ফটোগ্রাফি নেভার লাইজ : গোলাম মুস্তফা, পর্ব : ৬

ছবি : সাইফুল আমিন কাজল
সাহাদাত পারভেজ: আপনার সঙ্গে তো অনেক আর্টিস্টের যোগাযোগ আছে। ফটোগ্রাফি আর্ট কিনা- এই নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কি মাঝে মাঝে আপনার তর্ক হয়?
গোলাম মুস্তফা: আমি একটা ছোট ঘটনা বলি। একবার চারুকলায় আমাকে দাওয়াত করলেন বিচার কাজের জন্য। ওখানে পেইন্টিংও আছে, ফটোগ্রাফিও আছে। তখন যিনি চারুকলার প্রধান ছিলেন, তাঁর নামটা বলব না। তো উনি বললেন, এখানে ফটোগ্রাফি কেন থাকবে?
তখন আমি বললাম, ‘ফটোগ্রাফি কম্পিটিশনের মধ্যে পেইন্টার থাকে না? তাহলে পেইন্টিংয়ে ফটোগ্রাফার থাকবে না কেন? খালি ক্লিক করলেই ছবি হয়? ক্লিক করার আগে তাঁর যে পড়াশোনা, অধ্যাবসায় সেগুলো আপনি বিচার করবেন না?’
তখন উনি বললেন, ফটোগ্রাফি কি আর্ট?
শুনে আমার ভেতরে রক্ত টগবগ করছে। আমি অবাক হলাম একটা আর্ট ইনস্টিটিউটের প্রধান, অথচ তিনি বলছেন ফটোগ্রাফি কি আর্ট? আবার একটু ভালো লাগল যে উনার পাশে বসে আছে যেসব নতুন শিক্ষক, তাঁদের মধ্যে একজন বললেন, হ্যাঁ স্যার, ফটোগ্রাফি তো আর্ট।
উনি আবার বললেন, ‘কী করে আর্ট হলো?’
আমি বললাম,‘ফটোগ্রাফি যে আর্ট হিসেবে স্বীকৃত, আপনি বোধ হয় আপডেট না। নিউইয়র্ক মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টের বাঁ দিকের গ্যালারিটি এবং তার বাঁ দিকের হলটা ফটোগ্রাফি দিয়ে সাজানো। আরেক দিকের হলটা সাজানো পেইন্টিং দিয়ে। একটা পেইন্টিংয়ের আর্ট গ্যালারি, আরেকটা ফটোগ্রাফির আর্ট গ্যালারি। ফটোগ্রাফি যদি আর্ট না হয় তাহলে ওখানে স্থান পেল কী করে!’
উনি বললেন, ‘আমি তো দেখিনি।
আমি বললাম, আপনি দেখেননি এটা আপনার সমস্যা। আপনি না জানলে জেনে নিন। ফটোগ্রাফি অফকোর্স আর্ট, বিশ্বে স্বীকৃত এটা। এ দ্বন্ধ তো অনেক দিন আগেই সমাধান হয়ে গেছে।’
সাহাদাত পারভেজ: শুরুর দিকে দুইটা পুরস্কারের কথা আপনি বলেছিলেন। পরে আপনি আর কি পুরস্কার পেলেন?
গোলাম মুস্তফা: পুরস্কার ছোটখাটো মাঝারি অনেকগুলো পেয়েছি। উল্লেযোগ্য হচ্ছে ওয়ান ওয়ার্ল্ড ফর অল এই নামে ইউনেস্কোর আয়োজনে টার্কিতে একটা ইন্টারন্যাশনাল এক্সিবিশন হয়। ওয়ান ওয়ার্ল্ড ফর অল মিন করছে যে আমাদের একটাই পৃথিবী, এঁকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। যেভাবে জনবসতি বেড়ে যাচ্ছে, এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নিয়ন্ত্রণের ওপরেই ছবিটা পাঠিয়েছিলাম। ওই ছবিটা দ্বিতীয় পুরস্কার পায়।
আমার আরেকটা ছবি আছে। ছবিটা আমার কাছে এখন নাই। বিপিএস থেকে আমরা তখন প্রায়ই ছবি তুলতে সাভারে যেতাম। নদীর পারে একটা পুরোনো বটগাছ আছে। বটগাছের নিচে একজন সাধু থাকতেন। একদিন ছবি তুলতে তুলতে সাধুর কাছে গিয়ে পৌঁছলাম। আমরা পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনিদাঁড়িয়ে গেলেন। মাথায় আট দশটা বিশাল জটা। আর পেছনে বটগাছ। বটগাছের যে ঝুরি নেমে এসেছে, ওই ঝুরির সাথে তাঁর জটার সামঞ্জস্য আছে। আমি ১২০ ক্যামেরায় ঝটপাট ৩-৪টা ছবি তুলে ফেললাম। ওই যে বললাম প্রাইজ পেলাম পাকিস্তানে, ওই ছবিটা।
সাহাদাত পারভেজ : আপনার ফটোগ্রাফি সম্পর্কে বলেন।
গোলাম মুস্তফা : আমি ফটোগ্রাফিকে স্ট্রেট দুইভাগে ভাগ করি। কোনো কোনো জায়গায় তুমি আমার সঙ্গে একমতও হবা হয়ত। আমরা ফটোগ্রাফি বলতে যা বুঝি মানুষের ছবি, শিশুদের ছবি, পাখির ছবি, জীবজন্তুর ছবি, ল্যান্ডস্কেপ, সুন্দর জায়গা, পিকনিকের ছবি, বিয়ের ছবি, মিটিংয়ের ছবি… এতদিন যা করে এসেছি।

সাহাদাত পারভেজ : আপনি কি পিক্টোরিয়াল ছবির কথা বলছেন?
গোলাম মুস্তফা : না, এগুলো পিক্টোরিয়াল নয়। এগুলো হচ্ছে সুন্দর ছবি। এ কাজই করেছি। কিন্তু আরেকটা ভাগ হচ্ছে প্রেস ছবি। ওই মন্ত্রী সাহেব বক্তৃতা দিচ্ছেন, হ্যান্ডশেক করছেন, গিফট দিচ্ছেন এগুলি।
সাহাদাত পারভেজ : ঘটনার ছবি।
গোলাম মুস্তফা: হ্যাঁ, ঘটনার ছবি। এই কাজ আমি করিনি। তবে বিয়ের ছবি তুলেছি। বিয়ের ছবি তুলেছি পয়সার জন্য। আমি যখন কলেজে পড়ি, তখন সবাই আমাকে দিয়ে ছবি তোলা তো। আমার ক্যামেরা আছে তা অনেকে জানত। আমাকে বলত, ‘ভাই আসো, আমার ছোট বোনের বিয়ে, বড় ভাইয়ের বিয়ে; ছবি তুলে দিও।’
আমিও বলতাম,‘ঠিক আছে দেব।’
আমি চিন্তা করতাম যে, ফিল্ম ওদের, রিক্সাভাড়াও ওদের। মাঝখানে ওদের পয়সা দিয়ে আমার ট্রেনিং হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে এক প্লেট ভালো বিরিয়ানিও খেতে পারছি।
কাজেই এতদিন যে ছবি তুলছি এখন এইসব ছবি থেকে দূরে সরে এসেছি। এখন ছবি তুলতে শুরু করলাম লোককে বিশেষ ভাবনায় ভাবিত করার জন্য। শুরু করতে গিয়ে একটু সফলতাও আসল। এই সফলতার ধারায় আমার প্রথম কাজটা হচ্ছে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ছবি। তার বহু ছবি তুলেছি। তোমরাও তুলেছ। আমি জাতীয় স্মৃতিসৌধের ছবি দেখলাম আমার এক বন্ধুর তোলা, খুব সুন্দর পানি ছলকাচ্ছে। কিন্তু আমি যতবারই দেখি প্রতিবারই কেন যেন মনে হয় অন্য জিনিস দেখছি। এই যে পানি উঠছে আর নামছে, এরা কী যেন বলতে চায়। মুভমেন্টের ভেতরে না, যখন স্টিল হয়ে যায় তখন। এই বলতে চাওয়ার কারণটা ধরে আমি কয়েকবার গেলাম। রং টাইমে গেছি। হলো না ছবি। খোঁজখবর নিলাম কবে লোকজন থাকবে না। জানলাম যে, ১৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী যাবেন সম্মান জানাতে। এরর দুই দিন আগে থেকে প্রিপারেশন হবে। আমি যোগাযোগ করলাম জায়গা মত। ১৪ ও ১৫ ক্লিনিং ডে। আমি ওই দিনটা বেছে নিলাম। অনুমতি নিয়ে, ক্যামেরা, লেন্স নিয়ে গেলাম।
এ গল্পটা শুনতে ভালো লাগবে। গিয়ে দেখি একদম খালি। আর ৫০-৬০ জন মহিলা বড় বড় শলার ঝাড়ু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর আগে ফায়ার ব্রিগেড এসে পানি দিয়ে গেল। আমি সামনে গিয়ে জায়গা মত বসলাম। একদম তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার মধ্যে ছবি তুলতে হবে। তখন সূর্যটা স্মৃতিসৌধের পেছন দিকে থাকবে। এরমাঝে ঝাড়– দেয়া শুরু হয়ে গেছে। আমি ভাবলাম এরা সরে যাক, এরপর ছবি তুলবো। কিন্তু ওই মহিলারা বলছেন, ‘স্যার সরেন সরেন, আমরা ঝাড়– দিতে ওখানে যাব। আপনার গায়ে পানি পড়বে।’
আমি বললাম, ‘গায়ে পড়ুক সমস্যা নেই। লেন্সে না পড়লেই হলো।’
হাত দিয়ে লেন্স ঢেকে রেখেছি যাতে পানির ছিটা না পড়ে। গায়ে পেছনে কিন্তু ঝাড়ুর পানি পড়ে যাচ্ছে। ওরা শেষ করে চলে গেল। তখন বিকেল পৌনে চারটা কী চারটা। ছবি তোলা শুরু করলাম। সূর্যটা ঠিক জায়গা মত এসেছে। একটা মাত্র ছবির জন্য আমি তুলেছিলাম ১২৮টা ছবি। পানি উঠছে আর একেক মুহূর্তে একেক শেপ ধারণ করছে।
হাত দিয়ে লেন্স ঢেকে রেখেছি যাতে পানির ছিটা না পড়ে। গায়ে পেছনে কিন্তু ঝাড়ুর পানি পড়ে যাচ্ছে। ওরা শেষ করে চলে গেল। তখন বিকেল পৌনে চারটা কী চারটা। ছবি তোলা শুরু করলাম। সূর্যটা ঠিক জায়গা মত এসেছে। একটা মাত্র ছবির জন্য আমি তুলেছিলাম ১২৮টা ছবি। পানি উঠছে আর একেক মুহূর্তে একেক শেপ ধারণ করছে। একবার যে পর্যন্ত উঠছে, পরের বার হয়তো আরেকটু নিচু পর্যন্ত উঠছে, এরপরের বার হয়তো প্রথমবারের চেয়েও উঁচুতে উঠছে। কোনটা যে আল্টিমেট ছবি তা তো আমি জানি না। তারপর বলি আমি…।
সাহাদাত পারভেজ : আপনি বলছিলেন, এতদিন যে কাজ করেছেন এগুলো কিছু হয় নাই, এখন কাজটা করতে হবে ডক্যুমন্টারির ওপর।
গোলাম মুস্তফা : ও হ্যাঁ, সে কথাটা শেষ করি। আমার মনে হয় অনুপ্রাণিত করার জন্যে যদি ছবি তুলি এবং সে ছবি যদি সত্যি সত্যি সমাজের কাজে দেয়, তাহলে সেই ছবির কাজ করি না কেন? আমি ছবি তোলা শুরু করলাম, শিল্পকলা পদক পাওয়ার পরে। তার পরপরই সাভার স্মৃতিসৌধের ছবিটা তুললাম। ওই ছবিটার একটা বড় কপি বহু জায়গায় আছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, কেবিনেট সেক্রেটারি, অফিসার্স ক্লাব, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক প্রতিষ্ঠান কিনেছে ছবিটি। একবার যে বুঝে যায় সে কিন্তু অবাক হয়ে যায়। অনেকে প্রশ্ন করেন, এ জিনিসটা কিভাবে ভাবলেন আপনি? এগুলো হচ্ছে (ছবিটা দেখিয়ে) সেইসব আত্মা, যেসব মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছেন, তাঁদের আত্মা আজকে ফিরে এসেছে দেখার জন্যে।
সাহাদাত পারভেজ : আপনি কি কখনো ডক্যুমেন্টারি ফটোগ্রাফি করেছেন?
গোলাম মুস্তফা :আমি মাঝখানে কয়েক বছর ছবি তুলিনি। একটা কথা মাঝখানে বলা দরকার। সেদিন শেষ করতে পারিনি। এক সময় ফিল করলাম যে, এতোদিন যা তুলেছি সব ফালতু, বেকার ছবি। একসময় দেখি যে ছবি তিন ভাগে বিভক্ত। একটা হচ্ছে, সুন্দর ছবি। নদী দিয়ে পালতোলা নৌকা যাচ্ছে, যদি অস্তগামী সূর্য থাকে তাহলে আরও ভালো। অথবা ফুলের ছবি, চেহারার ছবি, শিশুর ছবি, মডেলের ছবি। এই ছবিগুলো কোন সময় অর্থ দেয়, কোন সময় দেয়ও না।
ছেলেমেয়েরা ফটোগ্রাফি শিখে কি ছবি তোলে? যা চোখে ভাল লাগে তাই তোলে। সেই ভালো লাগাটা শিশুরও হতে পারে, কিশোরেরও হতে পারে আবার বড় কারোও হতে পারে। আমি জীবনে অনেক মডেলের ছবি তুলেছি। আমার যেহেতু জার্মানিতে মডেলের ছবি তোলার ট্রেনিং ছিল, ওটা বেশ কাজে লাগিয়েছি। আর ল্যান্ডস্কেপ তুলেছি। সেই ল্যান্ডস্কেপগুলো বছরের পর বছর বিভিন্ন ক্যালেন্ডারের জন্য বিক্রি হয়েছে। খালি সুন্দর ছবি তুললেই হবে না।টাকা-পয়সাও তো লাগবে। তাই ফটোগ্রাফির প্র্যাক্টিসচালিয়ে রাখার জন্য টাকা দরকার। এখন না হয় ফিল্ম কিনতে হয় না। এখন একটা ক্যামেরা আর একটা কার্ড থাকলেই অসংখ্য ছবি তোলা যায়। একসময় তা ছিল না।
এখন কথা হচ্ছে, আমরা ছবি তুলি সুন্দর ছবি। এরপরের ছবি হচ্ছে কাজের ছবি। যা আগেও বলেছি হয়তো। মিটিংয়ের ছবি, মন্ত্রীদের ছবি, সংবাদের ছবি, খেলার ছবি।একেবারে পেশাজীবীদের কাজের ছবি ওগুলো। তৃতীয় ধারার ছবি হলো ডক্যুমন্টারি ফটোগ্রাফি, যেটা গত দশ কি বিশ বছর ধরে চালু হয়েছে। ডক্যুমেন্টরি ফটোগ্রাফি বিষয়ে আমি জানতাম না।
ইদানিং এইসব পদক পাওয়ার পরে ভাবলাম যে সারাজীবন তো এইসব কাজ অনেক করলাম। ছবিগুলো আমাকে যস খ্যাতি সবই দিয়েছে। পকেটে টাকা পয়সা এসেছে। এই। কিন্তু এই ছবি তুলে আমি দেশের জন্য কী করলাম? ছবি যে এন্টারটেইন করা ছাড়াও আরেকটা বড় কাজ করতে পারে, আমরা ওই জায়গায় যাইনি। পরে একসময় বুঝলাম যে, আলোকচিত্র কিন্তু অনেক বড় একটা শক্তি। একটা কথা বলা হয়, ‘পাওয়ার অব ইমেজ।’ আলোকচিত্রের যে একটা শক্তি আছে, সেই শক্তিটা ব্যবহার করিনি। যে কাজটা অনেক বক্তৃতা দিয়ে, লিখে, ওয়ার্কশপ করে তোমাকে পারব না, সেই কাজটা আলোকচিত্র পারে।
একটা উদাহরণ দিলে পরিস্কার হবে। ইদানিংকার উদাহরণ। রোহিঙ্গা সমস্যা। রোহিঙ্গা সমস্যা যখন শুরু হল, ঝট করে কেন পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেল? কী করে পৃথিবীর লোকজন এখানে আসল, অ্যাটেনশন গ্রো করল? দুনিয়ার সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার, এক্টিভিস্টরা কেন আসল? কারণ হচ্ছে একটাই ফটোগ্রাফি।
সাহাদাত পারভেজ : পৃথিবী তো এখন ভিজ্যুয়াল হয়ে গেছে।
গোলাম মুস্তফা : হ্যাঁ, ভিজ্যুয়াল হয়ে গেছে। আজকে রোহিঙ্গারা আসার পরপরই প্রেসের লোকজন, কিছু ইন্ডিভিজুয়াল লোকজন কক্সবাজারে গিয়ে এমন কিছু ছবি তুলে নিয়ে এসেছে যা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে গেছে। ওটা ছবি এঁকে করলে হতো না। কারণ ছবি আঁকায় সেই বিশ্বাসটুকু আসত না। এঁকে তো অনেক কিছু করে ফেলতে পারি, অনেক কিছু বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু ফটোগ্রাফি নেভার লাইজ। রোহিঙ্গাদের ছবি শিল্পীরা আঁকলে মানুষ বিশ্বাস করতো না। বলত বানানো ছবি, বানানো অত্যাচার। আই অ্যাম স্যরি দ্যাট আই সে দ্যাট। ক্যামেরা চোখের সামনে যা ঘটছে সেটাকেই রেকর্ড করে। এই যে ‘পাওয়ার অব ইমেজ’ লোকে এখন এই সত্যটা বুঝতে পারছে।
সাহাদাত পারভেজ : তো যেই কথা বলছিলেন, ডক্যুমেন্টারি ছবি। পরে কি তুললেন আপনি?
গোলাম মুস্তফা : ডক্যুমেন্টারি ঠিক না। আমি যেটা করেছি সেটা হলো, মানুষের বিবেক জাগানোর ছবি। মানুষের বোধোদয়ের ছবি। আমি একটা উদাহরণ দিয়ে বলি। মৎস ভবনের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখি রাস্তার মাঝখানে আইল্যান্ডের মধ্যে একটা সুন্দর বোগেনভিলিয়া গাছ। গাছটায় ফুল ফুটে আছে। আর চারদিকে কেচোরমেচোর করে বাস যাচ্ছে, চেঁটামেচি হচ্ছে। আমি রিকশা থেকে নামলাম। এরমধ্যে এতো সুন্দর বোগেনভিলিয়া ঠিক মানাচ্ছে না। এটা হয় বাগানে থাকবে অথবা কোনো বড়লোকের বাড়ির গেটে। তা না হয়ে এমন জায়গায় আছে যে, এখানে থাকার কোনো মানেই হয় না। তখন এক কবি বন্ধুর কবিতার শিরোনাম মনে পড়ল। শিরোনামটা ছিল অসহায় বসন্ত। আমি ভাবলাম, এইতো সেই অসহায় বসন্তের ছবিটা। এই বোগেনভিলিয়া অসহায়, বসন্তকালেই ফুটেছে। কিন্তু গাছটা যে জায়গাটায় আছে, সেখানে তার কোনো মূল্য-মর্যাদা হচ্ছে না। ছবিটা তুলে আমি শিরোনাম দিলাম অসহায় বসন্ত।
সাহাদাত পারভেজ : আপনার কি কোনো একক বা যৌথ ফটোগ্রাফি প্রদর্শনী হয়েছে?
গোলাম মুস্তফা: দু’বার হয়েছে। বছর তিনেক আগে একদল পেইন্টার একটা স্পন্সরড প্রোগ্রামে বরিশাল গিয়েছিল। বারোজন পেইন্টার, আমি একমাত্র ফটোগ্রাফার। আমি যেখানে পড়াতাম, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে যিনি পেইন্টিং পড়াতেন তিনি বললেন, ‘মুস্তফা ভাই, আমরা একদল পেইন্টার যাচ্ছি, আপনিও তো ফটোগ্রাফার; আপনি কি যাবেন এজ মাই গেস্ট?
আমি বললাম, ‘আমার কোনো অসুবিধা নেই। আপনারা আপনাদের মতো পেইন্টিং করলেন, আমি আমার মতো ছবি তুলব। তো বরিশাল গেলাম। ঠিক বরিশাল নয়, বরিশালের আগে। তিনদিন ছিলাম। চমৎকার আতিথেয়তা। তাঁরা তিনদিন ধরে ছবি আঁকলেন। আমি আমার মতো ছবি তুললাম। তারপর সেই ছবিগুলো দিয়ে শিল্পকলাতে এক্সিবিশন হলো। এক্সিবিশনে প্রথমে আমার ছবি তাঁরা নেবে না, কারণ ওটা পেইন্টারদের এক্সিবিশন। তারমধ্যে ফটোগ্রাফি ঢুকে গেলে তাঁদের আবার একটু মানে লাগবে।
এখানেও দেখলাম ‘ডিসপেয়ারিটি’। পেইন্টিং থাকবে কিন্তু ফটোগ্রাফি থাকবে না। আমি বললাম যে, কেন থাকবে না। তাহলে আমাকে নিয়ে গেলেন কেন? আমি তো আপনাদের সঙ্গে ঘোরাফেরা, খাওয়াদাওয়া, ওঠাবসা সব একসঙ্গে করেছি।
শেষ পর্যন্ত আমার ছবি থাকল। ওটা হচ্ছে আমার একটা সফল এক্সিবিশন। কারণ একই হলের মধ্যে বারোজন পেইন্টারের ছবি এবং একজন ফটোগ্রাফারের ছবি। আমি দেখলাম যে ভিড় কিন্তু আমার স্টলে বেশি। কারণ পেইন্টিং মোটামুটি সবগুলোর চেহারা একই রকম, কারণ একই লোকেশন। এরমধ্যে আমার ছবিগুলো অন্য ধরণের ছবি।
সাহাদাত পারভেজ : এটা তো মূলত একটা গ্রুপ এক্সিবিশন। আপনার কোনো একক প্রদর্শনী হয়েছে কখনো?
গোলাম মুস্তফা : একক প্রদর্শনী হয়েছে বিপিএসে। আমি একবার চায়নায় গিয়েছিলাম। ফিয়াপ নামে একটা সংগঠন আছে, ফটোগ্রাফারদের সংগঠন। ফিয়াপের চব্বিশতম অধিবেশনে আমি গিয়েছিলাম। বিপিএসকে রিপ্রেজেন্ট করলাম। ওখানে সাতদিন ছিলাম। ওই শহরে ছবি তুলেছিলাম। ফিরে আসার পরে ওই ছবি দিয়ে এক্সিবিশন করেছিলাম। সলো এক্সিবিশন বিপিএসেই করা হয়েছে।
সাহাদাত পারভেজ : এরপর আর এক্সিবিশন করেননি?
গোলাম মুস্তফা : না। এরপর গ্রুপ এক্সিবিশন করেছি অনেকগুলো। যেমন শেরাটনে, সোনারগাঁয়ে, বিপিএসে, বিভিন্ন জায়গায় হয়েছে। এরপর জার্মানিতে হয়েছে, ইন্ডিয়াতে হয়েছে, পাকিস্তানে হয়েছে।
সুশান্ত পালের ধারণ করা ভিডিওচিত্র থেকে অনুলিখন করেছেন জাহরা জাহান পার্লিয়া
আগামীকাল পড়ুন ৭ম পর্ব
আরও পড়ুন :
ক্যামেরার কারণে আমার কাজের মান ভালো হয়ে গেল : গোলাম মুস্তফা, পর্ব-১
কলেজের ম্যাগাজিনের কাভারে ছবি ছাপানো হওয়ার গর্বে আমার তো ঘুম নাই : গোলাম মুস্তফা, পর্ব-২
’ ৭১-এর টেলিভিশনের চাকরি ফেলে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, বৃদ্ধ বাবা মাকে টর্চার করবে ভেবে কোথাও যাইনি : গোলাম মুস্তফা, পর্ব-৩
১০ জানুয়ারির ঘটনাটা বলতে গেলে কেন জানি আবেগী হয়ে যাই : গোলাম মুস্তফা, পর্ব-৪
চারুকলায় ক্যামেরা, এনলার্জার কেনা হলো কিন্তু ফটোগ্রাফি বিভাগটা আর খোলা হলো না : গোলাম মুস্তফা, পর্ব-৫
4 thoughts on “ফটোগ্রাফি নেভার লাইজ : গোলাম মুস্তফা, পর্ব : ৬”