স্মৃতিতে শফিউল ইসলাম লিলন স্যার

আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০০১-০২ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী । সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সব শিক্ষকগণ অসাধারণ এবং অসামান্য তবে আজ যার কথা লিখতে বসেছি তিনি আমার প্রিয় শিক্ষক, তবে এ পৃথিবীতে তিনি আর নেই l তিনি রয়েছেন শুধুই স্মৃতিতে । তিনি হলেন ‘ডক্টর শফিউল ইসলাম লিলন’ স্যার । আমরা তাঁকে লিলন স্যার বলেই ডাকতাম l
মাস্টার্সে আমাদের দুইটা অপশনাল কোর্সের মধ্যে একটা বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল; বান্ধবী রোজীর উৎসাহে লিলন স্যারের কোর্সটাই বেছে নিলাম l স্যার যে কোর্সের ক্লাস নিতেন তার নাম ছিল ‘সোসিওলজি অফ ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড আন্ডার ডেভেলপমেন্ট’।
লিলন স্যার ছিলেন জরাজীর্ণ, সংকীর্ণ সমাজ ব্যবস্থার বিপক্ষে । উদারনৈতিক, অগ্রগামী টেকসই উন্নয়নের পক্ষে ছিল তার ব্যক্তিত্ব এবং ক্লাস লেকচার l প্রথম ক্লাসেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম । স্যার অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপন করতেন । বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তাঁর ভেতরে কোনো দিনও বিন্দুমাত্র অহংকার বা ভাবগাম্ভীর্য দেখিনি । গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে স্যার ক্লাসে লেকচার দিতেন
লিলন স্যার ছিলেন জরাজীর্ণ, সংকীর্ণ সমাজ ব্যবস্থার বিপক্ষে । উদারনৈতিক, অগ্রগামী টেকসই উন্নয়নের পক্ষে ছিল তার ব্যক্তিত্ব এবং ক্লাস লেকচার l প্রথম ক্লাসেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম । স্যার অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপন করতেন । বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তাঁর ভেতরে কোনো দিনও বিন্দুমাত্র অহংকার বা ভাবগাম্ভীর্য দেখিনি । গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে স্যার ক্লাসে লেকচার দিতেন। যা আমার খুবই ভালো লাগত । স্যার ক্লাসে কখনো কড়া ভাষায় কথা বলতেন না বরং হেসে হেসে ক্লাসে পড়াতেন । পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে প্রচুর মজার কথা গল্প করতেন। যেহেতু তাঁর কোর্সটা ছিল সমাজের উন্নয়ন এবং অনুন্নয়ন বিষয়ক তাই উন্নয়নের প্রসঙ্গে তিনি উন্নত দেশগুলোর উদাহরণ টানতেন । গবেষণার জন্য স্যার দীর্ঘদিন জাপান ছিলেন তাই মাঝেমধ্যেই জাপানে থাকার কিছু অভিজ্ঞতাও ক্লাসে শেয়ার করতেন ।
একদিন ক্লাসে তিনি বলেছিলেন জাপানিজরা আইনকানুনে খুবই কঠোর তবে তাঁরা ভীষণ প্রকৃতি প্রেমী । স্যার নাকি একদিন শর্টকাট রাস্তা নিতে গিয়ে জাপানের একটা মাঠের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন হঠাৎ একজন পুলিশ তাঁকে থামালেন এবং জিজ্ঞেসা করলেন রাস্তা ছেড়ে তিনি কেন ঘাস মাড়িয়ে যাচ্ছেন? স্যার বলেছিলেন হাতে সময় কম থাকায় শর্টকাট নেয়ার জন্য এদিক দিয়ে যাচ্ছি । পুলিশ তাকে বলেছিলেন শর্টকাট নিতে গিয়ে তিনি ঘাসের জীবন নষ্ট করতে পারেন না এবং সময়ের ব্যাপারে পাংচুয়াল হয়ে তাঁকে রাস্তা দিয়ে যেতে বলা হয়েছিল । স্যার সেদিন বলেছিলেন, দেখেছ, জাপানিজদের কাছে ঘাসের কত মূল্য অথচ আমাদের দেশে মানুষের জীবনের এত মূল্য নেই! আসলেই তাই জাপানিজদের কাছে ঘাসের জীবনের মূল্য রয়েছে বলেই হয়তো তারা মাথা উঁচু করে বিশ্বে অবস্থান করছে!
পুলিশ তাকে বলেছিলেন শর্টকাট নিতে গিয়ে তিনি ঘাসের জীবন নষ্ট করতে পারেন না এবং সময়ের ব্যাপারে পাংচুয়াল হয়ে তাঁকে রাস্তা দিয়ে যেতে বলা হয়েছিল । স্যার সেদিন বলেছিলেন, দেখেছ, জাপানিজদের কাছে ঘাসের কত মূল্য অথচ আমাদের দেশে মানুষের জীবনের এত মূল্য নেই! আসলেই তাই জাপানিজদের কাছে ঘাসের জীবনের মূল্য রয়েছে বলেই হয়তো তারা মাথা উঁচু করে বিশ্বে অবস্থান করছে!
স্যার আরও বলেছিলেন একদিন তিনি একজন জাপানি বৃদ্ধাকে বাসে উঠতে সহযোগিতা করতে গিয়েছিলেন, বৃদ্ধ মহিলার হাতে ছিল কয়েকটা ব্যাগ, স্যার ভেবেছিলো সাহায্য পেলে তিনি হয়তো খুশি হবেন! ব্যাগটা হাতে নিতেই বৃদ্ধা নাকি রেগে গিয়ে বলেছিলেন… আপনি কেন আমাকে হেল্প করতে এসেছেন আমি তো আপনার হেল্প চাইনি, ধন্যবাদ । স্যার বুঝতে পেরেছিলেন যেচে সাহায্য করা জাপানিজদের পছন্দ নয় ।
এরকম হাসি গল্পের উদাহরণে স্যারের ক্লাস নেয়ার পদ্ধতি আমার ভীষণ প্রিয় হয়ে উঠল। একদিন ক্লাসে আসতে স্যারের একটু দেরি হচ্ছিল, তার আগেরদিন ডক্টর ইউনুস এর নোবেল প্রাইজ নিয়ে দেশ বেশ সরগরম! ক্লাসের ছেলেরা সেই বিষয় নিয়ে নানান কিছু বোর্ডে লিখছিল, আমিও লিখেছিলাম কিছু একটা কিন্তু মুছে ফেলার আগেই স্যার ক্লাসে ঢুকে পড়লেন! সেদিন ভেবেছিলাম এসব লেখা দেখে স্যার হয়তো বকাবকি করবেন অথচ স্যার কি করলেন, আমার লেখার নিচে বড় বড় করে লিখে দিলেন” আব্বা কান্ট্রির দয়া”। স্যার আমেরিকাকে আব্বা কান্ট্রি বলতেন ! স্যার সেদিনের ক্লাসে পুঁজিবাদী অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন l
ভীষণ আনমনা, উদাসীন আর খেয়ালী স্বভাবের ছিলেন লিলন স্যার l তাঁর ব্যক্তিত্বে ফুটে উঠত দুর্দান্ত তারুণ্য অসীম সরলতা আবার প্রয়োজনে রুখে দাঁড়াবার সাহসিকতা।
ভীষণ আনমনা, উদাসীন আর খেয়ালী স্বভাবের ছিলেন লিলন স্যার l তাঁর ব্যক্তিত্বে ফুটে উঠত দুর্দান্ত তারুণ্য অসীম সরলতা আবার প্রয়োজনে রুখে দাঁড়াবার সাহসিকতা। তবে ব্যক্তিজীবনে স্যারের একটা আক্ষেপ ছিল, স্যারের মাথায় চুল ছিল না! ক্লাসে স্যার শেয়ার করেছিলেন জাপানে গিয়ে তার হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টেশন করার ইচ্ছা হলো, একটি ক্লিনিকে তিনি যোগাযোগ করেছিলেন এবং অ্যাপোয়েন্টমেন্টও নিয়েছিলেন। যেদিন তিনি হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টেশন করার জন্য ক্লিনিকে অপেক্ষা করছিলেন, তখন পর্দার আড়ালে আরেকজনের হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টেশন করা দেখতে পেয়েছিলেন। মাথায় চুল লাগাতে গিয়ে সেই লোকের পুরো মাথা নাকি রক্তাক্ত হয়ে ছিল সেই রক্তাক্ত মাথা দেখে স্যার ভয়ে অ্যাপোয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করে চলে এসেছিলেন! এরকম হাজারও আলাপচারিতায় আমাদের মাস্টার্স শেষ হলো । তারপর অনেক বছর কেটে গেল.. ততদিনে আমি স্যারের বলা সেই আব্বা কান্ট্রিতে বসবাস করি l স্যারের সঙ্গে আমি ফেসবুকে কানেক্ট ছিলাম । আমার পোস্টগুলোতে প্রায় স্যার লাইক কমেন্ট করতেন । আমি স্যারকে বলেছিলাম ইউএসএ এলে আমার বাসায় বেড়াতে আসতে । স্যার বলেছিলেন আব্বা কান্ট্রিতে যাওয়া অতোটা সহজ নয় তবুও একটা কনফারেন্সে স্যার ইউএসএ আসবেন বলেছিলেন l
তার কিছুদিন পরেই আমার হাজবেন্ড আমাকে ডেকে বলল, টিভি খবরে প্রচার হচ্ছে তোমাদের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের লিলন স্যার খুন হয়েছেন!
আমি সেদিনের খবরে হতবাক হয়ে রইলাম ।
নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, যে মানুষটা রক্ত দেখে ভয় পেয়ে মাথায় চুল লাগাতে পারলেন না , তাঁকেই কিনা কুপিয়ে রক্তাক্ত করে মেরে ফেলল হিংস্র মানুষ রুপি হায়নাগুলো! ১৫ নভেম্বর ২০১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্লাস নিয়ে মোটরসাইকেলে করে বাড়ি ফিরছিলেন স্যার ঠিক তখনই হায়নার দল স্যারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেদিনের টেলিভিশন এবং প্রথম সারির সব পত্রিকায় স্যারের মৃত্যু সংবাদ প্রচার হয়েছিল, অনেক দিন ধরে সেটা নিয়ে আলোচনা হল কিন্তু এখনো খুনিদের কোনো শাস্তি হলো না।
নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, যে মানুষটা রক্ত দেখে ভয় পেয়ে মাথায় চুল লাগাতে পারলেন না , তাঁকেই কিনা কুপিয়ে রক্তাক্ত করে মেরে ফেলল হিংস্র মানুষ রুপি হায়নাগুলো! ১৫ নভেম্বর ২০১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্লাস নিয়ে মোটরসাইকেলে করে বাড়ি ফিরছিলেন স্যার ঠিক তখনই হায়নার দল স্যারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেদিনের টেলিভিশন এবং প্রথম সারির সব পত্রিকায় স্যারের মৃত্যু সংবাদ প্রচার হয়েছিল, অনেক দিন ধরে সেটা নিয়ে আলোচনা হল কিন্তু এখনো খুনিদের কোনো শাস্তি হলো না।
জানিনা স্যারের কী অপরাধ ছিল। শুনেছি স্যার নাকি ধর্ম-কর্ম করতেন না সেটাই স্যারের অপরাধ ! হয়তবা স্যারের অনেক দোষ ছিল, কিন্ত যারা স্যারকে খুন করল বা করালো তারা কতটা সাধু বা পুণ্যবান? কে কতটুকু ধর্ম-কর্ম করবে বা করবে না সেটা একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত ব্যাপার! যার যার কবরে সেই যাবে। ধর্ম কর্ম না করার দোহাই দিয়ে কেউ কারো জীবন শেষ করে দেয়ার অধিকার রাখে না ।
শাস্তি হোক সেই সব বকধার্মিকদের l প্রিয় শিক্ষক শফিউল ইসলাম লিলন স্যারের আত্মার শান্তি কামনা করি সব সময়। ওপারে স্বাধীনভাবে বিচরণ করুক স্যারের নির্ভীকতা ।
যাঁরা আমাদের স্বপ্নকে, আমাদের জীবনের পথচলারকে হাত ধরে শিখেছেন, অনুপ্রাণিত করেছেন সর্ব সময়ে, তাঁদের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা। বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে ‘বইচারিতার আয়োজন ‘ স্মৃতিতে আমার প্রিয় শিক্ষাগুরু’। আপনি আপনার প্রিয় শিক্ষককে নিয়ে আমাদের কাছে লিখে পাঠিয়ে দিন। সঙ্গে পাঠাবেন শিক্ষকের ছবি, নিজের ছবি, যদি শিক্ষকের সঙ্গে কোনো ছবি থেকে থাকে। থাকবে সেরা ১০জন লেখকের জন্য থাকবে আকর্ষণীয় বই ও সনদ। লেখা পাঠাবেন: boicharita@gmail.com
অক্টোবর ১, ২০২১; নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র