে করতাম। তিনটা কাজই নিজে করতাম। সবাই তাই করত। যিনি প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার তিনি নিজে ছবি তুলবেন, প্রসেসিং করবেন এবং প্রিন্টও করবেন।
সাহাদাত পারভেজ : আমরা শেষের দিকে চলে এসেছি। কিছু কিছু ব্যাপারে আপনার অভিমত শুনতে চাই।
গোলাম মুস্তফা : আমি একটা কথা বলি। কথাটা তোমার ভালো নাও লাগতে পারে। বিপিএস কোনো রকমে আজও টিকে আছে, জাস্ট টিকে আছে। অপরদিকেআমরা ফটোগ্রাফাররা এত বিক্ষিপ্ত, এত ছিন্নভিন্ন, পারস্পরিক সম্মানবোধ পর্যন্ত নাই।
সাহাদাত পারভেজ : নতুনদের সামনে এগোনোর জন্য কি করা উচিত?
গোলাম মুস্তফা : নতুনরা এগিয়ে আসলে আমরা আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা ও ইনফরমেশন দিয়ে তাঁদের সাহায্য করতে তৈরি কিন্তু। কিন্তু কেউ আসে না। সবাই চিন্তা করে যে আমি ভালো ছবি তুলব, এক্সিবিশনে পাঠাব, প্রাইজ পাব। এটা খারাপ না। একটা ছবি কোথায় দাঁড়িয়ে আছে ওটা জানার জন্যে এক্সিবিশন দরকার। এক্সিবিশনে গেলে ছবিটার একধরনের ফিডব্যাক পাওয়া যায়। ছাত্রজীবনে একবার এক্সিবিশনে ছবি দিয়ে মনে হল, আমি বোধ হয় ভুলই করলাম। এখানে যে ছবি আছে তাতে আমার ছবি দাঁড়ায় না। আগে বুঝলে ওখানে ছবি দিতাম না।

সাহাদাত পারভেজ : আমারও মনে হয় পুরস্কার পাওয়া ভালো। কিন্তু পুরস্কারটা নেশায় পরিণত হওয়াটা ভালো না। হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন যে, পুরস্কার মাঝেমাঝে পাওয়া ভালো, তবে নিয়মিত পাওয়া লাম্পট্য।
গোলাম মুস্তফা : আমি এর সঙ্গে একটু যোগ করি? অনেকেই বলে যে পুরস্কার পেলেই কি বড় ফটোগ্রাফার হয়ে গেল? আমাকে এ কথা অনেকবার শুনতে হয়েছে। আমি বলি যে দেখ, একটা ছবি পুরস্কার পাওয়া মানে অন্য ছবি থেকে কোনো না কোনো ভাবে একটুখানি ব্যাতিক্রম। একটা জায়গায় দশটা ছবি আছে। এরমধ্যে একটা ছবির দিকে বিচারকদের মনোযোগ বেশি হচ্ছে। মনোযোগ বেশি হচ্ছে কেন? ওই ছবির গুণেই কিন্তু। ওই আকর্ষণ তৈরি হওয়ার জন্য কোনো না কোনো উপাদান ওই ছবির মধ্যে আছে। তা না হলে চারজন বিচারক একটা ছবির প্রতি আকৃষ্ট হবেন কেন? একটা ছবি বিচারের পর যখন ফার্স্ট হয়, তার মানে কি? কয়েকজন বিচারকের রায়েই এটা হয়। অ্যাকসিডেন্টলি না হয় একটা দুটো পেতে পারে। কিন্তু যখন নাকি কেউ বারবার পুরস্কার পায় বিভিন্ন এক্সিবিশনে, তখন ভাববার বিষয় আছে।
সাহাদাত পারভেজ : আর কিছু বলতে চান? বিশেষ কিছু?
গোলাম মুস্তফা : কন্টাক্ট শিট বলাতে একটা কথা মনে হল। বেগ সাহেবের মৃত্যুর দুই বছর আগের ঘটনা। উনার ক্লাস রাত ৮টার দিকে শেষ হত। শেষ হলে আমি তিনতলায় যেতাম। উনার একটা ম্যাগ্নিফাইং গ্লাস ছিল। কপালে আটকে রাখতেন। ওটা দিয়ে দুই চোখ খুলে আরামসে দেখা যায়। আমাদের যেমন এক চোখ বন্ধ করে দেখত হয়, সেরকম না। ওটা দিয়ে কন্টাক্ট শিট আর নেগেটিভের যে সাইজ তার থেকে ছয়গুণ বড় দেখা যায়। গ্লাসটা উনি বিদেশ থেকে এনেছিলেন বা আনিয়েছিলেন। তাঁর থেকে আমি মাঝেমাঝে ধার নিয়ে আসতাম। বেশ কয়েকবার নিয়েছি। আবার ফেরত দিয়েছি। কয়েকবার দিতে দেরি হয়ে গেছে।
একবার উনি বললেন, ‘আপনি কয়দিন পর পর এটা নিয়ে যান। আবার দিতে দেরি করেন। আমার যখন দরকার তখন পাই না। আপনি একটা কাজ করেন, এটা নিয়েই যান। আর আমাকে তিনশ টাকা দেন।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘তিনশ টাকা কেন?’
তিনি বললেন, ‘আমার তিনশ টাকা লেগেছে এটা আনতে।’
আমি দেখলাম এরকম অফার তো আর পাওয়া যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে ক্যাশ দিয়ে ওটা নিয়ে নিলাম। আমার কাছে ওটা এখনও আছে। হাত থেকে পড়ে গেছে, ডাঁট ভেঙে গেছে। টেপ দিয়ে আটকিয়ে এখনও ব্যবহারযোগ্য রেখেছি। কন্টাক্ট শিট দেখার জন্য এর থেকে আদর্শ জিনিস আর দেখিনি। আমি রেখে দিয়েছি ওটা, গুরুর স্মৃতি হিসেবে।

সাহাদাত পারভেজ : আপনি দুই দিন আমাদের অনেক সময় দিলেন। অনেক কৃতজ্ঞতা আপনার প্রতি।
গোলাম মুস্তফা : শোনো, আমার কথা হচ্ছে কি, ওই যে রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত লাইনটা আছে না ঘুরে ফিরে মনে পড়ছে, ‘হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, সুধাইলো না কেহ।’ তোমরা সুধাইলে তাই বললাম।

সাহাদাত পারভেজ: একেবারেই শেষ প্রশ্ন। আপনার এখন বয়স আটাত্তর বছর। আর কত দিন বাঁচতে চান?
গোলাম মুস্তফা : আমার প্রিয় একজন মানুষ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। গত বছর তিনি তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে একটা কথা বলেছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, মৃত্যু নিয়ে কী ভাবছেন? উনি কথাটা কতখানি বিশ্বাস থেকে বলেছেন আমি জানি না। তবে আমার কিন্তু শুনতে খুব ভালো লেগেছিল। ভালো লেগেছিল এই জন্য যে, আমারও ওই ভাবনাতে বা ওই ধারাতেই চিন্তা করা উচিত। উনি বলেছিলেন, ‘জন্ম জন্মের কাজ করেছে, যার জন্য আমি আজকে এখানে আছি। আর মৃত্যু মৃত্যুর কাজ করবে। ওটাকে বাধা দেবার কোনো চেষ্টা করব না। আর আমার যে কাজ সেটা আমি করতেই থাকব। আমি ওটা নিয়ে ভাবি না। মৃত্যুর যখন সময় হবে, মৃত্যু তার কাজ করবে। ওকে বাধা দিয়ে লাভ নেই। কিন্তু যত দিন বেঁচে আছি ততদিন আমি আমার কাজ করে যাব।’
আমারও মনে হয় এই চিন্তটাই সবার করা উচিত। মৃত্যুকে আটকাবার চেষ্টা করা উচিত না। তার মানে এই না যে আমি ওষুধ খাব না। অসুখ হলে ওষুধ খাব। ওষুধ খেয়ে যতদিন বাঁচব, ওটাই আমার জীবনকাল।
সুশান্ত পালের ধারণ করা ভিডিওচিত্র থেকে অনুলিখন করেছেন জাহরা জাহান পার্লিয়া
শেষ পর্ব
আরও পড়ুন :
ক্যামেরার কারণে আমার কাজের মান ভালো হয়ে গেল : গোলাম মুস্তফা, পর্ব-১
কলেজের ম্যাগাজিনের কাভারে ছবি ছাপানো হওয়ার গর্বে আমার তো ঘুম নাই : গোলাম মুস্তফা, পর্ব-২
’ ৭১-এর টেলিভিশনের চাকরি ফেলে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, বৃদ্ধ বাবা মাকে টর্চার করবে ভেবে কোথাও যাইনি : গোলাম মুস্তফা, পর্ব-৩
১০ জানুয়ারির ঘটনাটা বলতে গেলে কেন জানি আবেগী হয়ে যাই : গোলাম মুস্তফা, পর্ব-৪
চারুকলায় ক্যামেরা, এনলার্জার কেনা হলো কিন্তু ফটোগ্রাফি বিভাগটা আর খোলা হলো না : গোলাম মুস্তফা, পর্ব-৫
ফটোগ্রাফি নেভার লাইজ : গোলাম মুস্তফা, পর্ব : ৬
এখন তো বাংলাদেশের ফটোগ্রাফি অন্যস্তরে চলে গেছে : গোলাম মুস্তফা, পর্ব : ৭
‘আমি যা দেখি তুমি কি তা দেখো?’ : গোলাম মুস্তফা, পর্ব : ৮
ইমেজ ইজ সো পাওয়ারফুল, সো কনভিন্সিং, সিইং ইজ বিলিভিং : গোলাম মুস্তফা, পর্ব : ৯
চিরবিদায় একুশে পদকপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী শিল্পী গোলাম