বুদ্ধদেব গুহ স্মরণে: আপনিই তো আমাদের ভালোবাসতে শিখিয়েছেন, ভালোবাসা বানাতেও।

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহের সঙ্গে লেখক ও অন্যান্যরা। ছবি: সংগৃহীত
সানি টাওয়ার্স-এর ন’তলার এই ঘরটিতে স্বর্গীয়বিভামণ্ডিত প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপর আপনাকে এমন নিথর হয়ে থাকতে দেখে আমার ভিতরে তখন সৌধের ভেঙ্গে পড়া; খান-খান হয়ে যাচ্ছিলাম। এই ঘরটিতে এর আগেও কতবার যে আসার সৌভাগ্য হয়েছে আমার—আপনি সরভাজা খেতে খুবই পছন্দ করতেন তাই যখনই যেতাম লুকিয়েচুরিয়ে কখনও-বা প্রকাশ্যে সেই সরভাজা নিয়ে যেতাম, তারপর চুপিচুপি বলতাম, দাদা, এনেছি, তখন আপনার মুখমণ্ডলে যেন খুশির ঝিলিক, বাচ্চাদের মতো করে বলতেন ‘দাও, দাও, বের করো!’ “সুগার লেভেল-কে এড়িয়ে, কন্যার শাসনচক্ষু লুকিয়ে আয়েশ করে খেতে খেতে বলতেন ‘জানো তো, ঋতু খুব পছন্দ করত সরভাজা’। আমি তখন আপনার দেবশিশুর মতো মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম, এত অল্পতে এমন খুশি হতে শুধুমাত্র আপনিই পারেন!
বাচ্চাদের মতো করে বলতেন ‘দাও, দাও, বের করো!’ “সুগার লেভেল-কে এড়িয়ে, কন্যার শাসনচক্ষু লুকিয়ে আয়েশ করে খেতে খেতে বলতেন ‘জানো তো, ঋতু খুব পছন্দ করত সরভাজা’।

আমাদের মতো পাঠকের কাছে আপনি তো শুধুই লেখক ছিলেন না; আপনি আমাদের কাছে ছিলেন পরমাত্মীয় (রবি ঠাকুরকে উদ্ধৃত করে বলতেন, “যে আত্মার কাছে থাকে সেই তো আত্মীয়”)। আপনিই তো আমাদের ভালোবাসতে শিখিয়েছেন, ভালোবাসা বানাতেও। এই ক্লেদগ্লানিযুক্ত ইটকাঠপাথরের নাগরিক জীবনের ভেতর থেকেই আমাদেরকে হাত ধরে নিয়ে গেছেন মায়াপৃথিবীর গহীন প্রদেশে! আমাদের মনের গোপন দরজা খুলিয়েছেন অবলীলায়! পড়ার বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে “একটু উষ্ণতার জন্য” পড়তে পড়তে কিশোর বুকের ভিতরে যৌবনের প্রথম আলোড়ন টের পাইয়েছেন, যেমনভাবে কোনো কিশোরী নিজের অজান্তেই যুবতী হয়ে উঠে! আপনি ছিলেন এক অন্য আরণ্যকের ধারক ও বাহক, অরণ্য প্রকৃতিকে ঐশী মহিমায় না দেখে দেখেছিলেন এবং দেখিয়েছেন প্রেমিকার মহিমায়! তাইতো আপনি নিঃসঙ্গ, সেইসঙ্গে পূর্ণও!
রবীন্দ্রগান থেকে শুরু করে অতুলপ্রসাদী, পুরাতনী, টপ্পা থেকে আরও কত কী! আঙ্গুরবালা দাসীর “আমি জগতের কাছে ঘৃণ্য হয়েছি তুমি যেন ঘৃণা করো না ” গানটি আমি বারবার করে আপনার কাছে শুনতে চাইতাম, প্রায়ই শোনাতেন, কখনও-বা কপট রাগ দেখিয়ে বলতেন “অত ঘৃণ্য হওয়ার দরকার নেই”!
লালাদা, আপনার সঙ্গে গত পাঁচ-ছ বছরে বেশ কিছু রাত ও দিন কাটানোর সুযোগ পেয়েছিলাম। তারমধ্যে যেমন শান্তিনিকেতনে আপনার “রবিবার”-এ অসংখ্যবার, তেমনি হলদিয়া বা কৃষ্ণনগরেও। আপনার অননুকরণীয় আতিথ্য আর কোথাও পেয়েছি বলে মনে পড়ে না এবং আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি অন্য কোথাও পাব না, যে আতিথ্যের কাছে আজীবন নয়, জন্ম জন্মান্তরের ঋণ থেকে যায়। গন্ধরাজ লেবু, কাঁচা লংকা আর অ্যাঙ্গুস্টুরা বিটারস সহযোগে ভদকা বা স্কচ হুইস্কি পান করতে করতে কত অজানা ও মজার গল্প শোনাতেন সাথে উপরি পাওনা ছিল গান। রবীন্দ্রগান থেকে শুরু করে অতুলপ্রসাদী, পুরাতনী, টপ্পা থেকে আরও কত কী! আঙ্গুরবালা দাসীর “আমি জগতের কাছে ঘৃণ্য হয়েছি তুমি যেন ঘৃণা করো না ” গানটি আমি বারবার করে আপনার কাছে শুনতে চাইতাম, প্রায়ই শোনাতেন, কখনও-বা কপট রাগ দেখিয়ে বলতেন “অত ঘৃণ্য হওয়ার দরকার নেই”!
দাদা, আর কখনও আপনার এমন কন্ঠ শুনতে পাব না, যেমন পাব না ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ঝরে পড়া স্নেহ ও অভিমান—আর্দ্র-স্বরে বলতেন “হ্যাঁ, বলো—তুমি তো আমাকে ত্যাগ করেছো” কেননা মাঝে মধ্যে বিরাম পড়ত ফোন করায়। আমি বিব্রত হয়ে ভাষা হারিয়ে ফেলতাম, তখনই আপনি আবার রসিকতা করে আমাকে দূর থেকেও যেন ভালোবেসে পিঠ চাপড়ে দিতেন!

দাদা, আপনি সবসময়ই বলতেন যে “আমার ডেডবডিও আমার কথা রাখে”। বলতেন “আমি মরার আগে একবার তোমার বাড়ি (কৃষ্ণনগর) ঘুরে আসব! হ্যাঁ দাদা, আপনি কথা রেখেছিলেন কৃষ্ণনগরে এসে। আপনার তিনদিনের কৃষ্ণনগর সফর আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। আপনিও ভীষণ উপভোগ করেছিলেন সেই সফর, সঙ্গে ভরা রবীন্দ্রভবনের প্রায় সাড়ে পাঁচশো সর্বস্তরের মানুষ আপনার কথা ও গান শুনে ধন্য-ধন্য করেছে।
আরও কত ছেঁড়া-ছেঁড়া স্মৃতি ভিড় করে আসছে ঝাপসা চোখে। আপনার সাথে বাইরে কোথাও গেলে আমার দায়িত্ব পড়ত আপনাকে যথাসময়ে ওষুধ দেওয়া। আপনি মজা করে বলতেন “তুমিও তো আমার মেয়েদের মতোই টাইমে টাইমে ওষুধ দেওয়াটা রপ্ত করে ফেলেছো দেখছি”। তারপরই খুবই বিরক্তির সঙ্গে বলতেন “ওষুধ খাইয়ে খাইয়েই আমাকে মেরে ফেলবে, সারাদিনে কতবার যে ওষুধ খেতে হয়। আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না”। তখন ভেতরটা হুহু করে উঠত। দাদা, মনে আছে একবার হলদিয়ার গোল্ডেন রিট্রিট হোটেলের বাথরুমের মধ্যে আপনার বুকে ব্যথা শুরু হয়েছিল, আপনি কোনও মতে কোমরে একটা টাওয়েল জড়িয়ে বের হয়ে বললেন “রঞ্জন, কৌটো থেকে তাড়াতাড়ি একটা সরবিট্রেট বের করে দাও তো বুকে খুব ব্যথা শুরু হয়েছে”। সেদিন যেমন সত্যিসত্যি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম তেমনি কান্না পেয়ে গেছিল আপনার কাতরতা দেখে! অত যন্ত্রণার মধ্যেও আপনার দেবদুর্লভ শরীর থেকে যেন জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছিল! আহা! সে কী অপরূপ রূপ! আরেকটা কথা আজকে খুব মনে পড়ছে, কানাডাপ্রবাসী আপনার লক্ষণ-ভাই ‘সাগর বাবু’ (দশম প্রবাসে যার কথা বিশদে বলা আছে)-কে নিয়ে শান্তিনিকেতন ঘুরতে ঘুরতে শ্মশানের কাছে গিয়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বিয়ারপান চলছিল, এমন সময় দাহ’র জন্য একটা মৃতদেহ এসে পৌঁছেছিল, তার কিছুক্ষণ পর মৃতের স্বজনেরা এসে মৃতদেহ আঁকড়ে আছাড়িপিছাড়ি করে কাঁদছিল, আমি বললাম, দাদা, চলুন এখান থেকে যাওয়া যাক, শুনে আপনি বললেন “কেন? ওরা কাঁদছে, সেইজন্যে? কাঁদুক, আমরাও তো কাঁদছি!” সেদিন কিছুটা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলাম যে, বড় বাঘের মতো বাঁচতে চাওয়া মানুষটির ভেতরেও অব্যক্ত কষ্টের পাহাড়ি ঝোরা বয়ে চলেছে অন্তঃসলিলা হয়ে!
“রঞ্জন, কৌটো থেকে তাড়াতাড়ি একটা সরবিট্রেট বের করে দাও তো বুকে খুব ব্যথা শুরু হয়েছে”। সেদিন যেমন সত্যিসত্যি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম তেমনি কান্না পেয়ে গেছিল আপনার কাতরতা দেখে!

দাদা, আর কি আমাদের কখনও দেখা হবে না কোনো সোনারঙা গোধূলিতে? মাথায় উষ্ণীষ, গায়ে রাজকীয় পাঞ্জাবি, চোখে-মুখে চিরনবীন হাসির সঙ্গে খুসবুদার আতরের গন্ধমাখা আপনাকে কি আর দেখতে পাব না কোনো অনুষ্ঠানে! আপনাকে যে আমাদের খুব দরকার লালাদা, আপনাকে ছাড়া যে আমাদের চলবে না! নির্জন নরম নীল-অন্ধকারে বাতাস যখন সুর ও সুরায় মাতবে তখন কোনও প্রেমিক তার প্রথম প্রেমিকাকে একখানি “হলুদ বসন্ত” বা “একটু উষ্ণতার জন্য” দিয়ে বলবে “জানো, আমাদের জীবনে বয়ে নিয়ে যাওয়ার কিছুই থাকে না, যা থাকে এবং থাকবে চিরকাল অমলিন, তা হলো এক টুকরো নরম, নীরব ভালবাসা”।
নির্জন নরম নীল-অন্ধকারে বাতাস যখন সুর ও সুরায় মাতবে তখন কোনও প্রেমিক তার প্রথম প্রেমিকাকে একখানি “হলুদ বসন্ত” বা “একটু উষ্ণতার জন্য” দিয়ে বলবে “জানো, আমাদের জীবনে বয়ে নিয়ে যাওয়ার কিছুই থাকে না, যা থাকে এবং থাকবে চিরকাল অমলিন, তা হলো এক টুকরো নরম, নীরব ভালবাসা”।

লালাদা, আর একটা কথা বলার ছিল, আপনি তো বলতেন “পরজন্ম বলে যদি কিছু থেকে থাকে আর সেখানে গিয়ে যদি ঋতুর সঙ্গে দেখা হয় তাহলে বলব যে “এবার আর কোনো কাজ করব না, শুধু তোমার সামনে বসে থেকে তোমার গান শুনব!” সেখানে কি আপনার প্রেয়সী গায়িকার দেখা পেলেন? যদি পেয়ে থাকেন তাহলে নিশ্চয় তাঁর সামনে বসে গান শুনছেন? কোন গানটা শুনছেন লালাদা? “ওগো কাঙাল, আমারে কাঙাল করেছো….” এই–টাই নিশ্চয়।
আরও পড়ুন:
বুদ্ধদেব অরণ্য পেরিয়ে অজানা এক অভিযানে
অকৃত্রিম ভালোবাসা ছাড়া বোধহয় প্রকৃত সৃষ্টি সম্ভব নয়
যৎকিঞ্চিৎ বুদ্ধদেব গুহ
বুদ্ধদেব গুহ’র মৃত্যুতে দুই বাংলায় শোকের ছায়া
‘জগমগি’—সাহসিকার পূর্ণ আখ্যান
৩৩ দিন করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে জয় করে আবারও হাসপাতালে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ