মৈনম গ্রামের শেষ গোধূলি

শিমুল গাছের সেই অচিন পাখিটি ডেকে উঠল। ফজর ওয়াক্তের আগে পাখিটির ডাক শোনা যায়। নিশুতি শীতের রাতে আরেকটি পাখিও কুহু কুহু করে ডেকে ওঠে। জ্যোৎসনার আলোয় বাড়ির আঙ্গিনায় কাঁঠাল পাতার ছায়া পড়েছে। বাড়ির প্যাঁচিলের পাশের রাস্তায় পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ফকির পাড়া মসজিদের মোয়াজ্জিন ধীর গতিতে হ্যারিকেন হাতে মসজিদের দিকে গমন করছে। একটু পর মৈনম ফকির পাড়া মসজিদের মোয়াজ্জিন ষাটর্ধো সামাদ নানা মাইকে বলছেন , উঠে পড়ো, উঠে পড়ো— ঘুম হইতে নামাজ উত্তম । মাইকের শব্দে মুরগীর ঘোরার মোরগগুলো এক সঙ্গে ডেকে উঠে। সেই সঙ্গে জাগ্রত মৈনম গ্রামের দেওয়ান বাড়ির মুসল্লি আমার নানাজান দেওয়ান মতিউর রহমান। টিউবয়েলে পানি চাপার শব্দ শোনা যাচ্ছে আশপাশের বাড়ি থেকে। দূরের গ্রামের মসজিদ থেকে আজানের সুর ভেসে আসছে। আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম । আমি ল্যাপ মুরি দিয়ে আমার নানা বাড়ির ভোর হওয়া এমনভাবেই উপভোগ করতাম , আজ থেকে বিশ বছর আগে।
আমার নানা বাড়ি মৈনম ফকির পাড়া। নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার জলছত্র মোড়ের দক্ষিণে তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মৈনম গ্রাম। জলছত্র মোড় থেকে মৈনম গ্রামের সরু পাকা রাস্তা অজগর সাপের মতো এঁকে বেঁকে গিয়েছে। সবুজ শ্যামলে বেষ্টিত এক সিগ্ধ ছায়াময় গ্রাম। মূলত মৈনম গ্রামটি পলি অঞ্চল নামে খ্যাত। তাই গ্রামটি অরণ্য বেষ্টিত।
আমার নানা বাড়ি মৈনম ফকির পাড়া। নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার জলছত্র মোড়ের দক্ষিণে তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মৈনম গ্রাম। জলছত্র মোড় থেকে মৈনম গ্রামের সরু পাকা রাস্তা অজগর সাপের মতো এঁকে বেঁকে গিয়েছে। সবুজ শ্যামলে বেষ্টিত এক সিগ্ধ ছায়াময় গ্রাম। মূলত মৈনম গ্রামটি পলি অঞ্চল নামে খ্যাত। তাই গ্রামটি অরণ্য বেষ্টিত।
আমার নানাজানের বাড়িটি ছিল প্রকাণ্ড । শীতের খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতাম। চিতা বাঘের মতো ডোরা কাটা একটি সোয়েটার ছিল। সোয়েটারের উপর নানী মুনি একটি লুঙ্গি গলায় মুড়ে দিতেন। এতে করে আমার সারা দেহ লুঙ্গির ভেতরে থাকত। মাথায় পড়ে দিত উলের কালো মানকি টুপি । বাড়ির সামনের খোলায় দু তিনটি খেজুর গাছ ছিল। পূর্ব পাড়ার একজন বধির সম্পর্কে আমার মামা হন। সেই বোবাকে আমরা কালা মামা বলে ডাকতাম। কালা মামা গাছুরে ছিল । খেজুরের রস সংগ্রহ করে খেজুর গুড় তৈরি করত। পয়লাকাটা খেজুরের রস খাওয়ার নেশায় গাছ তলায় অপেক্ষা করতাম। চারদিকে কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে থাকত গ্রামটি । গাছের পাতা থেকে শিশির পড়ছে । গ্রামের ভাষায় শিশিরকে বলা হতো ‘নিয়র’ । খেজুরের রস মুড়ি দিয়ে খেয়ে আমার বন্ধু আর আমি সাইকেলের টায়ার লাঠি দিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে মৈনম প্রথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে চলে যেতাম। বিদ্যালয়ের মাঠে শিশির ভেজা ঘাসে খালি পায়ে দৌঁড়াতে খুব ভালো লাগত। টায়ার নিয়ে খেলার পর বাড়ি এসে দেখতাম নানী মুনি ভাপা পিঠা বানাচ্ছে। গ্রামের মানুষ ভাপা পিঠাকে ভাগা বলত। চুলার আছে হাত বুলাতাম আর ভাপা পিঠা খেজুরের লালি গুড় দিয়ে খেতাম । আহা সেই অমৃত স্বাদ যেন আজও জিহবায় লেগে আছে।একটু পর কুয়াশা মিশ্রিত রোদ উঠতে শুরু করে । বাড়ির পাশের সুপারি বাগানের সুপারি গাছের পাতায় যখন রোদ পরে তখন শিশির ভেজা পাতা চিকচিক করে ওঠে। সে এক অদ্ভূত দৃশ্য। প্রকৃতির লীলা খেলায় সকাল পেরিয়ে দুপুর এসে যায় ।

দুপুরে আমরা কয়েকজন বাড়ির উত্তরে এনামুল নানার পুকুরে গোসল করতে যেতাম । দৌঁড় দিতাম কে আগে পুকুরে ঝাঁপ দিতে পারে । পুকুরে আমরা হোলি খেলতাম । ঠাণ্ডা পানিতে অনেকক্ষণ গোসলের পর কাঁপুনি ধরে যেত । রোদে দাঁড়িয়ে দু’হাত মুঠো করে বুকে দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে রোদ পোহাতাম। দুপুরে খাবারের পর আঙ্গিনায় নানী মুনি শীত রোদে পাটি পেতে পিরির উপর বসে কাঁথা সেলাই করতেন আর পান চিবুতেন। জর্দার গন্ধে চারপাশ মৌ মৌ করত । আসরের আজানের পর আমরা কয়েকজন মিলে চলে যেতাম বাড়ির দক্ষিণে আম বাগানে । আম বাগানের দক্ষিণে বিস্তীর্ণ ধান খেত । পৌষ মাসে ধান কাঁটা শুরু হয়। যতদূর চোখ যায় জমিতে শুধু লারা আর লারা। [লারা হচ্ছে ধান কাঁটার পর যে অংশ মাটিতে থাকে ।] সেখানে আমরা গোল্লাছুট খেলার পর জমির আইলে বসতাম । বিস্তীর্ণ জমির সাত আট হাত উপরে কুয়াশার স্তর ভেসে বেড়াত। দূরের জমিতে কেউ কেউ লারা কেটে আগুন জ্বালিয়ে তাপ নিতো । শীতকালের গোলাকৃতির ধূসর সূর্যটি আর কিছুক্ষণ পর ডুবে যাবে । নানার বাড়ির গোয়ালা অলি মামা মাঠ থেকে গরু নিয়ে গোয়ালে ফিরছেন। সরু পাকা রাস্তার পাশের বাশ ঝার থেকে পাখির কিচিরমিচির কলতান পুরো ফকির পাড়া মুখরিত করছে। দক্ষিণ দিকের হিন্দু পাড়া থেকে সাখের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে আমরা গোধূলি বেলাটা উপভোগ করতাম। কাঁধে হাত দিয়ে সারিবদ্ধ হয়ে রেলগাড়ির মতো হর্ণ বাজিয়ে বাড়ি ফিরতাম।
বিষুর ভিসিবির দোকান থেকে বিভিন্ন শ্রেণির লোক টিভি , ভিসিবি , ব্যাটারি ভাড়া করে নিয়ে যেত । গ্রামে তখন টেলিভিশন দু’একটি বাড়িতে ছিল। বিষুর দোকানের ভেতর দুই টাকা টিকিটে ভিসিবিতে সালমান শাহ এর ছবি দেখা যেত।
গ্রামের আরেকটি মজার জিনিস হলো গ্রাম্য হাট । মৈনম বাজারে সোমবার আর শুক্রবার এই দুদিন হাট বসত। আমি নানাজানের সঙ্গে ভ্যানে চড়ে হাটে যেতাম। চলন্ত ভ্যানে পা ঝুলিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে আমার বেশ ভালো লাগত। মনে হতো চলন্ত ভ্যানের সঙ্গে মস্ত বড় আকাশটাও ঘুরছে। মৈনম হাট মোটামুটি বড় ধরনের হাট । মৈনম হাটের প্রবেশ পথে একটি পরিত্যক্ত ঘর দেখতে পাওয়া যায় । শোনা যায় এটি ছিল বৃটিশ আমলের বোর্ডের ঘর। বোর্ডের ঘরের চারপাশে ঘন জঙ্গল। হাটের রাস্তার প্রথম দোকানটি ছিল ঝন্টু মামার ক্যাসেটের দোকান। ঝন্টু মামার ক্যাসেটের দোকানে সব সময় একাটি কমন গান বাজত আর সেটি হলো,“ দিলবার দিলবার হো দিলবার দিলবার ” এই গানটি। কয়েকটি উৎসুক শ্রেণির লোক ঝন্টু মামার দোকানে সব সময় বসে থাকত। ঝন্টু মামা পানও বিক্রি করত। বাহারি পান হরেক রকম মসল্লায় সাজিয়ে বিক্রি করত। মৈনম হাটের প্রত্যেকটি দোকানের নিজস্ব বৈশিষ্ট ছিল। বিষুর ভিসিবির দোকান থেকে বিভিন্ন শ্রেণির লোক টিভি , ভিসিবি , ব্যাটারি ভাড়া করে নিয়ে যেত । গ্রামে তখন টেলিভিশন দু’একটি বাড়িতে ছিল। বিষুর দোকানের ভেতর দুই টাকা টিকিটে ভিসিবিতে সালমান শাহ এর ছবি দেখা যেত। হাটে আরেকটি মজার জিনিস হলো মৃৎশিল্পের দোকান। একটু বুড় মতো লোক চাটাইয়ের উপর সাজিয়ে হরেক রকম মৃৎশিল্প বেঁচত। বিভিন্ন মাছ , পাখি, খেলনা পাতিল। আরও একটি মজার জিনিস ছিল লালন শাহ এর মতো দেখতে মৃৎশিল্প। লালন শাহ এর মাথায় হাত দিলে মাথা দুলে উঠত। নানাজান আমাকে লালন শাহ এর মতো দেখতে মৃৎশিল্পটি কিনে দিয়েছিল। হাটে চশমার , ঘড়ির দোকানও বসত। চশমাকে আমি শৈশবে চমশা বলতাম। নানাজানের কাছে বায়না ধরে দশ টাকা দামের একটি রঙ্গিন চশমা কিনেছিলাম। হাটের দুটি খাবারের জিনিসের প্রতি ছিল আমার খুব লোভ । কেদুর দোকানের ছোট ছোট পিয়াজু আর আবুল ময়রার দোকানের কাটা সন্দেশ। হাটে সন্ধ্যা নেমে আসত। বাজার করার পর আবার আমরা ভ্যানে উঠতাম। আমার হাতে ছিল মাথা দুলানো লালন শাহ এর মৃৎশিল্প আর চোখে রঙ্গিন চশমা। হাট থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেখতাম , গ্রামের বিচিত্র লোক হাতে বড় বড় মাছ ঝুলিয়ে মন্থর গতিতে হেঁটে হেঁটে বাড়ি যাচ্ছে। কারও কারও হাতে ঝুলন্ত কেরোসিনের বোতলও দেখতাম। এই বিচিত্র লোকদের প্রতি আমার কৌতূহল ছিল অসীম। আহা! হাট থেকে বাড়ি ফিরে রাতে কুপি জ্বালিয়ে কত আয়েশ করেই না মাছ দিয়ে ভাত খাবে!

সেই সময় মৈনম গ্রামে দিনরাত্রি এমন ভাবেই কেটে যেত। শৈশবের প্রতিটি মুহূর্ত আমার মৈনম গ্রামের সঙ্গে মিশে থাকত। দিন যায় , সপ্তাহ যায় , মাস যায় ,বছরও চলে যায়। আমিও তার সঙ্গে বড় হই। পড়ালেখার চাপও বেড়ে যায় । শহুরে জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। নানা বাড়ি যাওয়া হতো খুব কম। এক সময় নানী মুনির মৃত্যু হয়। নানী মুনির মৃত্যুর পর নানাজান আমার মামার সঙ্গে শহরে চলে আসে । লোকশূন্য হয়ে পড়ে মৈনম গ্রামের সেই মাটির দ্বিতল বিশিষ্ট প্রকাণ্ড বাড়িটি।
শেষবার যখন নানা বাড়ি গিয়েছিলাম তখন অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। সেই অরণ্য বেষ্টিত গ্রামটি আর নেই । পূর্ব পাড়ার জঙ্গল কেঁটে ইটের বেশ কয়েকটি বাড়ি হয়েছে। সবার বাড়ি প্রায় ইটের দুতলা বিশিষ্ট। মৈনম বাজারেরও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। সেই হাট খোলা আর নেই। এখন বেশ জাঁকজমক বাজার । বড় বড় বেশ কয়েকটি মার্কেট হয়েছে। হাটের দিন বলে কিছু নেই , মনে হয় সবদিনই হাট বসে।
সেই শৈশবের আম বাগানে গিয়েছিলাম । পড়ন্ত বিকেল হতে আর বেশি দেরি নেই। আম বাগানের বড় বড় গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। বাগানের পশ্চিমের পাকা রাস্তা বেশ প্রশস্ত হয়েছে। আম বাগানের পাশের বাঁশ ঝাড়ের অবস্থাও করুন। দু একটি বাঁশ কোনো মতো দাঁড়িয়ে আছে আকাশ পানে। ঈদগাহ মাঠের পাশে নতুন একটি মসজিদ হয়েছে। প্রশস্ত পাকা রাস্তা দিয়ে বাইক , ইজি বাইক , ট্রাক , বাসের চলাচল বেড়েছে। বাঁশঝাড়ের সেই পাখির কলতান আর নেই। বাজছে শুধু যানবাহনের হর্ণ। মৈনম গ্রামের সেই শৈশবের গোধূলির আমেজ আর নেই। শেষবারের গোধূলিটা ছিল বেশ বিষাদময়। চলে আসার সময় আমার হৃদয়টা বেদনায় হু হু করে উঠেছিল। আহারে! শৈশবের আমার প্রিয় গ্রাম !
সেতু ইসলাম ,নওগাঁ।
সবকিছুই পরিবর্তনশীল। নানী বাড়ির সেই শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন যাস্ট অসাধারণ। গ্রাম্য আবহ সৃষ্টি , সেই আবহের পরিবর্তন পাঠকের হৃদয়স্পর্শ করতে বাধ্য।
লিখাটা ভালো লেগেছে।