ক্যামেরার কারণে আমার কাজের মান ভালো হয়ে গেল : গোলাম মুস্তফা, পর্ব-১


সাহাদাত পারভেজ : আপনি আমাদের আলোত্রচিত্র চর্চার শুরুর দিকের সাক্ষী। আপনি কেমন করে এই যাত্রায় সামিল হলেন?
গোলাম মুস্তফা : আমি বোধহয় সঠিক সাক্ষী নই। আমার স্বাক্ষ্যতে কিছু ভুল ত্রুটি হতে পারে। কারণ আমার আগেও তো ছিল। আমি এসেছি অনেক আগে, সেটা ঠিক। তবে আমার আগেও আমি কয়েকজনকে পেয়েছিলাম। আমি তাঁদের কথা দিয়ে শুরু করি?
সাহাদাত পারভেজ : জ্বী, অবশ্যই।
গোলাম মুস্তফা : তাহলে সঠিক তথ্য দেয়া হবে। একটা হল যে, আমি তখন নারায়ণগঞ্জের একটা স্কুলে পড়ি। স্কুলে আমার এক ক্লাসমেট ছিল। ওর ডাক নাম টোগো। ভালো নাম ওমর হায়াত মালিক। খুব ধনী লোকের ছেলে। খুব সৌখিন। বাড়ি ছিল চুয়াডাঙ্গায়। পশ্চিমবঙ্গ অরিজিন ওদের। তো ওই বয়সে যখন ফোর বা ফাইভে পড়ি তখনই তাঁর একটি ক্যামেরা ছিল। প্রোবাবলি কোডাকের বক্স ক্যামেরা। চারকোণা এই বক্স ক্যামেরাটি খুব পপুলার ছিল সে সময়ে। ওই ক্যামেরা নিয়ে সে ছবি তুলতো। তাঁর সঙ্গে মাঝেমধ্যে আমিও তুলতাম। তখন ওয়ান টুয়েন্টি ফিল্ম। সেটা দিয়ে বারোটা ছবি হত। সেটা দিয়ে সে দশটা তুলত আর আমি হয়ত দুইটা তুলতাম। এভাবেই ক্যামেরার সঙ্গে প্রথম পরিচয়।
সাহাদাত পারভেজ: কত সাল?
গোলাম মুস্তফা: সেটা সম্ভবত ১৯৫০ হবে (মনে করার চেষ্টা করে)। অর্থাৎ দেশভাগের পরপরই। টোগো আর আমি ঘুরে ঘুরে ছবি তুলতাম। আমরা ছিলাম চাষাঢ়ায়। নারায়ণগঞ্জের বিখ্যাত জায়গা। চাষাঢ়া স্টেশনটা আমাদেরবাড়ির খুব কাছেই ছিল। আমার প্রিয় জায়গা ছিল রেলওয়ে স্টেশনটা,তার লাইনটা; আর লাইনের চারপাশে যে বড়বড় পাথর পড়ে থাকত সেগুলো। দুই জোড়া রেললাইন দূরে কোথাও চলে গেছে, মনে হচ্ছে যেন দূরে কোথাও গিয়ে মিশে গেছে। ওই মেশাটা দেখার জন্য আমরা অনেকদিন মাইলের পর মাইল হেঁটেছি। যতই যাই, মেশাটা আর কোথাও খুঁজে পাই না। আসলে কেউ কাউকে স্পর্শ করে নাই। একসময় বুঝলাম যে, এটা দেখার ভুল। আবার ওখান থেকে ফিরে আসতাম। দূর থেকে দখতাম। পথে পড়ে থাকতো ডিজাইন করা নানান রঙেরপাথর। সেগুলো আমরা কুড়িয়ে আনতাম। এভাবে পাথর কুড়ানো আমার স্বভাব হয়ে গেল।

দেখো, এইটুকু কথা বলে আমি কিন্তু টায়ার্ড হয়ে গেছি। তো আবার পাথরের কথায় আসি। এই পাথর কুড়ানো আর এগুলোর ছবি তোলা একটা নেশা হয়ে গেল। ক্যামেরাটা যদিও তাঁর, ওর বাবার কিনে দেওয়া, তবু ক্যামেরাটা বেশিরভাগ সময় আমার কাছে থাকত। টেগো বলত, তুই এত পাথরের ছবি তুলিস কেন? আমি বলতাম, ‘জানি না, কেন জানি ভাল্লাগে।’ যা হোক, সে অন্য গল্প।
এরপর আমরা একটু বড় হলাম। ক্লাস এইটে পড়ি। সে আর আমি একসঙ্গে। নাইনে ওঠার পর তাঁর বাবা বদলি হয়ে গেল চট্টগ্রামে। সেও বাবার সঙ্গে চলে গেল। আমাদের বন্ধুত্বের বিচ্ছেদ হয়ে গেল। তারপর আর ক্যামেরা পাই না। অনেকদিন ছবি তুলতে পারি না। আমার নিজের কোন ক্যামেরা নাই। তবে টুকটাক এর ওর ক্যামেরা নিয়ে ছবি তোলার চেষ্টা করি। এভাবে ম্যাট্রিক পর্যন্ত পার হয়ে গেল। ম্যাট্রিক পাস করার পরে ভর্তি হলাম জগন্নাথ কলেজে।
সাহাদাত পারভেজ : আপনার স্কুলটা যেন কি ছিল? নারায়ণগঞ্জের কোন স্কুলে পড়তেন?
গোলাম মুস্তফা : ওই একটা মাত্র স্কুল, যেই স্কুলের সঙ্গে স্কুল নামটা ছিল না। নাম ছিল ‘বার একাডেমি।’ বার হলো কেন? ওই স্কুলর গভর্নিং বডির যারা মেম্বার ছিল, সবাই ল’ইয়ার। এজন্য হয়েছিল বার একাডেমি। স্কুল ছিল না। আমরা অনেক সময় বলতাম ‘বার একাডেমি স্কুল’। স্কুল বলার দরকার ছিল না। যা হোক, সে স্কুলের সাথে অনেক স্মৃতি। ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হলাম জগন্নাথ কলেজে। ঢাকা কলেজে পড়ার ইচ্ছা ছিল। ঢাকা কলেজ সে সময় খুব নামকরা কলেজ। ঢাকা কলেজ তখন ছিল কিন্তু পুরোনো রেলস্টেশনটার কাছে। তখন নিয়ম ছিল আইসি পড়তে হলে ফার্স্ট ডিভিশন পেতে হবে। আমি ভালো ছাত্র ছিলাম। ক্লাসে ফার্স্ট সেকেন্ড হতাম। কিন্তু পরীক্ষায় আর ফার্স্ট ডিভিশন পাইনি। কাজেই ঢাকা কলেজে চান্স পেলাম না। মা সবাইকে বলল, ‘দরকার নেই দূরের কলেজে পড়ার। ঘরের কাছে জগন্নাথ কলেজ। ওকে এখানে ভর্তি করে দাও। দুপুরে বাসায় এসে আমার ছেলে গরম ভাত খেয়ে যাবে (হাসি)।’ আমি জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম। তাতেই বোধ হয় আমার জীবনের একটা বিশাল পরিবর্তন হয়ে গেল।
আমি যদি ঢাকা কলেজে চান্স পেতাম, তাহলে জীবন হয়তো অন্য খাতে যেত। আর চান্স না পাওয়ায় আমার জীবনটা অন্য খাতে প্রবাহিত হলো। হয়তো এটাই ঈশ্বরের ইচ্ছা ছিল। তবে হ্যাঁ, এখানে ভর্তি হওয়ায় অন্যধরণের কিছু ছাত্রের সঙ্গে আমার খাতির হলো; যারা নাটক করে, গান গায় বা গান শুনতে ভালোবাসে, খেলাধূলা ভালোবাসেকিংবা যারা সিমপ্লি আড্ডা মারতে ভালোবাসে। আমিও এগুলোর মধ্যে জড়িয়ে গেলাম।
আমার প্রিয় খেলা ছিল টেবিল টেনিস। আমি তখন পিংপং খেলতাম। কমন রুমে দুইটা বোর্ড ছিল পিংপংয়ের। একটা আমার ও আরেকজনের দখলে। আমরা খেলতাম। অনেক সময় খেলার মাঝে বেল পড়তো। ক্লাস ফাঁকি মারতাম। ফাঁকি মারতাম কিন্তু পিংপং খেলার জন্যই। ক্লাস অনেক ফাঁকি দিয়েছি। আরেকটা কারণে ফাঁকি মেরেছি, সেটা হলো গান শোনা। গানের প্রতি একটা মোহ, একটা ভালোলাগা তৈরি হল। খুব অবাক ব্যাপার, আমি যখন ফাইভ সিক্সে পড়ি তখনই সন্ধ্যা, প্রতিমা, আলপনা, উৎপলা, হেমন্ত, শ্যামল, মানবেন্দ্র ধনঞ্জয় ওদের ভক্ত। আরও অনেকে আছে। তবে হেমন্ত আর সন্ধ্যা খুবই প্রিয়।
একটা গল্প করি এখানে। জগন্নাথ কলেজে আমার এক অবাঙালি বন্ধু ছিল। ও উর্দুও বলত, বাংলাও বলত। নাম নিজাম। আমি সন্ধ্যা মুখার্জীর গান গুণগুণ করে গাইতাম। সে বলত, তুমি কী গান গাচ্ছো? পাকিস্তানি ভালো ভালো গান আছে, উর্দু গান আছে। তুমি সেগুলি গাও। একদিন সন্ধ্যা মুখার্জির গুনগান করতেই সে বলে, কী নাম বললে? আমি বললাম, সন্ধ্যা মুখার্জী, দারুণ গায়িকা। সে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে, ‘ও সন্ধ্যা মুখার্জী? ওর গান শুনলে আমার তো গা রি রি করে।’
সে কিন্তু আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু ও এভাবে বলায় আমি মুহূর্তে ক্ষেপে গেলাম। ওর গালে কোষে একটা চড় মারলাম। তখন আমি গাট্টাগোট্টা ছিলাম। চড় খেয়ে সে ধাম করে নিচে পড়ে গেল! আমি সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে ওকে ধরে তুললাম। বললাম, আমাকে মাফ করে দে। ও বলল, তুমি আমাকে মারলে! আমি বললাম, তুমি আমাকে দুইটা চড় মারো। তবু তুমি সন্ধ্যা মুখার্জীকে তাচ্ছিল্য করতে পারো না। সন্ধ্যা মুখার্জী আমার প্রাণ। তাঁর গান শুনে আমি ঘুম থেকে উঠি, উত্তেজিত হই, আমার লোমকোষ দাঁড়িয়ে যায়। এতে অন্য বন্ধুরা অবাক হয়ে গিয়ে ভাবলো এ ছেলে সন্ধ্যা মুখার্জির এত পাগল!
তো,আমি অনেক পাগলামি করেছি, অনেক ভুলভাল কাজ করেছি ছোটবেলায়; এই গান শোনার জন্য। ক্লাস ফাঁকি দিয়েছি। টিচার দেখেছেন কমন রুমে গিয়ে গান শুনছি। বলেছেন ক্লাসে যাও। গানটান পরে হবে। আমি বলেছি, স্যার একটু পরে যাচ্ছি। পরে আর যাওয়া হয়নি। আসলে আমার গানের প্রতি আকর্ষণ ছিল লেখাপড়ার থেকে অনেক বেশি। আমার মনে হত লেখাপড়া তো পরেও বইটই উল্টে পাল্টে করা যাবে। কিন্তু গানটা মিস করলে তো আর করা যাবে না। তো সন্ধ্যা মুখার্জীর গান শুনে এত পাগল হয়ে গেলাম, ইচ্ছা ছিল যদি কোনদিন ধনী হই; তাহলে আমি আমার বাড়ির সামনে সন্ধ্যা মুখার্জীর একটা পাথরের মূর্তি গড়বো। ওই সময়ের পাগলামি আর কী।
সাহাদাত পারভেজ : তারুণ্যে যা হয়।
গোলাম মুস্তফা : হ্যাঁ, যা হয়। সেই ধনীও হওয়া গেল না। পাথরের মূর্তি করারও পয়সা হয় নাই কখনও। তারপর ইচ্ছে হলো যে, কখনও কলকাতায় গিয়ে সন্ধ্যা মুখার্জীর পা ছুঁয়ে একটা প্রণাম করে আসব। স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর টিমে একবার গেলাম। আকাশবাণী থেকে সন্ধ্যা মুখার্জীর ঠিকানা নিলাম। যেই মহিলা ঠিকানা দিলেন, তিনি বললেন, ‘আমি ঠিকানা দিলাম, ফোন নম্বরও দিলাম কিন্তু আপনি তাঁর দেখা পাবেন না। তাঁর স্বামী ফোন ধরবে। আপনাকে বলবে ও তো এখন মন্দিরে আছে, পূজো করছে।’
আমি ফোন করলাম। বললাম, দিদি আছেন? তাঁর স্বামীপুলক বন্দোপাধ্যায় ফোন ধরলেন। বললেন, ‘ও তো নাতিকে নিয়ে ছাদে রোদ পোহাচ্ছে।’
আমি বুঝলাম, মিথ্যা কথা। কারণ জুন মাসে রোদ পোহানোর কথা না। বুঝতে পারলাম যে দেখা করতে দেবে না। তিনবার চেষ্টা করেছি। একবার রোদ পোহাচ্ছে, একবার পূজাতে আছে, আরেকবার ঘুমাচ্ছে। তো ওই মহিলা বললেন যে,‘আপনি এভাবে পারবেন না। আপনি উনাকেএকটা চিঠি লেখেন। তাহলে উনি আপনাকে একটা সময় দেবেন।’
চিঠিও লিখলাম। তবে উনি পেলেন কী না, জানি না। এরপর আমি তিনবার কলকাতা গেছি। তিনবারই চেষ্টা করেছি। তিনবারই ব্যর্থ হয়েছি। পরে আমি বুঝলাম যে, এভাবে হবে না। এখনও আশা আছে। এখনও সন্ধ্যা মুখার্জী বেঁচে আছেন। তাঁর পাগল ভক্তটা এখনও বেঁচে আছে। আমার একটাই ইচ্ছা। পাথরের মূর্তি হলো না। কিন্তু একটা প্রণাম করতে পারব না, এটা কি করে হয়! এরপর গেলে একটা ফুলের ঠোঙা নিয়ে সরাসরি বাসায় চলে যাব। এবার কাজের কথায় আসি।
সাহাদাত পারভেজ: হেমন্তের কথা বলছিলেন।
গোলাম মুস্তফা : হ্যাঁ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কপি কলকাতাতেই আছে, বোম্বেতে আছে; ঢাকাতেও আছে। কিন্তু হেমন্তের মতো হয় না। হেমন্তের গলার যে গভীরতা, উচ্চারণের যে মাধুর্য্য, যে সফেস্টিকেশন, সেটা হয় না। আমার দ্বিতীয় ফেভারেট হচ্ছে মানবেন্দ্র। এক ডাক্তার পেলাম হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে, যার নাম মানবেন্দ্র। আমি একবার এক্সিডেন্ট করে পড়ে গিয়েছিলাম। উনি আমার মাথায় সেলাই করেছিলেন। পরে একদিন কিছু ফুল আর মিষ্টি নিয়ে ওনার কাছে গেলাম। উনি এমার্জেন্সিতে ছিলেন।
উনি বললেন, এগুলো কী জন্য? বললাম, এজন্য যে ভালো হয়ে গেছি। বললেন, এগুলো তো নেবো না। বললাম, এগুলো এজন্য নেবেন, আপনার যে নাম, সেটি খুব প্রিয়। মানবেন্দ্র মুখার্জী আমার সবচেয়ে প্রিয়তম শিল্পী। হেমন্তের পরে। মনে হয় কী এগুলো বালখিল্যতা। বাল্যকালের পাগলামী সব। এ বয়সে আর মানায় না। যা হোক, এবার একটু কাজের কথায় আসি।
আমি জীবনে অনেক প্রিভিলেজড। আমার প্রথম ট্রেনিং হয় তৎকালীন ইউএসআইএসয়ে;আমেরিকান অর্গানাইজেশন, আমেরিকান ট্রেইনারের অধীনে। তোপখানা রোডে ছিল এর অফিস, ঠিক প্রেসক্লাবের উল্টোদিকে। ট্রেনিংয়ের পরে আমার প্রথম পরিচয় হয় মনজুর আলম বেগের সঙ্গে। একটা ঘটনা চক্রে। কী করে হলো আমি জানি না। ভাগ্য ঠিক বিশ্বাস করি না, কিন্তু কী করে যেন ঘটনা ঘটে গেলো।
সাহাদাত পারভেজ : কত সালের দিকে?
গোলাম মুস্তফা :আমি তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেছি মাত্র। ১৯৬০ এ। তখন ইউনিভার্সিটিতে দুই বছরের পাস কোর্স ছিল, আবার তিন বছরের অনার্স কোর্সও ছিল। আমি পাস কোর্সে ভর্তি হলাম। সেটা অবশ্য শেষ পর্যন্ত শেষ হয়নি। সেটা অন্য ব্যাপার। তবে আমার প্রথম ট্রেনিংয়ের পর চাকরিটা হল বাবার যোগাযোগের কারণে। ইউএসএ আইডিতে। আমরা জোর করে অনেক সময় ইউএস রেড বলতাম। তখন কোরিয়ান যুদ্ধ চলছে। আমেরিকানরা আক্রমণ করছে, কোরিয়ানকে সাহায্য করছে। বাংলাদেশও এইডের অধীনে ছিল। ইউএস এইডের নতুন অফিস হয়েছে মতিঝিল আদমজী কোর্টে। ওখানে একজন ফটোগ্রাফার দরকার। বাবা বললেন, তুমি ওই জায়গায় গিয়ে দেখো, আমি বলে দিচ্ছি। এরমধ্যে আমি ঢাকা মেডিক্যাল আয়োজিত ইস্ট পাকিস্তান ফটোগ্রাফিক কম্পিটিশনে তৃতীয় পুরস্কার পেয়ে গেলাম। এটি চাকরিতে ঢুকতে বেশ কাজে দিয়েছিল।
ঠিক পরের বছরই, অর্থাৎ ৬০ সালে পেলাম অল পাকিস্তান ফটোগ্রাফি কন্টেস্ট, অর্গানাইজড বাই পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিল। ওটা করাচিতে হল। ওখানে আমি আর আমার গুরু বেগ সাহেব ছবি পাঠিয়েছিলাম। এক বছর কোনো খবর নাই। এক বছর পর একদিন বেগ সাহেব আমার বাসায় এসে হাজির। বাসা তখন বাংলাবাজারে, প্যারিদাস রোডে। বেগ সাহেবের হাতে একটা ঠোঙ্গা। বললেন, ‘মুস্তফা সাহেব জলদি আসেন, জলদি আসেন। মিষ্টি খান।’আমি বললাম, মিস্টি কেন? বেগ সাহেব বললেন, ‘আপনি তো প্রাইজ পেয়েছেন।’
কী প্রাইজ পেয়েছি?
উনি বললেন,‘ওই যে এক বছর আগে ছবি পাঠিয়েছিলাম করাচিতে, মনে আছে? পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিলে? আপনি সেকেন্ড প্রাইজ পেয়েছেন।’ করাচি ফার্স্ট হয়েছে, ঢাকা সেকেন্ড আর থার্ড লাহোর। আপনি সেকেন্ড প্রাইজ পেয়েছেন।’
অবিশ্বাস্য! ওখানে তো বেগ সাহেবও ছবি দিয়েছেন। ওনারটা হয়েছে অনারেবল মেনশন। অল পাকিস্তান কিন্তু। অনারেবল মেনশন পাওয়াটা কিন্তু বড় ব্যাপার। ওই প্রাইজ পাওয়াটা আমাকে রাতারাতি বিখ্যাত করে দিল। আমার প্রতি বাবারও একটা ভালো দৃষ্টি তৈরি হলো। বাবা তখন পেশাগত কাজে প্রায়ই বিদেশ যেতেন। আমি বাবাকে একবার চিঠি লিখলাম, ‘আমার ক্যামেরাটা খুবই সাধারণ। আমার জন্য কি আগফা একটা ফোল্ডিং ক্যামেরা আনা যায়?’
বাবা ওই ক্যামেরাটা নিয়ে আসলেন। আমার জন্য ওটা হাতে স্বর্গ পাওয়ার মত ব্যাপার। ক্যামেরার কারণে আমার কাজের মান ভালো হয়ে গেল। একটুখানি খ্যাতি ছড়াতে লাগলো। ওই ক্যামেরা আমার উৎসাহ বাড়িয়ে দিল। বলতে খারাপ লাগছে আমি আস্তে আস্তে পড়ালেখা থেকে দূরে সরে আসলাম। বাবা দেখলেন, এভাবে আর লেখাপড়া হবে না। উনি নিজের প্রভাব খাটিয়ে আমাকে জার্মানীতে একটা স্কলারশিপ ব্যবস্থা করে দিলেন। আমি দেখলাম, আমাকে একবছর লেখাপড়া করতে হবে। আর লেখাপড়া করলে ফটোগ্রাফি কে করবে?
এরপর গেলাম কাসেম ড্যাডির সঙ্গে পরিচয় হল। বেগ সাহেবই একদিন নিয়ে গেলেন ড্যাডির ইন্দিরা রোডের বাসায়। গিয়ে দেখা পেলাম সাইদা খানম, ইউসুফ মোহাম্মদ প্যাটেলসহ আরও বড় বড় কয়েকজন ফটোগ্রাফারের। তো বেগ সাহেব ড্যাডির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, ‘এই হচ্ছে মুস্তফা; আমার ছাত্র ও বন্ধু। ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। তার বাবা ঠিক করেছে তাকে জার্মানি পাঠিয়ে দেবে। মেটাল ইঞ্জিনিয়ার বানাবে। দেখেন তো?’
আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। জানি না কী ঠাট্টার ছলে, নাকি সিরিয়াসলি, নাকি কোনো দিব্যদৃষ্টি দিয়ে, উনি উনার তর্জ্জনি দিয়ে আমার পুরো কপাল স্পর্শ করে বলেছিলেন, ‘তুমি বাবা ফটোগ্রাফিই করো। তুমি ইঞ্জিনিয়ার হবে না। তোমার কপালে ইঞ্জিনিয়ার হওয়া নাই। তুমি ফটোগ্রাফিতে থাকো। এখানেই তুমি ভালো করবে।’
আমি শুনলাম কী শুনলাম না। ভাবলাম বুড়ো মানুষ বলেছে, ঠিক আছে। চলে আসার আগে ক্যামেরা রিক্রিয়েশন ক্লাবের সদস্য হলাম। উনার কথা যে সত্যি হবে, তা কে জানতো। অন্য কথায় চলে গেলাম। ট্র্যাকে ফিরে আসি। তুমি মাঝে মাঝে আমাকে ট্র্যাকে আনার জন্য ক্লু দেবে। বুঝলে? তুমি যেটা করেছ, আমার স্মৃতির দীঘির মধ্যে একটা ঢিল ছুঁড়ে দিয়েছ।
সুশান্ত পালের ধারণ করা ভিডিওচিত্র থেকে অনুলিখন করেছেন জাহরা জাহান পার্লিয়া
{আগামীকাল থাকবে দ্বিতীয় পর্ব।}
বইচারিতায় আরও পড়ুন :
ক্যামেরার কারণে আমার কাজের মান ভালো হয়ে গেল : গোলাম মুস্তফা, পর্ব-১
সেই ছোট-খাটো মানুষটি
কম বয়সে উপন্যাস লিখে গিনেস বুকে নাম লিখালেন সৌদি বালিকা রিতাজ আলহাজমি
কারিনার নতুন বই ‘কারিনা কাপুর খান’স প্রেগন্যান্সি বাইবেল’
আর্জেন্টিনা, ভালোবাসার নীল সাদা নাম
ভালোবাসা ও মায়ার রোকেয়া হল
শুধু মেসির জন্য..
17 thoughts on “ক্যামেরার কারণে আমার কাজের মান ভালো হয়ে গেল : গোলাম মুস্তফা, পর্ব-১”