আমার বোধহয় জন্মটাই হয়েছে লেখালেখি করবার জন্য…

কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০২০ এবারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাহিত্য শাখায় ১৯৭১: বিধ্বস্ত বাড়িয়ায় শুধুই লাশ এবং’ বইটির জন্য পুরস্কার পেয়েছেন ইজাজ আহমেদ মিলন। তিনি ১৯৮৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের আক্তাপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা নাম ইদ্রিস আলী, মা জমিলা আক্তার। ২০০৯ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নষ্ট শরীর ভিজে না রৌদ্রজলে’ প্রকাশিত হয় । এ কাব্য গ্রন্থের জন্য সে বছরই তিনি তরুণ লেখক ক্যাটাগরিতে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম-চ্যানেল আই ও সিটি ব্যাংক প্রবর্তিত সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ ১৯৭১ : বিধ্বস্ত বাড়িয়ায় শুধুই লাশ এবং’ বইটিতে প্রায় ৩ বছর অনুসন্ধানের পর উঠে এসেছে ১৯৭১ সালের ১৪ মে দুপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া হিন্দু অধ্যুষিত গাজীপুরের বাড়িয়া। তিন দিক থেকে বেলাই বিলে ঘেরা বাড়িয়ায় নির্বিচারে চালানো হয় গণহত্যা। বিল সাঁতরে কিংবা নৌকায় চড়ে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন শত শত নারী-পুরুষ আর শিশু। পাকিস্তানি নরপশুদের হত্যা শিকারের উল্লাসের নিচে শহীদ হন অন্তত দুইশত মানুষ। শহীদের নামে তালিকা ধরে দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক ইজাজ আহমেদ লিখেছেন ‘১৯৭১ : বিধ্বস্ত বাড়িয়ায় শুধুই লাশ এবং’ গ্রন্থটি। তাঁর প্রকাশিত বই ১৭টি । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাংবাদিকতার জন্য দুইবার পেয়েছেন বজলুর রহমান স্মৃতি পদক, আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘বেদনা আমার জন্ম সহোদর’ গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন দাগ সাহিত্য পুরস্কার। লেখালেখি বিষয় বইচারিতায় আলাচারিতা করেন কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক ইজাজ আহমেদ মিলন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজিয়া সুলতানা ঈশিতা।
রাজিয়া সুলতানা ঈশিতা: আপনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখছেন, কবে থেকে লিখছেন? লেখালেখির শুরুটা কিভাবে হলো?
ইজাজ আহমেদ মিলন: আমার বোধহয় জন্মটাই হয়েছে লেখালেখি করবার জন্য। আমার বয়স যখন খুবই কম, ক্লাস থ্রিতে পড়ি এরকম একটা সময় পাড়ার ছেলেরা একসঙ্গে হয়ে শহীদ দিবস পালন
করতাম। কলাগাছ কেটে তা দিয়ে শহীদ মিনার বানাতাম, সেখানে আমরা শ্রদ্ধা নিবেদন করতাম। ছোটবেলা থেকেই আমার রেডিও শোনার একটা বড় শখ ছিল, খুব রেডিও শুনতাম। যখন ক্লাস থ্রি কিংবা ফোর এ পড়ি তখন আমার বন্ধুরা মিলে শহীদ মিনার বানালাম, রেডিওটা আমার সঙ্গেই থাকত, ওই সময় আব্দুল গাফফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ আমার কাছে মনে হল এই রকম একটা গান কী করে লেখা সম্ভব, এমন একটা
সুর সৃষ্টি করাও কীভাবে সম্ভব। গানের কথাগুলো আমার কাছে প্রেরণা হিসেবে কাজ করে, আমি রাতেই একটা ছড়া লিখে ফেলি। এই ছড়াটা পরবর্তীতে ইত্তেফাকের কচিকাঁচার আসরে ছাপাও হয়েছিল। এভাবেই আমার লেখা শুরু।
বইচারিতা : ১৯৭১: বিধ্বস্ত বাড়িয়ায় শুধুই লাশ এবং‘ বইটির বিষয়বস্তু নিয়ে বলুন। এটা
লেখার পেছনের কি অনুপ্রেরণা কাজ করেছিল?

ইজাজ আহমেদ মিলন: ১৯৭১ এই শব্দটিই হচ্ছে বিষয়বস্তু, তার মানেই হলো মুক্তিযুদ্ধ। আর
মুক্তিযুদ্ধ মানেই তো আমাদের অস্তিত্বের কথা, আমাদের জন্ম ইতিহাসের কথা, আমার আমি হয়ে ওঠবার পেছনের যে গল্প সেটাই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। বইটির গল্পটি হচ্ছে, ১৪ মে ১৯৭১ শুক্রবার, গাজীপুরের বাড়িয়া নামক একটি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম এলাই বিলের পানিতে থইথই করছে। জুম্মার নামাজের পর হঠাৎ করেই পাকিস্তানি হানাদাররা আক্রমণ করে বসে। সেই সময় পুরো গ্রামবাসীর ওপর আক্রমণ চালায়। একসঙ্গে শত শত বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়,মানুষগুলোকে ঘরে বন্দী করে ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়, মানুষগুলো পুড়ে ছারখার। তাদের চার ঘণ্টার আক্রমণে প্রায় তিনশত মানুষ হত্যা করে তারা৷ কয়েকজনকে একসঙ্গে দাঁড় করে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হয়। সায়রা খাতুন নামে একজন মা ছিলেন যার চারটা সন্তানই ছোট৷ একজনকে বুকের মধ্যে, একজন হাত ধরে আর
একজন পেছনে ছুটছে। বেলাই বিল পার হয়ে তারা আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছিল কিন্তু নৌকা করে একদল পাকিস্তানি সেনাসদস্য এসে তাদের ঘিরে ধরে৷ সায়রা খাতুনের শিশু সন্তানটি তখন স্তন পানরত অবস্থায় ছিল। এরকম যে হানাদার বাহিনী দেখলেই পানিতে ডুব দিবে। কিন্তু স্তন পানরত অবস্থায়ই শিশুটিসহ মাকে গুলিবিদ্ধ করে । আমরা সবাই জানি, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ নারী পুরুষ শহীদ হয়েছেন ও বিভিন্ন জায়গা নিয়ে অনেক ইতিহাস আছে। কিন্তু গাজীপুরের বাড়িয়া একটি
প্রত্যন্ত গ্রাম, বেলাই বিল দ্বারা বেষ্টিত এটি। এখানে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে কিন্তু এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কোথাও লেখা নেই৷ তাই আমি ঠিক করি এই অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। এর জন্য আমাকে বারবার এখানে যেতে হয়েছে। এই বিষয়টিই আমাকে উদ্ধুদ্ধ করেছিল।
বইচারিতা কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার পেলেন। কেমন লাগছে?
ইজাজ আহমেদ মিলন: আমার লেখালেখিটা শুরু একদম ছোট বেলায়। ২০০৯ সালে বের হয় প্রথম
কাব্যগ্রন্থ ‘ নষ্ট শরীর ভিজেনা রৌদ্রজলে ‘। আর কালি ও কলমের যাত্রা শুরু হয় ২০০৮ সালে। আমি আমার প্রথম বইটাই জমা দিয়েছিলাম। ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরই একটা করে বই বেরিয়েছে এবং আমি ওগুলো জমা দিয়েছি। এবারে এসে প্রাপ্তি ধরা দিয়েছে। লুভা নাহিদ চৌধুরী প্রথম যেদিন ফোন করে জানিয়েছিলেন যে আমার নাম লুভা নাহিদ চৌধুরী, আমি বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে বলছি। তখন সালাম দিয়ে বললাম আপা, আপা আমাকে কংগ্রাচুলেশন জানালেন, আমি দুই মিনিট কোনো কথাই বলতে পারলাম না। এটা আমার জন্য অন্য রকম একটা পাওয়া।
বইচারিতা মুক্তিযুদ্ধ তো বাঙালির জন্য ব্যাপক জাগরণের একটি জায়গা। এই বিষয়টি নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী? ভবিষ্যৎ এ মুক্তিযুদ্ধ বিষয় নিয়ে কী করতে চান?
ইজাজ আহমেদ মিলন: আমি ইতিমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশকিছু কাজ করেছি। বজলুর রহমান স্মৃতিপদক পেয়েছি দু’বার, সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার, বিজয়ের গল্প সেরা লেখক পুরস্কার পেয়েছি। আমি আরও একটা কাজ শুরু করে দিয়েছি। আগরতলা মামলার ১৪ নম্বর আসামী ছিলেন সুবেদার আব্দুর রাজ্জাক। তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, ৬৫ এর পাকিস্তান–ভারত যুদ্ধে সরাসরি অংশ গ্রহণ করেছেন । ৬৮ সালে আগরতলা মামলার আসামী হয়েছেন। ওই মামলার প্রধান আসামী ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমান। সুবেদার রাজ্জাক মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। অথচ তার কাজ ও রাজনীতি নিয়ে তেমন কোনো কাজ হয় নি। দায়িত্বের জায়গা থেকে সুবেদার রাজ্জাককে নিয়ে ঢাউস একটি বই লিখেছি। অন্যপ্রকাশ থেকে বইটি বের হবে খুব শিগগিরই।

বইচারিতা নতুন যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখছে বা যারা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে লেখালেখিতে তেমন ভালো কিছু করতে পারছে না তাদের নিয়ে আপনার অভিমত কী?
ইজাজ আহমেদ মিলন: একসাথে তো দুইটা কাজ করতে পারব না আমরা। একই সঙ্গে এক হাতে গাছে ওঠা আরেক হাতে মাছ ধরা যাবে না। যেকোনো একটা কাজ করতে হবে এবং তা সম্পূর্ণ
মনোযোগ আর সময় দিয়ে করতে হবে। কালি ও কলম পুরস্কার শুরু হওয়া থেকে প্রতিবছর আমি একটা করে বই জমা দিয়েছি, প্রতিবারই দেখেছি হয় নি। এতগুলো বছর আমি লেগে থেকেছি যার ফলে আজকের এই পুরস্কার পেয়েছি। আমার ‘১৯৭১: বিধ্বস্ত বাড়িয়ায় শুধুই লাশ এবং ‘ বইটি লেখার জন্য দীর্ঘ সময় গ্রামে অবস্থান করে অনুসন্ধান করতে হয়েছে আমাকে।
বইচারিতা : আপনাকে বইচারিতায় পক্ষে অসংখ্য ধন্যবাদ। অভিনন্দন। আপনার পথচলার সাফল্যতা কামনা করি।
ইজাজ আহমেদ মিলন: আপনাদের ধন্যবাদ।