যা করব বলে ভেবেছি তাই-ই করতাম : সেলিনা হোসেন

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন এর ৭৫তম উপলক্ষ্যে বইচারিতায় তিনদিন ব্যাপী তিন পর্বের বিশেষ সাক্ষাৎকার। আজ শেষ পর্ব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রকাশক ও লেখক মজিবর রহমান খোকা।
মজিবর রহমান খোকা : আপনি তো ১১৬ টি গ্রন্থ রচনা করেছেন তার মধ্যে ৪৪ টি উপন্যাস। এই ৪৪টি উপন্যাসের বিষয়বস্তু কি সামাজিক, রাজনৈতিক, দ্বন্দ্ব-সংঘাত বিভিন্ন কিছু নিয়ে নাকি সবগুলোর বিষয়বস্তুর মধ্যে একটা সমন্বয় আছে?
সেলিনা হোসেন : আমি তো নানাভাবে লিখেছি যেমন— ‘মগ্ন চৈতন্যে শিস’ সাইকোলজিক্যাল উপন্যাস। সেখানে কোনো রাজনীতি নেই। ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ যে উপন্যাস এটি পশ্চিমবঙ্গের ১১ টা ইউনিভার্সিটিতে পাঠ্য, আমি খুবই বিস্মিত যে বইটা এত গভীরভাবে ওদের কাছে গেছে। যাদবপুরের তিনটা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য, রবীন্দ্র-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য— এরকম বিভিন্ন জেলায় পাঠ্য। আমি তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ এটা এত পাঠ্য কেন? তাঁরা বলেছেন, আমরা তো বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ পড়াই, আপনার উপন্যাস হলো কনটেমপোরারি লিটারেচার চর্যাপদের উপরে রচিত। চর্যাপদের বড় কবি কাহ্নপাদ আমার উপন্যাসেও সেই কাহ্নপাদ। তারা কনটেমপোরারি লিটারেচার এভাবে ব্যাখ্যা করেছে যে আমি ভাষা আন্দোলন থেকে ২৫ মার্চ দেখিয়েছি সেখানে কাহ্নপাদ বলছে ‘একদিন আমাদের দেশটা আমাদেরই হবে, কেউ আমাদের শাসন করতে পারবে না, আমাদের ভাষা আমাদের রাজ দরবারের ভাষা হবে যার জন্য জেল খাটতে হবে না।’ সেখানে রাজা কাহ্নপাদকে ডেকে তার নিজের জন্য কবিতা লিখতে বলছে, কাহ্নপাদ বলছে আমি তো আপনাদে চিনি, আমি আমার দেশের মানুষদের নিয়ে লিখবো। রাজা শাস্তি হিসেবে তার দুটো হায় কেটে দিয়েছে। এজন্য তারা বলছে এটা ভাষা আন্দোলনের প্রতীক। তারপরে তাদের এলাকায় এসে আগুন দিয়েছে যেটাকে মার্চের গণহত্যা বলছে। লোকজন কাহ্নপাদকে কাঁধে তুলে নিয়ে পাহাড়ের দিকে লুকাচ্ছে যে তাকে আমরা চাই, তাকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে যেটা বঙ্গবন্ধুর বিকল্প চরিত্র।
মজিবর রহমান খোকা : আপনি আপনার উপন্যাসে ভবিষ্যৎ ‘এ কী হবে’ সে বিষয়টি বলে দিচ্ছেন। এই যে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার, তা কী একজন লেখকের জন্য জরুরি? কী মনে হয় আপনার?
সেলিনা হোসেন : সব সময় জরুরি না। যদি তেমন কোনো প্রেক্ষাপটে লেখা হয় তাহলে মনস্তাত্ত্বিক চিন্তার উপর ধারণা করে তা বলে দিতে হবে।
মজিবর রহমান খোকা : গায়ত্রী সন্ধ্যা নামে একটি ট্রিলজি ১৯৯৪ সালে প্রথম খণ্ড, ১৯৯৫ সালে দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯৯৬ সালে তৃতীয়খণ্ড বের করেন। এই বইটা লেখার জন্য আপনি ফোর্ট ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ পেয়েছেন। এই জায়গাটা যদি একটু বলতেন।
সেলিনা হোসেন : ফেলোশিপ দেয়ার জন্য ইন্ডিয়ার এক ভদ্রলোক পাঞ্জাবের থেকে এসেছেন, বাংলা একাডেমিতে ফোকলোর বিষয়ে উনি কিছু কাজ করতেন। একদিন বললেন, আমি তো মাঝেমাঝেই আসি, আপনাকেই দেখতে পাই চেয়ারে কাজ করছেন। অন্যদের এখানে ওখানে খুঁজতে হয়। তো আমি একাডেমিতে যুক্ত হওয়ার পরে গিটার বাজানো, অভিনয় এসব ছেড়ে দিয়ে লেখালেখিতেই মনোযোগ দেই। যখনই কোন মিটিং বা কাজ থাকত না আমি লেখালেখি করতাম। অন্যরা ক্যান্টিনে চা খেতো, আড্ডা দিতে যেতো। আমি যেতাম না। এইসব কারণে ভদ্রলোক বললেন এই ফেলোশিপটা তো আমরা ইন্ডিয়াতে অনেক দেই এবার বাংলাদেশে দিব। আপনাকে তার জন্য অফিস থেকে ছুটি নিতে হবে৷ আমি তো মহা খুশি আমার বেতনের চেয়ে এই স্কলারশিপটা জরুরি ছিল। আমি মন্ত্রণালয় থেকে ছুটি নিলাম। এটা লেখার জন্য অনেকদিনের পরিকল্পনা ছিল। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত রাজনৈতিক, সামাজিক যা কিছু ঘটেছে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পর্যন্ত সবকিছু লিখেছি। এটা রবীন্দ্র-ভারতী, আসামসহ ইন্ডিয়ার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা পাঠ্য। পরে ‘আগস্টের এক রাত’ নামক উপন্যাস লিখেছি। তখন এটর্নি জেনারেল ছিলেন মাহবুবুল আলম। একটা অনুষ্ঠানে আমাকে দেখে বললেন, আমার কাছে বঙ্গবন্ধুর রাজসাক্ষী যারা ছিলেন তাদের পুরো জবানবন্দি আছে ৮০০ পৃষ্ঠার, এটা আমি আপনাকে দিতে চাই। আপনি এটা নিয়ে একটা উপন্যাস করবেন, হাইকোর্টে আসবেন৷ আমি আর আমার হাসবেন্ড হাইকোর্টে গেলাম। তিনি জবানবন্দি ফটোকপি করে রেখেছিলেন, তা আমাকে দিয়ে দিলেন। আমি সেখান থেকে ছোট করে জবানবন্দিগুলো হুবহু বইয়ে দিয়েছি৷ এভাবে আঙ্গিকগত দিক থেকে এই কাজটা করেছি।
‘নীল ময়ূরের যৌবন’ যে উপন্যাস এটি পশ্চিমবঙ্গের ১১ টা ইউনিভার্সিটিতে পাঠ্য, আমি খুবই বিস্মিত যে বইটা এত গভীরভাবে ওদের কাছে গেছে। যাদবপুরের তিনটা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য, রবীন্দ্র-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য— এরকম বিভিন্ন জেলায় পাঠ্য। আমি তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ এটা এত পাঠ্য কেন? তাঁরা বলেছেন, আমরা তো বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ পড়াই, আপনার উপন্যাস হলো কনটেমপোরারি লিটারেচার চর্যাপদের উপরে রচিত। চর্যাপদের বড় কবি কাহ্নপাদ আমার উপন্যাসেও সেই কাহ্নপাদ। তারা কনটেমপোরারি লিটারেচার এভাবে ব্যাখ্যা করেছে যে আমি ভাষা আন্দোলন থেকে ২৫ মার্চ দেখিয়েছি সেখানে কাহ্নপাদ বলছে ‘একদিন আমাদের দেশটা আমাদেরই হবে, কেউ আমাদের শাসন করতে পারবে না, আমাদের ভাষা আমাদের রাজ দরবারের ভাষা হবে যার জন্য জেল খাটতে হবে না।’ সেখানে রাজা কাহ্নপাদকে ডেকে তার নিজের জন্য কবিতা লিখতে বলছে, কাহ্নপাদ বলছে আমি তো আপনাদে চিনি, আমি আমার দেশের মানুষদের নিয়ে লিখবো। রাজা শাস্তি হিসেবে তার দুটো হায় কেটে দিয়েছে। এজন্য তারা বলছে এটা ভাষা আন্দোলনের প্রতীক। তারপরে তাদের এলাকায় এসে আগুন দিয়েছে যেটাকে মার্চের গণহত্যা বলছে। লোকজন কাহ্নপাদকে কাঁধে তুলে নিয়ে পাহাড়ের দিকে লুকাচ্ছে যে তাকে আমরা চাই, তাকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে যেটা বঙ্গবন্ধুর বিকল্প চরিত্র।
মজিবর রহমান খোকা : আপনি গল্পের বই লিখেছেন ১৬ টি, শিশুসাহিত্য লিখেছেন ৪১ টি। আপনার গল্পের যে বিষয়বস্তুগুলো তা থেকে আবার উপন্যাসের বিষয়বস্তু ভিন্ন, আবার শিশুসাহিত্যের বিষয়বস্তুও ভিন্ন। এই যে সময়ের বিবর্তনের সাথে রাজনীতি, পারিবারিক, সামাজিক পরিবর্তন ঘটছে তা আপনি উপন্যাস, গল্প, কবিতা এসবে কীভাবে সম্বন্বয় করেছেন? দেশের সার্বিক অবস্থায় যে মৌলবাদের উত্থান ঘটছে তাতে স্বাধীনভাবে লেখার স্বাধীনতা আগের মত পান কি না? এই বিবর্তনকে কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
সেলিনা হোসেন : লেখায় যিনি বিবর্তন আনতে চাইবেন তার সাহসটা সবচেয়ে জরুরি বিষয়। এটা করব, না করব না, এত চিন্তা করে পিছিয়ে যাওয়া যাবে না৷ আমি কখনো করতাম না, যা করব বলে ভেবেছি তাই-ই করতাম, সেটা আমার বিষয়, আমি করবই।
মজিবর রহমান খোকা : লেখার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের যে বৈষম্য আপনি কি এই বৈষম্যটা লেখালেখিতে ফেস করেছিলে?
সেলিনা হোসেন : না, আমি ওসব একদম ফেস করিনি। ১৯৬৪ সালে গল্পটা লেখার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থাতেই দশ-বারোটা গল্প লিখে ফেলেছি। আমি কিছুই ফেস করিনি ওসবের।
মজিবর রহমান খোকা : আপনি ৫৫ বছর ধরে লেখালেখি শীর্ষস্থানীয় জায়গায় আছেন, এত দীর্ঘ সময় কী করে সেই জায়গাটা ধরে রাখতে পেরেছেন। এর পেছনে কোনো বিষয় বা যুক্তি থাকতে পারে বলে মনে হয়?
সেলিনা হোসেন : আমি মনে করি এগুলো আমার ভেতরের একটি বিষয়। সব সময় আমার মনে হত এটা করলে ভালো হত, ওটা করতে হবে, এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা যায়। গায়েত্রী সন্ধ্যা লিখতে আমাকে ফেলেশিপের আগে ১০ বছর কাজ করতে হয়েছে। আমি লেখার আগে সেসব জায়গাগুলো দেখে আসি, মানুষজনের সঙ্গে কথা বলি, তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার কথা শুনি, জীবন বোধ দেখি৷ নইলে আমি যা বর্ণনা করব তা সব সময় সঠিক, প্রাণবন্ত হবে না। বানাতে গেলে, নিজের কল্পনা থেকে লিখলে— লোকে বেশি পছন্দ করবে না। আমি মনে করি, মানুষ আমার লেখা এই কারণেই পছন্দ করে । যেমন- ভূমি ও কুসুম ছিট মহলের উপর লিখেছি যা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৫ সালে ছিট মহল নিয়ে চলমান সম্যসার সমাধান করেন। আমি ২০০৩ সালে লালমনিরহাটের দহগ্রাম আঙ্গুরপোতায় গিয়েছি। সেখানে গিয়ে দেখে এসেছি। তারপর এটা লিখেছি। ছিট মহলে নিয়ে এটাই প্রথম উপন্যাস। লেখার ক্ষেত্রে সব সময় চিন্তা করি, বিষয়ে বৈচিত্র্য আনি। লেখার আগে সে সব পরিবেশ, প্রকৃতি, মানুষ, জনজীবন দেখে আসি।
মজিবর রহমান খোকা : সর্বশেষ বর্তমান সময়ের নতুন অনেকেই গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ লিখছেন। আমরা জানি ও দেখেছি আপনি প্রচুর পড়াশোনা ও জ্ঞান আহরণ করে তবেই লেখার কাজে হাত দেন। কিন্তু নতুন অনেকেই হয়তো দু-চারটা ধারণা নিয়েই লিখছেন— বই প্রকাশ করছে, তাদের তেমন কোনো প্রস্তুতি থাকে না, তাদের জন্য আপনার মতামত কী?
সেলিনা হোসেন : এক্ষেত্রে দুটো বিষয় লাগবে—
১. নিজের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করা। জীবনের চারদিককে খোলা চোখে দেখে সেসব জায়গা থেকে গল্পের পটভূমি বের করে আনা।
২. দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বই পড়া। একটা লেখা লেখার আগে সেসব নিয়ে কে কী লিখেছে তা জেনে নিতে হবে আগে। আমি ছিটমহল লেখার আগে ইংরেজি গবেষণার বই পড়েছি। এরকমভাবে নিজের চেতনাবোধ, সৃজনশীলতার সহযোগে তথ্য সমৃদ্ধ হয়ে কাজটা করতে হবে।
মজিবর রহমান খোকা : আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আপা আমাদেরকে এত সময় দেওয়ার জন্য। আপনার এই সমৃদ্ধ কথা, কাজ, আলোচনা আমাদের বিশেষ কাজে লাগবে। আপনি ৫৫ বছর হয়েছে লিখছেন, আমরা চাই আপনি আরো লিখুন। আপনার লেখনীর মধ্য দিয়ে যে আধুনিক চেতনা প্রদান করে যাচ্ছেন তা অব্যাহত থাক।
সেলিনা হোসেন : ধন্যবাদ আপনাকেও।
আারও পড়ুন :
প্রথম পর্ব : ছোটবেলায় ক্রিয়েটিভ ব্যাপারটা আমাকে উদ্ধুদ্ধ করেছিল : কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন
দ্বিতীয় পর্ব : আমাদের অনুবাদের জায়গাটা এখনো সুন্দর নয়, বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারের জন্য অনুবাদ অধিদপ্তর খুলার দরকার
অনুলিখন করেন রাজিয়া সুলতানা ঈশিতা।