কলেজের ম্যাগাজিনের কাভারে ছবি ছাপানো হওয়ার গর্বে আমার তো ঘুম নাই : গোলাম মুস্তফা, পর্ব-২


সাহাদাত পারভেজ : আপনি তো ক্যামেরা পেলেন, ছবি তোলা শুরু করলেন। কিন্তু তখন তো সাদাকালো ফিল্মের যুগ। ফিল্ম ডেভেলমেন্ট, প্রসেস, প্রিন্টিং এগুলো কোথায় শিখলেন?
গোলাম মুস্তফা : তাহলে একটু পেছনে যেতে হয়। বেশ পেছনে যেতে হয়। আমি যখন স্কুলে পড়ি নারায়ণগঞ্জে তখনই মুস্তফা মনোয়ারের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। নারায়ণগঞ্জে উনার এক বোন থাকতো। উত্তর চাষাঢ়ায় থাকতেন হাসনা আপা আর লুৎফর দুলাভাই। উনি তাঁর বড় বোনের বাসায় থেকে লেখাপড়া করতেন। আমরা থাকতাম মধ্য চাষাঢ়ায়। উনি বোধহয় ক্লাস টেনে, আমি ফাইভে। উনি এমন একজন লোক যিনি একাধারে গান গাইতেন, ছবি তুলতেন, ছবি আঁকতেন। একসঙ্গে তিনটা কাজ উনি করতেন। উনার একটা ক্যামেরা ছিল। সম্ভবত তাঁর দুলাভাইয়ের ক্যামেরা ছিল ওটা। উনার সবকিছুই ছিল। কিন্তু ডার্করুম বানানোর কোনো জায়গা ছিল না।
আমার এক মামা ছিলেন, ইসলাম মামা; মুস্তফা মনোয়ার ছিলেন ইসলাম মামার বন্ধু। তিনি ইসলাম মামাকে বলছিলেন, ‘তুমি আমাকে একটা রুম ঠিক করে দাও; আমি একটা ডার্করুম বানাবো ছবি প্রসেস করার জন্য।’
মামা তখন আমাকে বললেন, ‘তুমি আমার এই বন্ধুর সাথে রুম শেয়ার করো। দেখো, ও কি কি করে!’
আমি তখন মুস্তফা মনোয়ারের নামও জানি না। উনি একদিন হাড়ি পাতিল আর কী সব নিয়ে আসলেন। একটা ডেভেলপার, একটা পানির বোতল আর একটা ফিক্সার নিয়ে আসলেন। তারপর কাঠ দিয়ে একটা এনলার্জার তৈরি করলেন। একটা লেন্স আছে…।
আমি কিন্তু আবার উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছি। ওই সময়ে চলে যাচ্ছি। আমার এমন হয়। ইদানিং বেশি হচ্ছে। ওই মুহূর্তে আমি ক্লাস ফাইভের বয়সে চলে যাচ্ছি।
সাহাদাত পারভেজ : স্মৃতিকাতর হয়ে যাচ্ছেন?
গোলাম মুস্তফা : স্মৃতিকাতর হয়ে যাচ্ছি। আর ওই বোধে চলে যাচ্ছি।
সাহাদাত পারভেজ :খুব স্বাভাবিক এটা।
গোলাম মুস্তফা : আমার কাছে মনে হয় না এটা স্বাভাবিক। এই বয়সে এখানে বসে চট করে ওই সময়ে চলে যাওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার না। যাই হোক, আমি কথাটা শেষ করি। আমার কিন্তু মেমোরি ভালো না। তো উনি বললেন, আমি তোমার ঘরের মধ্যে প্রিন্ট করবো। উনি এনলার্জারে নেগেটিভটা রাখলেন। নিচে ট্রের মধ্যে একটা ছবি দেখলাম। ছবিটার রঙ উল্টাপাল্টা। সাদাটা কালো, কালোটা সাদা। তারপরেওটা অফ করে একটা সাদা কাগজ ওর নিচে দিলেন। দিয়ে আবার লাল ফিল্টার দিয়ে দেখলেন। ওর মধ্যে একটা লাল ছবি। এরপর লালটা সরিয়ে নিলেন। সরিয়ে দিয়ে উনি অন করলেন। এবার লাল নাই। সাদাকালো। উনি গুনলেন ১,২,৩,৪,৫,৬। ৬ হলে অফ করে দিলেন। তারপর ওটাকে একটা থালার মধ্যে রাখলেন। থালার মধ্যে পানি। কিন্তু ওটা যে কেমিক্যাল তা আমিজানতাম না। জীবনে প্রথম দেখলাম, অদৃশ্য থেকে হালকা ছায়ার মত একটা ছবি ভেসে উঠছে কেমিক্যালের নিচ থেকে। একটা সাদা কাগজের উপর একটা গায়েবি ছবি যেন ভেসে উঠলো। ছবিটা কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করলেন। এরপর ওটাকে নিয়ে দ্বিতীয় একটা জায়গায় দিল। দেখলাম ওটাও পানি। এরপর তৃতীয় একটা জায়গায় দিল। থালা বাটি কিন্তু সব। তৃতীয় জায়গাটায় দেওয়ার কিছুক্ষণ পর বাতি জ্বালালেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম যে কী একটা সুন্দর ছবি! ওই কাগজটাই কিন্তু, একটা সাদা কাগজ। ওটাই ছবি হয়ে গেল।
সাহাদাত পারভেজ : ছবিটা কী ছিল?
গোলাম মুস্তফা : একটা নদীর দৃশ্য ছিল। ওনার তোলা। তো আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই ম্যাজিক কি করে হলো? সাদা কাগজের মধ্যে ছবিটা কেমন করে আসলো? তিনি আমাকে বললেন যে, ছবিটা আগে ফিক্স হোক। তখন তো ফিক্সের মানে জানতাম না। বললেন যে, ‘এটা কোথাও ঝুলিয়ে দিয়ে আসো। এখন লাইট লাগলে কোন অসুবিধা নেই।’
ঝুলিয়ে দিয়ে আবার ডার্করুমে ফিরে আসলাম। কিন্তু আমার মন কিন্তু পড়ে আছে ছবিটার দিকে। যদি কেউ নিয়ে যায়। আধাঘন্টা পরে আমাকে বললেন, ‘ওটা নিয়ে আসো।’ ড্রাই হয়ে গেছে। আমি অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম ছবিটার দিকে। বললেন যে, ‘ছবিটা কয়েক দিন আগে তুলেছি। আজ প্রিন্ট করলাম। তারপর তিনি আমাকে বললেন, ‘দাঁড়াও তোমার একটা ছবি তুলি।’ ডার্করুমে ঢুকে আবার এক্সপোজার দিলেন। ৬,৭ বা ৮ এ দিলেন। দেখলাম যে আমার চেহারা আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আমি অপলক তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর ওটাকে পানিতে ধুয়ে ফিক্স করলেন। ফিক্স করার পরে আমি বললাম, এই ছবিটা আমাকে দেবেন না? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ দেবো। তোমার জন্যই তো প্রিন্ট করলাম।’
সাহাদাত পারভেজ : আছে ওই ছবিটা?
গোলাম মুস্তফা : ছবিটা নাই। হারিয়ে গেছে। এই শহরে এতোবার বাড়ি বদলেছি! থাকে বলো? অনেক কিছুই চলে গেছে। মাঝখান দিয়ে একটা জিনিস আমি বহন করেছি সারা জীবন। আমার কলকাতার স্কুল, আমি যেই স্কুলে পড়তাম; ওই ব্রিটিশ আমলে।
সাহাদাত পারভেজ : কলকাতার স্কুল?
গোলাম মুস্তফা : হ্যাঁ, কলকাতার স্কুল। আমার জন্ম তো কলকাতায়। ও এটা বলা হয়নি। প্রাইমারি স্কুল কলকাতায়। প্রাইমারি দুইটা স্কুলে। হাইস্কুল নারায়ণগঞ্জে। কলেজ জগন্নাথ কলেজ। তারপরে ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এই হচ্ছে ধারাবাহিকতা। কলকাতার স্কুলের কথা কেন বললাম? স্কুলটার একটা জিনিস আছে, হারায়নি; একটা হকিস্টিক। কলকাতার স্কুলে হকি খেলতাম। এটুক বাচ্চা। ক্লাস থ্রি, ফোরের বাচ্চা। একবার অ্যানুয়াল স্পোর্টস ছিল। স্পোর্টসে একটা আইটেম ছিল যে সবার জুতোগুলোকে একসাথে মিশিয়ে দেয়া হবে। আমরা এখান থেকে যাবো। যার যার জুতো বের করে জুতো-মোজা পরে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো। এই যে হচ্ছে দৌড়। বেল বাজলে দৌড়ে যাবো। প্রায় ১০০ মিটার। ওই দৌড়ে আমি ফার্স্ট হয়েছিলাম। প্রাইজ হচ্ছে একটা হকিস্টিক। ওই হকিস্টিকটা আমার সঙ্গে সঙ্গে সবসময় আছে। তারপরে নারায়ণগঞ্জে আসলাম, চট্টগ্রাম গেলাম, ঢাকায় আসলাম, কতবার বাড়ি বদলালাম। ওটা কিন্তু আমার সঙ্গে আছে।আমার বাবা-মা’র ছবির পাশেই রাখা আছে ওটা।
সাহাদাত পারভেজ : কলেজে পড়ার সময়ই বাবার কাছ থেকে ক্যামেরা পেলেন।
আমি যখন কলেজে পড়ি তখন আমার একটা ছোট ক্যামেরাটা ছিল। আগফার ক্যামেরা। জগন্নাথ কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিনে ছাপার জন্য একটা ছবি দরকার। তখন প্রিন্সিপ্যাল যিনি ছিলেন রেবতী মোহন চক্রবর্তী। অসাধারণ পন্ডিত লোক। দেখতেও চমৎকার। প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে বললেন যে, তুমি তো ছবি তোলো। একটা কাজ করো, আমাদের বার্ষিক যে ম্যাগাজিনটা হবে তুমি এটার জন্য কলেজ ভবনের একটা ছবি তুলে দাও। ছবি যদি ভালো হয় তাহলে সে ছবি আমি কভারে ছাপবো। তোমাকে একটা অর্থমূল্যও দেওয়া হবে। শুনে আমি উত্তেজিত হয়ে গেলাম।
একটা ছবির জন্য আমি দুই রোল ছবি তুলে ফেললাম। একটা রোলে বারোটা ছবি হয়। ছবি তুলে নেগেটিভ দেখে ভালো লাগলো না। পরদিন আবার তুললাম। ছবি প্রিন্ট করে স্যারকে দিলাম। স্যার বললেন, ‘দারুণ ছবি হয়েছে তো! এটা আমরা ছাপবো।’
আমি বললাম, ‘ছাপবেন!’
স্যার আমাকে বিশ টাকা দিলেন।ফিল্মের দাম ছিল বোধ হয় একটাকা বারো আনা বা দুটাকা। আর ডেভেলপ করতে লেগেছে চার আনা। কোয়ার্টার সাইজ একটা ছবি প্রিন্ট করতে একটাকাও পুরো লাগে নাই।
কলেজের ম্যাগাজিনের কাভারে ছবি ছাপানো হলো। গর্বে আমার তো ঘুম নাই। বাসায় এসে মাকে দেখাই, বাবাকে, দেখাই, ভাইবোনদের দেখাই। কলেজ বিল্ডিংয়ের তখন যে সৌন্দর্য ছিল এখন সেই সৌন্দর্য নাই। এখন পরিবর্তন হয়ে গেছে, কী সব লাগিয়ে টাগিয়ে দিয়েছে। তো যাই হোক, ওই প্রথম ম্যাগাজিনে ছবি ছাপা হলো। এতে উৎসাহ আরো বেড়ে গেল। আমি পার্কে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলি। যে ছবি দিয়ে পরে আমি ইস্ট পাকিস্তান ফটোগ্রাফি কনটেস্টে থার্ড প্রাইজ পেয়েছিলাম। ওই থার্ড প্রাইজটা হচ্ছে প্রথম অফিসিয়ালি ভালো প্রাইজ। তারপরের বছর পেলাম অল পাকিস্তানে সেকেন্ড প্রাইজ।
সাহাদাত পারভেজ : প্রাইজগুলোর কি কোনো অর্থমূল্য ছিল?
গোলাম মুস্তফা : হ্যাঁ ছিল। থার্ড প্রাইজটা ছিল পাঁচশত টাকা। আর সেকেন্ড প্রাইজটা হলো এক হাজার টাকা। টাকাটা বড় কথা না। আমাকে সাত দিনের জন্য নিয়ে যাওয়া হলো করাচিতে। আমি তো ঢাকার ছেলে। প্লেনের টিকেট দেওয়া হলো। সাথে হোটেলে থাকা-খাওয়া। ওই প্রাইজ গিভিং সিরিমনিটা হলো করাচিতে। সেটা আরেকটা দুঃখের কাহিনী। সেটা একটু বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু লম্বা হয়ে যাবে। তাও বলে বলি?
সাহাদাত পারভেজ : বলেন, বলেন। লম্বা না হয় হলো।
গোলাম মুস্তফা : এখন মেমোরি ফ্রি আছে তো। এখন বললে পরে সঠিক সঠিক বলতে পারবো। পরে বললে উল্টোপাল্টা হয়ে যেতে পারে। টিকেট আসলো। গেলাম। করাচিতে এর আগে যাই নি কখনও। শুধু গল্প শুনেছি। খুব আধুনিক শহর আর বিরাট শহর। যাওয়ার পর হোটেলে উঠলাম। ‘আল ফারুক’ বোধ হয় হোটেলের নাম ছিল। অনুষ্ঠানে ফার্স্ট প্রাইজ এনাউন্স যখন করলো। আরে হাততালি, পুরা হল ফাটিয়ে দিয়েছে।
সেকেন্ড প্রাইজ গোলাম মুস্তফা ফ্রম ঢাকা। ৮-১০ জনের পুওর হাততালি। হলের একটা কোনা থেকে আসলো হাততালিটা। শোনা যায় কী যায় না। থার্ড প্রাইজ লাহোর। তখনো বেশ হাততালি। কেবল মাঝখানেই নাই। কমিশনারের হাত দিয়ে প্রাইজ দেওয়া হলো। যখন প্রাইজ বিতরণ শেষ হলো তখন কয়েকজন যুবক আমাকে ডাকলেন। চেহারা দেখে বুঝলাম বাঙালি, ঢাকার ছেলে। জানালেন, পাকিস্তান এয়ারফোর্সের প্রথম ট্রেনিংয়ের জন্য তাঁরা সিলেক্ট হয়েছেন। বললেন, আমরা তো হাততালি দিলাম, আর তো কেউ দিল না। কোথায় উঠেছেন আপনি ? বললাম, হোটেলে উঠেছি। এরা একযোগে বললেন, হোটেল টোটেল ছাড়েন, বাক্স প্যাটরা নিয়ে আমাদের সাথে আসেন। আমাকে তাঁরা তাঁদের এয়ারফোর্সের কোয়ার্টারে নিয়ে গেলেন।
পরদিন কমিশনার আমাদের বিজয়ী তিনজনকে তার বাসায় দাওয়াত করেছিল। আমি যাইনি। ভাবলাম, যারা আমাদের অবজ্ঞা করে তাদের বাসায় গিয়ে কোরমা পোলাও খাওয়ার দরকার নাই। করাচিতে কিছু দিন থাকলাম। খাওয়াদাওয়া, বেড়ানো সব হচ্ছে। আমি করাচিতে যাওয়ার পর প্রথম দেখলাম, কী বিরাট শহর,উঁচু উঁচু বিল্ডিং আর কী পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট! রিঘ রোড কী বিশাল লম্বা, প্রায় দশ মাইল স্ট্রেইট।
আমি ‘ডিস্প্যারিটি’ শব্দটি প্রায় পত্রিকায় পড়তাম, মানে জানতাম না। এয়ারফোর্সের ওই ছেলেগুলো আমাকে বলল যে, ‘দেখো, আমাদের পাটের টাকায় তারা মরুভূমির মধ্যে এই শহর তৈরি করেছে। তুমি কি জানো, পাকিস্তানের যা আয় তার বেশিরভাগ আসে বাংলাদেশ থেকে? সেই আয়ের ৮০% খরচ হয় এখানে, আর ২০% খরচ হয় বাংলাদেশে। তখন বুঝলাম এই তাহলে ডিস্প্যারিটি।করাচী শহরে এই প্রথম নিজের চোখে ডিস্প্যারিটি দেখলাম।
তারপরে শর্ট করে আসি আমি। ওই যে ঘোরাঘুরি করে প্রাইজটা নিয়ে ঢাকায় চলে আসলাম। ঢাকায় যখন আসলাম আমার বোন, আত্মীয়-স্বজন সবাই এয়ারপোর্টে গেছে। আমার এক মামা ছিলেন, মোসলেম মামা। মামা বললেন, ওই প্রাইজট্রাইজ পরে দেখবো। তার আগে তুমি করাচি কেমন দেখলে বলো?
বললাম, ঢাকার সঙ্গে নরসিংদীর যে পার্থক্য, করাচির সঙ্গে ঢাকার সেই পার্থক্য। আধুনিক শহর, উঁচু উঁচু বিল্ডিং, বিশাল সব রাস্তা। যা ঢাকায় চিন্তাই করা যায় না। ঢাকার নওয়াবপুর রোড তখন তৈরি হয়নি। যা হোক, এই বুঝলাম কাকে বলে ডিস্প্যারিটি। ছেলেগুলো যখন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল তখন থেকে তাদের প্রতি রাগ, ঘৃণা আর ক্ষোভ তৈরি হলো।
সাহাদাত পারভেজ : মনজুর আলম বেগের সাথে আপনার পরিচয় হল কিভাবে?
গোলাম মুস্তফা : সে আরেক দিন বলি? লম্বা কাহিনি হয়ে যাবে।
সাহাদাত পারভেজ : বলেন। আপনার অসুবিধা না থাকলে বলেন।
গোলাম মুস্তফা : তাহলে তোমাদের ভাগ ভাগ করে নিতে হবে। ওই যে ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম, বাসা তো বাংলাবাজারে। বাসা থেকে হেঁটে আসতাম সদরঘাটে। ওখান থেকে বাসে উঠতাম। বাসে করে একটানা। আমার ক্লাস হত কার্জন হলে। কার্জন হলের আগে হল প্রেসক্লাব, তারপর কার্জন হল। একদিন ক্লাস শেষে হেঁটে হেঁটে প্রেসক্লাবে আসলাম। এক কাপ চা খেলাম। কেউ আমাকে চেনে না। চেনার কথাও না। তবে ওই লাল ভাইকে, কালো ভাইকে, সালাম দিতাম। উনারা উত্তর দিলে খুব গদগদ হয়ে যেতাম।তখন একজনই শুধু আমাকে ভালোভাবে চিনতো। তিনি হলেন কামরুল হুদা, পিআইডির ফটোগ্রাফার।
আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঝগড়া দিয়ে। ইউনিভার্সিটিতে কনভোকেশন হচ্ছে। ৬১ তে বোধ হয়। তখন গভর্নর হচ্ছে গিয়ে আজম খান। সন তারিখ ভুল হয়ে যেতে পারে। স্টেজের ছবি তুলবো। হঠাৎ দেখি যে একজন তাঁর কনুই দিয়ে আমার ক্যামেরা ব্লক করে ছবি তুলছে। আমি সরিয়ে দেই, কিন্তু সে আবার ব্লক করে দেয়। খুব রাগ হলো আমার। আমি বললাম, আপনি আমার লেন্স ব্লক করছেন কেন? সে আমাকে বলল, ‘আমি আগে ছবি তুলে যাই, পরে আপনি ছবি তুলবেন।’
আমি বললাম, আপনি বাইরের লোক। আর আমি ইউনিভার্সিটির ছাত্র। আমার অধিকার এখানে আগে।’
কিন্তু সে আমাকে একটু হ্যালাফ্যালা করলো। স্টেজতা কিন্তু বেশ উঁচু। প্রায় পাঁচ ছয় ফুট উঁচু। ফ্রন্টভিউ পাওয়ার জন্য সে একেবারে কোনায় স্টেজের কাছে গিয়ে আমার ক্যামেরা ব্লক করে ছবি তুলছে। আমার বয়স কম। বুঝতে পারিনি। খালি কোমর দিয়ে একটু ধাক্কা মারলাম। সে ধাম করে একেবারে মাটিতে পড়ে গেল। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। বুঝতে পারল যে শারীরিক জোরে সে আমার সাথে পারবে না। পরে নিচে গিয়ে আমি স্যরি বললাম। টেনে তুললাম তাঁকে। ক্যামেরাটা গলায় ঝুলছে। বললেন, ‘যে ইটস ওকে। কিন্তু ধাক্কা তো মেরেছেন।’
বললাম, হ্যাঁ ধাক্কা আমি মেরেছি। কিন্তু এত জোরে যে পড়বেন তা বুঝতে পারি নাই। তারপর খাতির হয়ে গেল। প্রেসক্লাবে গেলে চা খাওয়াতো। বেশ খাতর করতেন।
ওই কনভোকেশনে প্রথম পোর্ট্রেট তুললাম ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর। কনভোকেশনে উনি এসছেন। ফুল নিয়ে সবাই পাগল। আমি তো ইউনিভার্সিটির ছাত্র। বেশ লম্বা চওড়া। প্রায় ছয় ফুট। লম্বা হওয়ার একটা সুবিধা আছে। আমাকে সামনে যেতে হচ্ছে না। দূর থেকেই তুলতে পারছি। একজন বলেছিল যে, ছবি তোলার জন্য লম্বা হওয়াটা অ্যাডভান্টেজ। কিন্তু এই লম্বা হওয়াটা একসময় তোমার জন্য অসুবিধার কারণ হতে পারে। যেটা আমি এখন ফিল করছি। এখন আমার অসুস্থতা যেটুকু আছে কিংবা আমার বডি যে ইমব্যালেন্স হয় হাঁটতে গিয়ে, এই লম্বার জন্য কিন্তু এটা বেশি হচ্ছে। হাঁটাচলার জন্য এতো হাইট দরকার নাই। হাঁটাচলার জন্য হাইট যদি লাগে, তার জন্য শক্তিও লাগে। সেই শক্তি তো এখন নাই। কাজেই একটু জোরে হাঁটলেই হ্যালাদুলা শুরু হয়ে যায়।
সাহাদাত পারভেজ : আপনি মাঝেমাঝে প্রেসক্লাবে যেতেন। ফটোসাংবাদিকদের সালাম দিতেন। কিন্তু মনজুর আলম বেগ স্যারের সাথে কিভাবে পরিচয় হলো?
গোলাম মুস্তফা : ও হ্যাঁ, ফিরে আসি আবার। আমি হেঁটে হেঁটে আসলাম প্রেসক্লাবে। চা টা খেয়ে রাস্তা ক্রস করে ওদিকে গেলাম। ওদিকে গেলাম কেন? বাস ধরবো বলে। বাস ধরার জন্য ওদিক যেতে হবে। ওখানে দেখি কী একটা স্টুডিও দেখা যাচ্ছে। রক্সি স্টুডিও। স্টুডিওতেকয়েকটা ছবি টাঙারো। বেশ বড় বড় ছবি। ছবি দেখে আমি ভেতরের দিকে গেলাম। স্টুডিওতে ঢুকলাম। দেখলাম কালো, পাতলা মতন একজন লোক। একটু দাড়ি আছে। খুবই ইন্টারেস্টিং একটা চেহারা। উনি কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ঘন ঘন সিগারেট খাচ্ছেন। তার কাছে গিয়ে বললাম, আমার কিছু নেগেটিভ আছে, প্রিন্ট করতে চাই। এখানে কি প্রিন্ট হয়? উনি বললেন, হ্যাঁ হয়। আমি বললাম, আপনি করে দেবেন?
উনি নেগেটিভগুলো দেখে বললেন ‘একটু ওভার আছে। আচ্ছা আমি ম্যানেজ করে নেব। পেপার দিয়ে ম্যানেজ করে নেবো।’ উনি প্রিন্টের দায়িত্ব নিলেন। অন্য কেউ হলে হয়তো বলতো এগুলা হবে না। আমি পরদিনই আবার গেলাম। একঘন্টা আগে গিয়েছি। বাইরে হাঁটাহাঁটি করছি। আমি টাইমের আগেই চলে গেছি। ঠিক টাইম হওয়া মাত্রই আমি স্টুডিওতে ঢুকলাম। আমাকে দেখেই বললেন, ‘আপনার ছবিগুলো প্রিন্ট করেছি। তবে আরেকটা দিন থাক। আমি সঠিক পেপারটা পাইনি। সফট পেপার লাগবে। আমি মিডিয়াম পেপারে করেছি। সফটেকরলে আরেকটু ভালো হবে। আপনার নেগেটিভগুলা ভালো ছিল।’
আমি অবাক হলাম! আমি আগে বিভিন্ন স্টুডিওতে প্রিন্ট করিয়েছি। কিন্তু কোন দোকানের মালিক এত দরদ দিয়ে বলেন নাই আরেকদিন থাক।’ এ লোক তো দেখি অন্যরকম লোক। নেগেটিভ রেখে চলে আসলাম। পরদিন যখন গেলাম বললেন যে, দেখেন গতকালের প্রিন্ট আর আজকের প্রিন্ট। অনেক পার্থক্য, তাই না? আমি দেখলাম আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এই পার্থক্য কেন হয় আমাকে বুঝিয়ে দিলেন। বললেন আপনার যে নেগেটিভ এটা হার্ড নেগেটিভ ছিল। এজন্য সফট পেপারের দরকার ছিল। আমার কাছে সেটা ছিল না। আমি পরে ব্যবস্থা করে করলাম। এজন্য করলাম, আপনার নেগেটিভগুলা ভালোই ছিল।
নেগেটিভগুলোতে সদরঘাটের ল্যান্ডস্কেপ ছিল। বললেন, কী করেনআপনি? বললাম, ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কী ক্যামেরা? আমি খুলে দেখালাম। দেখে বললেন, ‘এই ক্যামেরা তো সাধারণ ক্যামেরা কিন্তু এর ম্যানুয়ালটা যদি ভালো ভাবে পড়েন, তাহলে এটা দিয়ে অনেক ভালো কাজ করতে পারবেন। আপনি কি পড়েছেন?’আমি বললাম, ওটা তো পড়ি নাই। বললেন যে, আগে ওটা পড়েন। বাসায় গিয়ে ক্যামেরা নিয়ে এটা পার্ট বাই পার্ট পড়েন।’ আমি দেখলাম, কোনদিন এ কথা কেউ এভাবে বুঝিয়ে বলেনি। বিশ্বাস করো, আমি ওই দিন বিছানার মধ্যে ক্যামেরাটা রেখে সারা রাত জেগে বইটা পড়লাম। কয়েকটা জায়গা বুঝলাম না।
ওই বইটা আর ক্যামেরা নিয়ে পরদিন আবার ওই স্টুডিওতে গেলাম। উনি বললেন যে, একটু বসতে হবে। এখন সন্ধ্যার সময় তো! কাস্টোমারের ভিড়। আপনি বসতে পারেন আবার ঘুরেও আসতে পারেন। আমি প্রেসক্লাবে গিয়ে চা খেলাম। একঘন্টা পর আবার আসলাম। উনি বোধ হয় ভেবেছিলেন আমি চলে যাবো। আমার এতো পেশেন্স দেখে বললেন, কাস্টোমার বহু দেখেছি, এরকম আর দেখি নাই। আমি বললাম যে, আমি তিনটা পয়েন্ট বুঝি নাই। উনি আমাকে বললেন আপনি আরেকটু বসেন। আমার দোকান বন্ধ করার সময় হয়ে এসেছে। আমি বন্ধ করে আপনাকে বোঝাবো।
উনি দোকান বন্ধ করলেন। আমাকে দেখালেন যে এই দিয়ে এই হয়। উনি ক্যামেরার অপারেশন করে দেখালেন। উনি সেলফ টাইমার দেখালেন। আমি বুঝলাম না সেলফ টাইমারটা কি? উনি বোঝালেন যে, সেলফ হচ্ছে নিজে। আপনি যদি নিজের ছবি তুলতে চান, সেটাও পারবেন। এই যে দেখছেন, এটাকে টেনে নিয়ে আটকিয়ে দেবেন। তারপর এক্সপোজার ঠিকঠাক করে আপনি ক্যামেরার সামনে বসবেন বা দাঁড়াবেন। ক্লিক করলে পরে ওটা আপনাকে সময় দিবে পোজ দেওয়ার জন্য। আমি দেখলাম যে ওটা টেনে দিলে একটা শব্দ করে প্রায় ১০ সেকেন্ড আমাকে দিল তৈরি হওয়ার জন্য। আমার তো আগ্রহ বেড়ে গেল।
সাহাদাত পারভেজ : তারপর…?
গোলাম মুস্তফা : হ্যাঁ, তাহলে ওইটুকুও বলে ফেলি। বেগ সাহেব দেখলেন যে, আমার কাছে এতো কাস্টমার আসে কিন্তু এ তো কাস্টমার না। এর মধ্যে একটা পাগলামো আছে। ছবি তোলার পাগলামো আছে। আমি শীতকালে একবার পুরোনো হাইকোর্ট বিল্ডিংটার ছবি তুললাম। পুরনো বিল্ডিংটার কথা তোমার মনে আছে? এখনও আছে বিল্ডিঙটা। সামনে যেটার এখন ইদগাহ ময়দান। ওখানে কিন্তু একট বড় লেক ছিল। লেকটা খুব সুন্দর ছিল। টলটলে পানি থাকতো ওই লেকে। আর শীতকালে লেকের পানিতে হাইকোর্টের চূড়াটা রিফ্লেকশন হতো। তো আমি একটা ছবি তুললাম। কিন্তু চূড়ার রিফ্লেকশনটা ঠিক জায়গা মত পাই নাই। বেগ সাহেবকে দেখালাম। উনি বললেন, ‘এই ছবি এভাবে হবে না। আপনাকে অন্তত কুড়ি ফুট ওপরে উঠতে হবে।’ কুড়ি ফুট ওপরে উঠতে হলে কী করে হবে? বললেন, সামনের গাছটায় একটা মই লাগিয়ে চেষ্টা করতে হবে।’ বিশ্বাস করো, এখন সাহস করবো না, সেই এনার্জিও এখন নাই।
পরদিন সম্ভবত রোববার ছিল। ছুটির দিন। তোপখানা রোডের একদম পুব প্রান্তে একটা ইলেকট্রিক্যাল দোকান ছিল, ক্রিসেন্ট নাম। ওখানে এক অবাঙালি লোক ছিলেন, বেগ সাহেবের বন্ধু। তাকে বললাম যে আমাকে একটা মই দেওয়া যায়? যা ভাড়া হয় আমি দিয়ে দেবো। বললেন, ‘তুমি ইউনিভার্সিটির ছাত্র, বেগ সাহেবের ওখানে যাও; তোমার ভাড়া লাগবে না। তুমি নিয়ে যাও। তবে সাবধানে নিও।’ চারজন কুলি ভাড়া করে মই নিয়ে আসলাম। তারপরে গাছের সঙ্গে লাগালো হলো। আমার আগফা আইসোলেট ক্যামেরা। আমি উঠলাম। উঠে দেখলাম যে …। আমি বলছি ঠিকই, আমি কিন্তু সেই দৃশ্যটার মধ্যে চলে গেছি অলরেডি।
সাহাদাত পারভেজ : ওই সময়ে চলে গেছেন?
গোলাম মুস্তফা : হ্যাঁ। আমি ছবি দেখতে পাচ্ছি। হাইকোর্টের চূড়াটার যে রিফ্লেকশন পড়ছে পানিতে, আমি তা দেখতে পাচ্ছি। আমি জানি না, এটা কি আমার কোন বাড়তি গুণ নাকি বাড়তি পাগলামো?
সাহাদাত পারভেজ : পাগলই তো। মানুষের মনটা তো পাগলই।
গোলাম মুস্তফা : আমি দেখতে পাচ্ছি একেবারে। বরং আমি যেটা মাঝেমাঝে করি এবং ছাত্রদের বলি, তুমি চোখ খুলে যা দেখবে, চোখ বন্ধ করলে তার থেকে বেশি দেখবে। যখন তুমি ওই স্টেজে যাবে, দ্যান ইউ আর আ ফটোগ্রাফার। আমি নর্থসাউথে পড়ালাম তো প্রায় দশ বছর, ওরা এর মানে বোঝে না। বলে স্যার, চোখ বন্ধ করলে কী করে দেখবো? আমি বলি, চোখ বন্ধ করলেই বেশি দেখবে। আর খুলে রাখলে কম দেখতে পাবে। কারণ, চোখ খুললে তোমার সামনে যা আছে তুমি শুধু তাই দেখবে। আর চোখ বন্ধ করলে তোমার দিগন্ত খুলে যাবে। যা নাই, তাও দেখতে পাবে।
সাহাদাত পারভেজ : আসলে দেখা নামের প্রক্রিয়াটা তো নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক। চোখটা হচ্ছে একটা ডিভাইস।
গোলাম মুস্তফা : হ্যাঁ, আমার এখন চোখ খোলা। কিন্তু আমি এখন দেখতে পাচ্ছি। ওপরে উঠলাম। ওই চারজন ওরা নিচে মই ধরে আছে। যত ওপরে উঠছি তত কাপাকাপি বাড়ছে। বাঁশও সরু হয়ে যাচ্ছে। ক্যামেরা গলায় প্যাচানো। বারোটা এক্সপোজার আছে, আমি বারোটাই তুললাম। ডানে বায়ে করে, এক্সপোজার চেঞ্জ করে তুললাম। বেগ সাহেব বলেছিলেন যে স্টপ (এফ) পরিবর্তন করে তুলবেন। আমি সার্টারস্পিড ১২৫ ফিক্সট রেখে এফ ২২, ১৬, ১১, ৮, এবং ৫.৬ এ ছবি তুললাম।
পরদিন সকাল বেলা, সোমবার। আমি উত্তেজনার চোটে চলে গেছি বেগ সাহেবের স্টুডিওতে। উনি তখনও আসেন নাই। উনি তখন থাকতেন উনার বোনের বাসায়, আরমানিটোলায়। কিছুক্ষণ পর মোটরসাইকেলে করে উনি আসলেন। উনার একটা সুজুকি মোটরসাইকেল ছিল। আমাকে দেখেই বললেন, ‘আরে মুস্তফা সাহেব, আপনি চলে আসছেন? আজকে ইউনিভার্সিটিতে যান নাই?’
আমি বললাম, যাই নাই, ‘যাবো। আমার রোলটা ডেভেলপ করে নেগেটিভ দেখে যাবো।’
বেগ সাহেব বললেন, ‘কোন নেগেটিভ?’
আমি বললাম, ‘আপনি যে মই দিয়ে হাইকোর্টের ছবি তোলার চেষ্টা করতে বলেছিলেন।’
বেগ সাহেব স্টুডিও না খুলে পেছনে যে ডার্করুম ছিল, ওটা খুললেন। বললেন, ‘আপনি বাইরে বসেন। আমি ডেভেলপ করি।’ আমার পাগলামিতে উনিও যোগ দিলেন। উনারও তর সইছে না দেখার জন্য। উনি ফিক্স করেই আর পানিতে চুবান নাই। দেখে বলেন যে, ‘হইসে, হইসে, হইসে। আপনি পারছেন।’ ফাটাফাট কিভাবে যেন নেগেটিভ ড্রাই করে ফেললেন। কন্ডাক্টও শিট প্রিন্ট করে ফেললেন ।
বললেন, ‘আপনি এখন ক্লাসে যান। বিকেলে আপনার বেস্ট নেগেটিভ থেকে আমি প্রিন্ট করে রাখবো।’
ক্লাসে বসে আছি। কিন্তু বিকেল আর সহজে আসে না! ঘড়ি দেখছি বারবার। কখন বিকাল হবে, কখন দেখবো প্রিন্ট? ক্লাস শেষ করে গেলাম। উনি আমাকে অবাক করে দিলেন। বললেন, ‘আপনার ছবি হইছে। স্টুডিওর মধ্যে রাখা আছে। ড্রাই হচ্ছে।’ একটা বারো বাই ষোল পেপারে একটা প্যানারমি ভিউ উনি প্রিন্ট করে ফেলছেন। আমি কিন্তু উনাকে প্রিন্ট করতে বলি নাই। নিজের উৎসাহে উনি একটা ছবি প্রিন্ট করে ফেলছেন। বললেন, আমি এটা আমার স্টুডিওতে লাগাবো। আপনার জন্য একটা ছোট করবো।
বললেন, এই ছবিটার একটা ব্যাপার আছে। আপনি আমার কথা মত ছবিটা তুলছেন। তাই আপনার সম্মানে ছবিটা স্টুডিওতে রাখলাম। আমি সেদিনই তাঁর ছাত্র হয়ে গেলাম। ছাত্র কাম বন্ধু। তিনি বললেন, ‘এরকম ছাত্র আমি আর পাই নাই।’
আমি বললাম, আমিও এমন শিক্ষক পাই নাই। তারপর যা হলো, আমি তাঁর সঙ্গে ছবি তোলা, এখানে-ওখানে যাওয়া, খারাপ অভিজ্ঞতা, ভালো অভিজ্ঞতা; সবই হয়েছে। উনার সঙ্গে আমি আজন্ম, আমৃত্যু ছিলাম। আর আমার ওই ছবিটা শেষ দিন পর্যন্ত উনার স্টুডিওতে ছিল।
সাহাদাত পারভেজ : স্টুডিওটা কত দিন ছিল? ইনস্টিটিউট হলো কবে, কেমন করে?
গোলাম মুস্তফা : স্টুডিওতে থেকেই তিনি একটা ইনস্টিটিউট করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। উনার দুঃখ ছিল, কেন ফটোগ্রাফাররা সম্মান পায় না? যারা পেইন্টার তাঁরা রেজিস্টার একটা ইনস্টিটিউটে পড়ে। একটা নির্দিষ্ট কারিকুলামের মধ্য দিয়ে যায়। পরীক্ষা দেয়, পাস করে, সার্টিফিকেট নেয়। এইভাবে রাষ্ট্র তাঁদের স্বীকৃতি দেয়। আর ফটোগ্রাফাররা ক্যামেরা নিয়ে রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে ফটোগ্রাফার হয়ে যায়। তাঁদের কোন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। আগে ফটোগ্রাফারদের মনে করা হতো, যারা লেখাপড়া করে না তাঁরাই ফটোগ্রাফি করে।
বেগ সাহেবের আমলে কী ছিল? হয় স্কুল ড্রপ আউট, না হয় কলেজ। ওই ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে একদিন ফটোগ্রাফার হয়ে যেত। চাকরিও হয়তো পেয়ে যেত, বেতনও পেত। কিন্তু সেভাবে সামাজিক সম্মানটা ছিল না। এইখান থেকে বেগ সাহেবের মনে একটা জেদ চাপে। তিনি একটা ইনস্টিটিউট করার সিদ্ধান্ত নেন, যেখানে নিয়ম মত পড়ানো হবে, পরীক্ষা হবে; পাস করলে সার্টিফিকেট দেওয়া হবে।
উনি কী করে জানলেন এসব? তিনি যখন এয়ারফোর্সে চাকরিতে ঢুকেন তখন একজন সিনিয়র সুইস ফটোগ্রাফারের সান্নিধ্য পান। তাঁর নামটা এই মূহুর্তে আমার মনে চলে আসছে লাকিলি, কত বছর আগে শোনা নামটা, কুর্থ ব্লুম। কুর্থ ব্লুম তাঁর শিক্ষক ছিলেন। এয়ারফোর্সের কিছু লোককে তিনি ফটোগ্রাফি শেখাতেন। বেগ সাহেবও ওই কোর্সে ছিলেন। ওটার আদলে উনি একটা ইনস্টিটিউট শুরু করলেন। ১৯৬০ সালে মাত্র ৫-৬ জন ছাত্র নিয়ে তিনি বেগার্ট ইনস্টিটিউট করলেন। তিনি যখন এই ইনস্টিটিউট করলেন তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৯ বছর। আমি ওই ইনস্টিটিউটের প্রথম ব্যাচের ছাত্র। আরেকজনের নাম মনে আছে হাজী আবু তালেব। তালেব সাহেব বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিসার ছিলেন। বাকিদের নাম এই মুহূর্তে মনে আসছে না।
সাহাদাত পারভেজ : তো আপনি খুবই লাকি। আপনার বাবা আপনাকে ক্যামেরা কিনে দিয়েছেন সেই সময়ে।
গোলাম মুস্তফা : হ্যাঁ, শুধু ক্যামেরাই না, আশীর্বাদ এবং সমর্থন দুটোই পেয়েছি। ওই যে কিছু প্রাইজ পেলাম, দেখলেন ছেলে ভালোই করছে। তারপরে ওই চাকরিটা করা শুরু করলাম ইউএস এইডে। চাকরি করে নামটামও কামালাম। আমার প্রথম ট্রেনিংটা হয়েছিল ইউএসআইএস এ। তারপর ইউএস এইডে। আমার যে বস ছিল তাঁর নাম জোসেফ এল বাডি। আমার কেন যেন মন বলছে, উনি এখনও বেঁচে আছেন। বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স এখন একশর কাছাকাছি হবে। আমি তাঁর সন্ধান করার চেষ্টা করেছি। আমি ইউএস এইডে যোগাযোগ করেছি। তারা সন্ধান দিতে পারলো না। আমেরিকান কনসোলেটে যোগাযোগ করেছি। কনসোলেট না, অ্যাম্বাসিতে যোগাযোগ করেছি। তারাও সার্চ দিয়ে খুঁজে পায়নি। উনার ওয়াইফ ছিলেন পার্সিয়ান, ইরানী। ইউএস এইডে আসার আগে উনি কোরিয়ান ওয়্যারে ন্যাভির ফটোগ্রাফার ছিলেন। মানে ইউএস নেভি থেকে উনি কোরিয়ান ওয়্যারে কাজ করেছিলেন এজ অ্যা ন্যাভাল ফটোগ্রাফার। কাজেই উনি ফটোগ্রাফি ভালোই জানতেন। আর ওই জানাটা আমার বেশ কাজে লেগেছে। তো আমার প্রথম ট্রেনিং মনজুর আলম বেগ সাহেবের কাছে, তিনি আমার গুরুদেব। আর দ্বিতীয় ট্রেনিং হয় জোসেফ এল বাডির কাছে।
সুশান্ত পালের ধারণ করা ভিডিওচিত্র থেকে অনুলিখন করেছেন জাহরা জাহান পার্লিয়া
{আগামীকাল থাকবে তৃতীয় পর্ব।}
ক্যামেরার কারণে আমার কাজের মান ভালো হয়ে গেল : গোলাম মুস্তফা, পর্ব-১
8 thoughts on “কলেজের ম্যাগাজিনের কাভারে ছবি ছাপানো হওয়ার গর্বে আমার তো ঘুম নাই : গোলাম মুস্তফা, পর্ব-২”