‘লেখালেখির জন্য একজন তরুণকে চ্যালেঞ্জ নিতে হবে’

কালি ও কলম তরুণ সাহিত্য পুরস্কার ২০২০, গত ৯ জুন ঘোষণা করা হয়। এবারে কথাসাহিত্যে পুরস্কার পাচ্ছেন মোজাফফর হোসেন। তাঁকে ‘তিমিরযাত্রা’ উপন্যাসের জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। উপন্যাসটি ২০২০ সালের অমর একুশে বইমেলায় পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড থেকে প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অবক্ষয়, মানুষের পাওয়া না-পাওয়ার চিত্র উঠে এসেছে উপন্যাসটিতে। মোজাফফর হোসেন ১৯৮৬ সালে মেহেরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। সাংবাদিকতা দিয়ে পেশা জীবন শুরু করলেও বর্তমানে তিনি বাংলা একাডেমিতে অনুবাদ-কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। মূলত ছোটগল্পকার তিনি। বিশেষ আগ্রহ অনুবাদ এবং সমালোচনা সাহিত্যে। অতীত একটা ভিনদেশ গল্পগ্রন্থের জন্য তিনি এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ কথাসাহিত্য পুরস্কার-২০১৭, মিডিয়া ভার্সেস নোবডি গল্পের জন্য বৈশাখি টেলিভিশন তোমার গল্পে সবার ঈদ-২০১৩, ‘পুনরুত্থান’ গল্পের জন্য অরণি ছোটগল্প পুরস্কার-২০১৩ এবং ‘স্বাধীন দেশের পরাধীন মানুষেরা’ গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপির জন্য ‘আবুল হাসান সাহিত্য পুরস্কার ২০১৮’তে ভূষিত হন।
বইচারিতায় কথাসাহিত্যিক মোজাফফর হোসেনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজিয়া সুলতানা ঈশিতা।
রাজিয়া সুলতানা ঈশিতা : আপনি তো লেখালেখি করছেন, কিছু পুরস্কারও অর্জন করেছেন। এই লেখালেখির শুরু কীভাবে? সাহিত্যের জগতে প্রবেশের শুরুটা কেমন ছিলো?
মোজাফ্ফর হোসেন : লেখালেখির শুরুটা স্কুলে থাকতেই। কিন্তু সেটা আড়াল করে ডাইরি লেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। উচ্চমাধ্যমিকে এসে বিষয়টি আর গোপন থাকেনি। তখন বৃহত্তর যশোরের আঞ্চলিক পত্রপত্রিকায় কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। কিন্তু সাহিত্যজগতে প্রবেশ বলতে আপনি যেটা বোঝাতে চাচ্ছেন সেটি ঘটে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। আমি তখন কবিতা ছেড়ে গল্প লিখতে শুরু করি। শাশ্বতিকী নামে একটি সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনা করি রাবির ক্যাম্পাস থেকে। সেই শুরু, লেখালেখি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো চিন্তা আর মাথায় আসেনি। সেই অর্থে আমার শুরুটা ছিল পরিকল্পিত। জেনেবুঝে লিখতে এসেছি। সাহিত্যের যে রাজনীতি বা লিটারারি সংষ্কৃতি সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। আমি ছিলাম এই জগতে আগন্তুকের মতো। ফলে এই জগত থেকে আমার কোনো প্রত্যাশা ছিল না। লিখতে লিখতে আজ হয়ত পুরস্কারের প্রসঙ্গ আসছে, কিন্তু আমি যখন লিখতে শুরু করি তখন দেশের কোনো পুরস্কারের নাম আমার জানা ছিল না। আমি সব সময় নিজের লেখাটাই লিখতে চেয়েছি। এই কারণে বরঞ্চ শুরুর দিকের চেয়ে এখন লেখাটা বেশি চ্যালেঞ্জিং মনে হয়। কারণ প্রতি মুহূর্তে লেখাটা কঠিন হয়ে ওঠে। লিখতে লিখতে লেখা সহজ হয়ে যায়, এই কথাটা মিথ ছাড়া আর কিছু না।
বইচারিতা : প্রথম উপন্যাস তিমিরযাত্রা কবে লিখতে শুরু করেন? কোন বিষয়বস্তুর উপর এটি গড়ে উঠেছে?
মোজাফফর হোসেন : উপন্যাসটি আমি লিখি ২০১৮-১৯ সালে। কিন্তু গল্পটা দীর্ঘদিন ধরে মাথার মধ্যে ছিল। আমি সাধারণত গল্প আগে থেকে ভেবে নিয়ে লিখতে স্বচ্ছন্দবোধ করি না। কিন্তু উপন্যাসের ক্ষেত্রে আমি একটু একটু করে গল্পটা তৈরি করেছি নিজের মধ্যে, তার সঙ্গে যাপন করেছি। একটা সময় এসে মনে হয়েছে আমি গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে গেছি। কেন্দ্রীয় চরিত্রের যে আবেগ সেটা আমার আবেগ হয়ে উঠেছে। ফলে লেখার আগে আবার আমাকে গল্পের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করতে হয়েছে। যখন গল্প থেকে বের হতে পেরেছি বলে মনে হয়েছে, তখনই লিখতে শুরু করেছি। উপন্যাসের বিষয় হলো অস্তিত্বের অন্বেষণ। উপন্যাসের তিনটি চরিত্রই মুক্তিযুদ্ধের সৃষ্টি। তারা কেউ সুস্থ নন। যুদ্ধ তাদের শরীরে-মনে যে ক্ষত তৈরি করেছে সেই ক্ষতের সঙ্গে বাংলাদেশের শরীরে যে ক্ষত সেটা মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি। এর বেশি আর বলতে চাই না।
বইচারিতা : এই উপন্যাসের জন্য এবার কালি ও কলম পুরস্কার পেতে যাচ্ছেন, কেমন লাগছে?
মোজাফফর হোসেন : পুরস্কার নিশ্চয় প্রাণিত করে। কিন্তু লেখালেখির এমন একটা পযায়ে এসেছি যেখানে লেখালেখিটা আর সখ হিসেবে নেই, অস্তিত্বের অংশ হয়ে উঠেছে। এখন আমি আর আমার লেখকসত্তা থেকে নিজেকে আলাদা করে ভাবতে পারি না। এই কারণে পুরস্কার যে উদ্দিপনা দেয়, সেটা সাময়িক, কদিন পর আর মনে থাকবে না। নতুন লেখার যে চ্যালেঞ্জ সেখানে শতভাগ সমর্পণ ছাড়া উত্তরণের কোনো পথ নেই। আর সত্যিকার সমর্পণ তখনই হয় যখন সমস্ত জাগতিক অর্জন দূরে সরে যায়। তবে নিঃসন্দেহে, পুরস্কারের বিষয়টি খুব ইতিবাচক ভাবে দেখি। এর সঙ্গে শুধু লেখক না, অনেক অনেক বিষয় জড়িত। বই একটি পণ্যও, বইয়ের স্বীকৃতি ও প্রচারের প্রয়োজন আছে। একজন শিল্পী হাওয়া-বাতাস খেয়ে বেঁচে থাকতে পারেন না, বৈষয়িক সমাজ তাকে একচুলও ছাড় দেয় না। তাই এটার প্রয়োজনকে চাইলেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু এটাও ঠিক, কোনো পুরস্কার লেখককে ভালো লিখতে একচুলও সহযোগিতা করে না। কোনো লেখক যখন ভালো লেখেন বলে মনে করেন বিচারকরা তখন তাকে এটা দেওয়া হয়, তার মানে লেখক তৈরির পেছনেও এর ততোটা ভূমিকা নেই। কিন্তু এটা গেল প্রত্যক্ষ বিষয়। পরোক্ষভাবে সাহিত্যকে ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে দাঁড় করাতে, এটাকে সাধারণ মানুষের কাছে পপুলার করে তুলতে পুরস্কার সংষ্কৃতির প্রয়োজন আছে। নোবেল-বুকার এগুলো না থাকলে কোনো লেখকের যতটা না ক্ষতি হতো, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হতো সাহিত্যের। সাহিত্য তখন আরো গৌনশিল্প হয়ে উঠত মার্কেটিংয়ের ভাষায়। লেখক এবং সমগ্র সাহিত্যের সামাজিক অবস্থা সদৃঢ় হয় এসব পুরস্কারের মধ্য দিয়ে। কিন্তু, আমি পুণরায় বলছি, এর সঙ্গে আর্টের শ্রীবৃদ্ধির কোনো সম্পর্ক নেই।
এবার নিজের অনুভূতির কথা বলি: আমার সাহিত্যে বেড়ে ওঠার সময় কালি ও কলম পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তখন থেকেই এই পুরস্কারের নাম জেনেছি। আজ নিজের নামটি যখন এর সঙ্গে জড়িয়ে যেতে দেখছি তখন নিশ্চিত করেই ভালো লাগছে।
বইচারিতা : লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষৎ পরিকল্পনা কী?
মোজাফফর হোসেন: এক্ষেত্রে আমার দূরবর্তী কোনো পরিকল্পনা নেই। প্রতি মুহূর্তে লিখে যাওয়াটার দিকে মনোযোগ দিচ্ছি। যখন যে লেখা লিখি তখন মনে হয় সেটিই হতে পারে আমার গুরুত্বপূর্ণ লেখা। অথবা হতে পারে, কোনো পাঠক আমার এই একটি মাত্র লেখাই পড়বেন। আর কোনো লেখা তার কাছে পৌঁছাবে না। ফলে আমার সকল পরিকল্পনা থাকে বর্তমান লেখাটি ঘিরে। তবে ভবিষ্যতে উপন্যাসে নিয়মিত হওয়ার চেষ্টা থাকবে।
বইচারিতা : তরুণ লেখকদের উদ্দেশ্যে কী বলতে চান? তাদের লেখালেখি নিয়ে আপনার মতামত কী?
মোজাফফর হোসেন : লেখালেখি কোনো সখের বিষয় নয় এবং লিখে বিরাট কিছু অর্জন হয়ে যাবে তাও না। একজন তরুণ যদি মনে করেন তিনি চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত আছেন, তাহলেই তার এই জগতে আসা উচিত। কিংব লিখতে এসে কেউ যদি দ্বিতীয় অপশন রাখে তাহলে তার সেদিকেই চলে যাওয়া উচিত। শিল্পীজীবনের দ্বিতীয় কোনো অপশন থাকে না। আর লেখার বিষয় ও ধরন নিয়ে বলব, সাহিত্যের সম্ভাবনা অসীম, আপনি যেভাবে লিখবেন সেটিই আপনার স্টাইল। প্রচুর পঠনপাঠনের পাশাপাশি নিজের নিজস্বতার যত্ন নিতে হবে। মনে করতে হবে, অন্য কোরো নয়, , নিজের লেখাটিই লিখতে এসেছি।
বইচারিতা : আপনাকে ধন্যবাদ
মোজাফফর হোসেন : বইচারিতাকেও ধন্যবাদ
1 thought on “‘লেখালেখির জন্য একজন তরুণকে চ্যালেঞ্জ নিতে হবে’”