জন্মদিনের শুভেচ্ছা শ্রদ্ধেয় আপা!

প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার সঙ্গে লেখক (১৯৮৪)। ছবি : খালেদ হায়দার
আপনার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ধানমণ্ডি ৩২ এর সিঁড়িতে। আমি ১৯৭৩ সালের মার্চের এক সকালে আপনাদের বাড়ির দোতালার সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছিলাম তিন তালায়, কামাল ভাইয়ের রুমে। ঠিক সেই মুহূর্তে আপনি নামছিলেন নিচে। আমি পথ ছেড়ে দাঁড়ালাম। আকস্মিক আপনার সঙ্গে আমার চোখের দেখা হয়ে যায়। আপনি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলেন আর আমি সালাম দিয়েই দ্রুত উঠেছি তিন তালায়। আমি জানি সেই দেখা আপনি মনে রাখেননি। মনে রাখার কোনো কারণ ছিল না। আমার মাথায় তখন মুক্তিযুদ্ধের রেস ধরা বড় চুল। আমি ছিলাম রোগা ছিপছিপে ১৬ বছরের এক কিশোর। আমাকে দেখেই ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলেন, মনে আছে। কামাল ভাইয়ের বড় বোন হিসেবে দূর থেকেই সমীহ ছিল আপনাকে। অনেকবার দূর থেকেই দেখছি কিন্তু কেন যেন ভয় লাগত। কামাল ভাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার পরিচয় করে দিলেও আপনার সঙ্গে আমার তখনো পরিচয় হয়নি। পরিচয় না হলেও ছবি তুলেছি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। কামাল ভাইয়ের সঙ্গে সারাদিন ক্যামেরা নিয়ে ঘুরলেও কামাল ভাইয়ের কথাতেই দিনের শুরুটা করতাম ৩২ নাম্বারে, আপনাদের বাড়ি থেকে। ওটা আসলে কামাল ভায়ের নির্দেশেই। ভোরে ওস্তাদের কাছে ‘সেতার’ তামিল নিয়েই ছুটতেন তাঁর নীল টয়োটা নিয়ে। সঙ্গে পাশের সিটে বসতাম আমি। আবাহনী থেকে কখনো সারাদিন পইপই করে ছুটে বেড়াতেন কামাল ভাই কাজের পিছনে। তিনি আপদামস্তক ক্রীড়া আর সংস্কৃতি পাগল মানুষ ছিলেন বলেই যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে মাত্র সাড়ে তিন বছরে কী অসাধ্যই না সাধন করেছিলেন খেলাধুলা আর সংস্কৃতিতে।
কামাল ভাই আর বঙ্গবন্ধুর কারণে আমি দ্রুত ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠি আপনাদের পরিবারে। অবশ্য সবচে বড় কারণ ছিল আপনাদের নিরহংকার জীবন। এত এত বিশাল মাপের মানুষ হয়েও বঙ্গবন্ধুর মতোই নিরঅহংকার আর অমায়িক ব্যাবহার ছিল আপনাদের।
কামাল ভাই আর বঙ্গবন্ধুর কারণে আমি দ্রুত ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠি আপনাদের পরিবারে। অবশ্য সবচে বড় কারণ ছিল আপনাদের নিরহংকার জীবন। এত এত বিশাল মাপের মানুষ হয়েও বঙ্গবন্ধুর মতোই নিরঅহংকার আর অমায়িক ব্যাবহার ছিল আপনাদের। অসাধারণ ব্যবহারের সবাই কত সহজেই আপন করে নিতেন সবাইকে। আমার মনে আছে খাল্লাম্মাকে, বঙ্গমাতা, কখনো রাগ করতে দেখি নাই আমি। শুধু তিনি কেন, ঐ বাড়ির মানুষের গলার স্বর কোনো দিন উচ্চমাত্রায় শুনিনি। আপনাদের পোশাকেও বিলাসিতার চিহ্ন কোথাও দেখি নাই। বঙ্গবন্ধু কিংবা খালাম্মা বাইরের মেহমানদের সামনে সাধারণ পোষেকেই দেখা করতেন। বঙ্গবন্ধু আর খাল্লাম্মার দুজনারই দুইটি ভিন্ন ভিন্ন শখ আমাকে আপ্লুত করত। বঙ্গবন্ধুর পাইপ আর খালাম্মার পানের বাটা! ঐ দুইটি ছিল তাঁদের কাছে অমৃতসম সঙ্গের সাথী। একবার ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ইন্দিরা গান্ধীর ঢাকা আগমন উপলক্ষে জনসভায় খালাম্মা শাড়ির আচলের তলে করে পানের বাটা নিয়ে গিয়েছিলেন মঞ্চে। জনসভার সেই নৌকা মঞ্চে দীর্ঘ সময় বসে থাকবেন পান ছাড়া! আপনাদের বাড়ির আসবাবগুলোও ছিল খুব সাধারণ। নেই কোনো কার্পেট, নেই কোনো শীততাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। আমি যেদিন প্রথম ঐ বাড়িতে গিয়ে বসার ঘরে বসেছিলাম সেই দিন ঘরের মেঝেতে আমার চোখ আটকিয়ে গিয়েছিল। দেখি মেঝেটায় ফাটার চিহ্ন! আমার প্রায়শই মনে হয়েছে কেন তা মেরামত হল না। বাড়িটি তো প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি! তাঁর ঘরের আসবাবপত্রগুলো কিংবা পর্দা কিংবা তিনতালা পুরো বাড়িতে একটি মাত্র টেলিভিশনটা কিংবা দোতালায় খাবার টেবিলটা যেখানে চারজন বসে খাবার খাওয়া যায় না। কেন কোনো রান্না করার সেফ ছিল না? আপনাদের খাবারের মেন্যুও কী সাধারণ ছিল! বঙ্গবন্ধু পছন্দ করতেন নানা পদের দেশি মাছ। কই, মাগুর, শিং, পাপদা ছিল বঙ্গবন্ধুর অন্যতম প্রিয় মাছ আর তা দিয়ে প্রায়শই খালাম্মা রান্না করে টিফিন ক্যারিয়ারে নিয়ে যেতেন গণভবন অফিসে। আর আপনারা পাঁচ ভাইবোন মিলে সেই তরকারি খেয়েছেন।
আপনাদের পোশাকেও বিলাসিতার চিহ্ন কোথাও দেখি নাই। বঙ্গবন্ধু কিংবা খালাম্মা বাইরের মেহমানদের সামনে সাধারণ পোষেকেই দেখা করতেন। বঙ্গবন্ধু আর খাল্লাম্মার দুজনারই দুইটি ভিন্ন ভিন্ন শখ আমাকে আপ্লুত করত। বঙ্গবন্ধুর পাইপ আর খালাম্মার পানের বাটা! ঐ দুইটি ছিল তাঁদের কাছে অমৃতসম সঙ্গের সাথী। একবার ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ইন্দিরা গান্ধীর ঢাকা আগমন উপলক্ষে জনসভায় খালাম্মা শাড়ির আচলের তলে করে পানের বাটা নিয়ে গিয়েছিলেন মঞ্চে। জনসভার সেই নৌকা মঞ্চে দীর্ঘ সময় বসে থাকবেন পান ছাড়া! আপনাদের বাড়ির আসবাবগুলোও ছিল খুব সাধারণ। নেই কোনো কার্পেট, নেই কোনো শীততাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। আমি যেদিন প্রথম ঐ বাড়িতে গিয়ে বসার ঘরে বসেছিলাম সেই দিন ঘরের মেঝেতে আমার চোখ আটকিয়ে গিয়েছিল
সদ্যস্বাধীন বিধ্বস্ত দেশ গঠনে যে এমনই জীবন যাপন করবেন জাতির জনক প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এইটাই ছিল স্বাভাবিক। উচ্চবিলাসি জীবন পরিহার করবেন, সে কারণেই তো তিনি আমাদের জাতির পিতা, আমাদের বঙ্গবন্ধু !
আর আপনারা যে তাঁরই সন্তান ।
আমার মনে আছে যেদিন এই ৩২ এর ৬৭৭ নাম্বর বাড়িটি ফিরে পেলেন সেই দিন আপনার বুক ভাঙা কান্নার শব্দ। চারদিকে প্রিয় মানুষ গুলোর শুধুই রক্তের দাগ। কোনো কিছুই অক্ষত নেই। সাধারণ সেই বাড়িটি কী ভাবে লুট করেছিল পথভ্রষ্টরা। বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘরে একটি খাট, সেই খাটের তোষক কীভাবে খুচিয়েছিল বেয়োনেট দিয়ে? নিশ্চয়ই মনে আছে আপনার। আর বঙ্গবন্ধুর তালপাতার হাত পাখাটা? প্রতি রাতে খাল্লাম্মা বঙ্গবন্ধুর মাথার কাছে সেই তালপাতার বাতাস দিতেন! খালাম্মার পানের বাটার কথা মনে আছে? ভেতরের পানপাতা কেমন শুকিয়ে শুকিয়ে চৌচির হয়ে গিয়েছিল? বঙ্গবন্ধুকে দেয়া বাংলার মানুষের ভালোবাসার সব উপহারগুলো? স্বর্ণের ছোট ছোট নৌকাগুলো? একটিও রেখে যায়নি তারা। সব লুটেছে হায়নার দল। চারদিকে শুধু শুকিয়ে থাকা জমাট রক্ত। দেয়াল জুড়ে এমন কী দেয়ালের উপর সিলিং এ পর্যন্ত ফিনকি দিয়ে উঠেছিল রক্ত।
আমার মনে আছে যেদিন এই ৩২ এর ৬৭৭ নাম্বর বাড়িটি ফিরে পেলেন সেই দিন আপনার বুক ভাঙা কান্নার শব্দ। চারদিকে প্রিয় মানুষ গুলোর শুধুই রক্তের দাগ। কোনো কিছুই অক্ষত নেই। সাধারণ সেই বাড়িটি কী ভাবে লুট করেছিল পথভ্রষ্টরা। বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘরে একটি খাট, সেই খাটের তোষক কীভাবে খুচিয়েছিল বেয়োনেট দিয়ে? নিশ্চয়ই মনে আছে আপনার। আর বঙ্গবন্ধুর তালপাতার হাত পাখাটা? প্রতি রাতে খাল্লাম্মা বঙ্গবন্ধুর মাথার কাছে সেই তালপাতার বাতাস দিতেন! খালাম্মার পানের বাটার কথা মনে আছে? ভেতরের পানপাতা কেমন শুকিয়ে শুকিয়ে চৌচির হয়ে গিয়েছিল? বঙ্গবন্ধুকে দেয়া বাংলার মানুষের ভালোবাসার সব উপহারগুলো? স্বর্ণের ছোট ছোট নৌকাগুলো? একটিও রেখে যায়নি তারা। সব লুটেছে হায়নার দল। চারদিকে শুধু শুকিয়ে থাকা জমাট রক্ত। দেয়াল জুড়ে এমন কী দেয়ালের উপর সিলিং এ পর্যন্ত ফিনকি দিয়ে উঠেছিল রক্ত।
প্রতিটি ঘরে বীভৎস দৃশ্য দেখে নিজেকে কী কষ্টে সামলে ছিলেন আপনি। আপনি ছিলেন তখন পাগল প্রায়। আপনি বার বার সংজ্ঞা হারাচ্ছিলেন আর আমাদের চোখের পানিও তখন বাদ মানেনি আপা।
আবার নূতন করে বাঁচতে চাইলেন আপনি। নিচতালার ছোট্ট ঘরটায় কোনো সাহসে আবার বসত করতে শুরু করেছিলেন ? নজিব আহমেদ বাহাউদ্দিন নাসিমসহ সবাই থেকেছে ৩২ ঘিরে আপনার চারপাশে।
মনে আছে বঙ্গবন্ধুকে যেদিন বিবিসির জরিপে শ্রেষ্ঠ বাঙালি ঘোষণা এলো সেই দিন আমি পঁচাত্তরের ১৩ জুলাই তোলা বঙ্গবন্ধুর সেই অবিস্মরণীয় বাঙালিয়ানা ‘ লুঙ্গি গেঞ্জি পরিহিত হাতে প্রিয় পাইপ ‘ ছবিটা নিয়ে গিয়েছিলাম। আপনাকে অভিনন্দন জানাতে ধানমণ্ডি ৩২ এ। আপনি ছবিটা বুকে জড়িয়ে অঝরে কান্না করেছিলেন। আমি অবশ্য জানতাম না আমার সেই ছবিটি কান্নার কারণ হবে এই আনন্দে ! আপনি জানতে চাইলেন কবে কখন তুলেছিলাম ছবিটা ?
এরপর শুধুই ছুটে চলা। শহর বন্দর গ্রামে। কখনো কখনো ক্যামেরা নিয়ে আপনার সঙ্গে থেকেছি আমিও।
পাগলপ্রায় জীবনের কষ্ট লাঘবে আপনি ছুটে যেতেন বাংলার হত দরিদ্র মানুষের কাছে। ছুটে যেতেন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার কথা বলতে। দিন নাই, রাত নাই শুধুই ছুটে চলা। আপনার হারিয়ে যাওয়া পিতাকে খুঁজে ফিরতেন সেই দুঃখী মানুষের মাঝে!
কিন্তু ষড়যন্ত্র পিছু ছাড়ে না আপনার।
ক্রমশ
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ঢাকা ।