জীবনের সমস্ত শিক্ষককে আমি প্রণাম করি

প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যাঁরা শিক্ষক হিসেবে চিহ্নিত, ছাত্র হিসেবে চিহ্নিত— এই হিসাবটা অনেক সময় ঠিক থাকে না। শিক্ষক তকমা পাবার পরেও আমরা ছাত্রদের কাছ থেকে শিখি। ফলে কখনো ছাত্ররা শিক্ষক হয়ে ওঠে এটাও একটা মজার ব্যাপার। আর তাছাড়া প্রতিষ্ঠানের বাইরেও আমরা শিখি তার তুলনা নেই। আমরা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, শিখছি। আমরা সেলাই করি, যাকে আমরা মুচি বলি তার কাছেও শিখি—কীভাবে কাজ করতে হয়।
ধামরাইয়ের শিক্ষকদের কথা আমার মনে আছে। এক মৌলবী সাহেব আমাকে বলেছিলেন, পূজোর সময় আমার বাড়িতে যাবি, খেজুরের রস আর মাছ খাওয়াব। সেই সময়ে দেশভাগের উত্তেজনা চলছিল। তখন আমি বললাম, ‘না মৌলবীসাব, আপনার লগে গেলে মুসলমানেরা আমারে কাইট্টা ফালাইব’। এই কথা বলাতে মৌলবী সাহেব স্তব্ধ হয়ে গেলেন এবং চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। আর বললেন ‘তুই আমারে এতবড় একটা কথা কইলি’ এবং নিজেই বলল, ‘হায় আল্লাহ, দেশটারে দুই টুকরো কইরা ফেলল’। তার দুই চোখের জল আমি এখনো ভুলতে পারিনি।
প্রতিষ্ঠানের ভেতরেও যেমন শিখেছি,প্রতিষ্ঠানের বাইরেও তেমন শিখেছি। ছাত্র হয়ে শিক্ষকদের কাছে শিখেছি, শিক্ষক হয়ে ছাত্রদের কাছ থেকে শিখেছি। আমাকে প্রথম শিশু অবস্থায় লেখাপড়ার মধ্যে আনেন আমার শিক্ষক অমূল্য আচার্য। পড়া না পারলে, পড়া না করে ঘুমিয়ে গেলে তিনি আমাকে মারতেন, কিন্তু মারতে মারতে বইয়ের প্রতি একটা ভালোবাসা তিনি আমাকে জন্মিয়ে দিয়েছিলেন ছয়-সাত বছর থেকেই। ধামরাইয়ের শিক্ষকদের কথা আমার মনে আছে। এক মৌলবী সাহেব আমাকে বলেছিলেন, পূজোর সময় আমার বাড়িতে যাবি, খেজুরের রস আর মাছ খাওয়াব। সেই সময়ে দেশভাগের উত্তেজনা চলছিল। তখন আমি বললাম, ‘না মৌলবীসাব, আপনার লগে গেলে মুসলমানেরা আমারে কাইট্টা ফালাইব’। এই কথা বলাতে মৌলবী সাহেব স্তব্ধ হয়ে গেলেন এবং চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। আর বললেন ‘তুই আমারে এতবড় একটা কথা কইলি’ এবং নিজেই বলল, ‘হায় আল্লাহ, দেশটারে দুই টুকরো কইরা ফেলল’। তার দুই চোখের জল আমি এখনো ভুলতে পারিনি। চোখের জলও আমাকে একটা শিক্ষা দিয়েছিল। কলেজ জীবনেও শিক্ষকেরা ছিলেন, বিশেষ করে বলব বিএ ক্লাসে জগদীশ ভট্টাচার্য, এম এ ক্লাসে প্রমথনাথ নিশি এবং নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা। এদের কথা সবাই জানেন।
প্রমথনাথ নিশি আমাদের বুঝতে দিতেন না যে আমাদের ভালোবাসেন।তিনি ছিলেন রাজনৈতিকভাবে বিপরীত মেরুতে, তিনি কংগ্রেস করতেন। এদের ঘাড় একটু ত্যাড়া থাকে। কিন্তু যখন পরীক্ষা হলো ৫০ এর মধ্যে ৪৫ দিয়েছে তখন পরের বছরের ছেলেমেয়েরা জিজ্ঞেস করে এত নম্বর কি করে দিলেন? এখন ৯৮-৯৯ নম্বার পাওয়া কিছু নয় কিন্তু তখন সাংঘাতিক ব্যাপার। তিনি তখন বললেন, পাঁচটা নম্বর তো আমি হাতে রেখে দিয়েছি।
প্রমথনাথ নিশি আমাদের বুঝতে দিতেন না যে আমাদের ভালোবাসেন।তিনি ছিলেন রাজনৈতিকভাবে বিপরীত মেরুতে, তিনি কংগ্রেস করতেন। এদের ঘাড় একটু ত্যাড়া থাকে। কিন্তু যখন পরীক্ষা হলো ৫০ এর মধ্যে ৪৫ দিয়েছে তখন পরের বছরের ছেলেমেয়েরা জিজ্ঞেস করে এত নম্বর কি করে দিলেন? এখন ৯৮-৯৯ নম্বার পাওয়া কিছু নয় কিন্তু তখন সাংঘাতিক ব্যাপার। তিনি তখন বললেন, পাঁচটা নম্বর তো আমি হাতে রেখে দিয়েছি।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, আমি যখন এমএ ক্লাসে মোটামুটি একটা রেজাল্ট করে তাঁর বাড়িতে এলাম, তিনি নিচে নেমে গেলেন, সঙ্গে একটা হাড়ি নিয়ে এলেন, বললেন এই সময় পাড়াতে গরম রসগোল্লা করে, তুমি খাবে আমার সামনে বসে তারপরে চলে যাবে। তাই শিক্ষকেরা ক্লাসে বসে এবং ক্লাসের বাইরে যে স্নেহ দিয়েছেন, প্রেরণা দিয়েছেন তাদের কথা আমি ভুলতে পারি না। বা বিদেশে যখন পড়ছি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যারিক হ্যাম যিনি আমাদের ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান পড়াতেন, তিনি বাড়িতে পার্টি করতেন। নিজ হাতে বড় বড় পিপে থেকে পানীয় ঢেলে দিতেন, খাবার দিতেন, বলতেন এটা ‘স্পেনীয় খাবার, ভাষা বিজ্ঞানে এই সমস্ত খাবারের কথা জানবে এবং খাও। তার কথাও আমি ভুলতে পারি না। জেমস নেকলে বলে একজন ছিলেন যে তার বাড়িতে হই হই করে গান বাজনা করতেন, আইরিশ গান করতেন। এই মানুষটি হঠাৎ রাস্তায় পড়ে নিশ্চেতন হয়ে গেলেন। এই যে সারা জীবনের শিক্ষকেরা এদের কথা তো অল্প কথায় বলার মত না।
কতজনের কাছে যে শিখেছি সেগুলোর দু-একটা গল্প বলি, আমি যখন জুতো সেলাইয়ের মানুষটির কথা বলেছি, একটা কাজ নিঁখুতভাবে করতে হবে এইটা তার একটা আদর্শ তিনি দেখিয়েছিলেন আমাকে। আমি তখন খেলতে যাব বললেন, ‘রুখো’। পানি দিয়ে পা জুতো ধুয়ে সুতায় তেল মেখে নিখুঁতভাবে সেলাই করে দিলেন, এই যে শিক্ষাটা পরে বুঝেছি।
আমি যখন ৬৩ সালে প্রথম বাইরে যাই, তখন জাপানে এশিয়া হাউসে ভোরবেলায় একটি মেয়ে এলো, এসে আমার বেসিনটা পরিস্কার করল, পাঁচ মিনিটে স্প্রে করে পরিস্কার শেষে আমি ভাবলাম এবার সে চলে যাবে৷ কিন্তু সে এদিক দেখে সেদিক দেখে, দেখে আবার সে স্প্রে করা শুরু করল। আমার মনে হলো পাঁচ মিনিটের সময়েই বেসিনটা পরিস্কার করা হয়ে গেল সেটা সে কুড়ি মিনিটে শেষ করল। এরমধ্যে তার কাজের একটা আদল আছে, পারফেকশন আছে কাজটা কিভাবে ভালোভাবে করতে হয়। আমি তার কাছে শিখলাম এটা৷ তারপর শিকাগোতে আরেকজনের কথা বলি, তখন আমি ফাঁকে ফাঁকে চাকরি করি, কুলি মজুরের চাকরি করি, শিকাগো ল্যাবরেটরি স্কুলে আমি আর্দালির কাজ করি। আর্দালির কাজ মানে হচ্ছে কখনো একটা পিয়ানো খুলে চার তলায় নিয়ে যাওয়া, দাঁড়িয়ে থেকে শিক্ষকদের ক্যান্টিনে কোকাকোলা নিয়ে যাওয়া, দেয়ালে ছেলেমেয়েরা লিখে রাখে সেগুলো পরিস্কার করা, টেবিলের নিচে ওরা চুইনগাম আটকে রাখে—ছুরি দিয়ে সে শক্ত চুইনিগাম কেটে ফেলা- এইসব কাজ। সেখানে একদিন আমার অফিস সুপারিন্টেনডেন্ট একটা রেঞ্জ দিয়ে বললেন তিনতলাতে একটা ইলেকট্রনিক টাইপরাইটার আটকানো আছে, ওটা খুলে নিয়ে আসো। আমি রেঞ্জ দিয়ে চাপ দিলাম, ওটা নড়লো, আবার চাপ দিলাম নড়ল, তখন ৩২ বছরের যুবক গায়ে জোর আছে কিন্তু ওটা খুলতে পারলাম না। নিচে এসে বললাম। তিনি বললেন, তাই নাকি, চলো দেখি। তারপর এসে তিনিও চেষ্টা করলেন, হলো না। তলায় চিৎ হয়ে শুয়ে পরে স্ক্রুতে চাড় দিলো সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেলো। এই যে শেখা, যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক নয়, তাদের কাছেও শিখেছি।
আমি রেঞ্জ দিয়ে চাপ দিলাম, ওটা নড়লো, আবার চাপ দিলাম নড়ল, তখন ৩২ বছরের যুবক গায়ে জোর আছে কিন্তু ওটা খুলতে পারলাম না। নিচে এসে বললাম। তিনি বললেন, তাই নাকি, চলো দেখি। তারপর এসে তিনিও চেষ্টা করলেন, হলো না। তলায় চিৎ হয়ে শুয়ে পরে স্ক্রুতে চাড় দিলো সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেলো। এই যে শেখা, যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক নয়, তাদের কাছেও শিখেছি।
আমি এক সময় নাটক করতাম, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় তিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন নাটকের ব্যাপারটা, কথা বলতে কী করে হয়, গলা কোথায় উঁচু করতে হয় কোথায় নিচু করতে হয়। আমি যে শিক্ষক হয়ে উঠেছি আমি একটা পূর্ববঙ্গের গ্রামের ছেলে, কথায় গ্রামের সুর ছিলো এখনো আছে। আস্তে আস্তে যে প্রমিত বাংলায় কথা বলতে শিখলাম সবই তার জন্য। তিনি আমার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নন, নাটকের শিক্ষক। নাটকে বললেন মুখটা একটু হা করে কথা বলুন। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে আমার বাচনভঙ্গি বদলে গেলো। আমি হা করে পরিস্কারভাবে কথা বললাম। আগে কথা মুখটা ছোট করে কথা বলতাম। সুনির্মল বসুর একটা কবিতা সবাই আমরা ছেলেবেলায় পড়তাম, সবার আমি ছাত্র, আকাশ আমায় শিক্ষা দিলো উদার হতে ভাইরে…..এইরকম শুধু মানুষের কাছে শিখি না, পশুপাখির কাছে শিখি, প্রকৃতির কাছেও শিখি।
রবীন্দ্রনাথ তো প্রকৃতির কাছেও শিখেছিলেন যে কীভাবে মানুষের জীবন অন্তহীন। মৃত্যু হয়, মৃত্যুর পরের আবার জীবন। এই যে জীবনের অন্তত প্রবাহ এই শিক্ষাটা রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির কাছে শিখেছিলেন। আমাদের রোমান্টিক কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ অনেকদিন আগে বলে গেছেন (on in pulse burnal rodu…) মুনি ঋষিরা যা শেখাতে পারে বসন্তের এক ঝলক হাওয়া তার চেয়ে বেশি শেখাতে পারে। এটা তো রূপক কিন্তু সত্যি সত্যি সকলের কাছেই আমরা শিক্ষা নেই। যাদের কাছে শিক্ষা নেবার কথা নয়, হয়ত আমাদের সমাজে তারা পালিয়ে আছে তাদের কাছ থেকেও শিক্ষা নেই। শিক্ষক দিবসে আমি আমার ৮৫ বছর ৬ মাসের জীবনের সমস্ত শিক্ষককে আমি প্রণাম করি। যে শিক্ষককে আমি চিনিও না, হয়তো বাসস্টপে দু’দণ্ড দেখা হয়েছে তার কথা আমার মনে থেকে গেছে, এরকম অনেকে—গাড়ির ড্রাইভার ট্যাক্সি ড্রাইভার অনেক কথা বলেছে যেগুলো মনে থেকে গেছে এমন সমস্ত শিক্ষক প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, শিক্ষয়িত্রী, ছাত্র, সাধারণ মানুষ যাদের কাছে আমি কিছু না কিছু শিখেছি তাদের আমি আজকে প্রণাম জানাই।
পবিত্র সরকার : বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও গবেষক
শ্রুতিলিখন : রাজিয়া সুলতানা ঈশিতা
যাঁরা আমাদের স্বপ্নকে, আমাদের জীবনের পথচলারকে হাত ধরে শিখেছেন, অনুপ্রাণিত করেছেন সর্ব সময়ে, তাঁদের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা। বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে ‘বইচারিতার আয়োজন ‘ স্মৃতিতে আমার প্রিয় শিক্ষাগুরু’। আপনি আপনার প্রিয় শিক্ষককে নিয়ে আমাদের কাছে লিখে পাঠিয়ে দিন। সঙ্গে পাঠাবেন শিক্ষকের ছবি, নিজের ছবি, যদি শিক্ষকের সঙ্গে কোনো ছবি থেকে থাকে। থাকবে সেরা ১০জন লেখকের জন্য থাকবে আকর্ষণীয় বই ও সনদ। লেখা পাঠাবেন: boicharita@gmail.com