গ্রামের স্মৃতিতে মিশে থাকা এক জীবন্ত উপাখ্যান

বর্ষায় ট্রলার ঘাট
ফজরের আজান শোনা যাচ্ছে বাজারের বড় মসজিদ থেকে। তারপর এক এক করে মুহূর্তের মধ্যে চারদিক থেকে আজান ভেসে আসতে থাকে। ধর্মপ্রাণ মানুষ নামাজের জন্য উঠে পড়েছে। এরপর হঠাৎ করে সাইরেন বেজে ওঠল। কয়েক মিনিট পর আবার সাইরেন। এভাবে ঢাকা হতে আগত লঞ্চ তার আগমনী জানান দিল। এবার যখন ঘাটে ভিড়বে তখন একটানা কয়েকবার টানা সাইরেন বেজে উঠল। এভাবে সকাল ৬ টা পর্যন্ত পাঁচটি লঞ্চ এমভি মানিক, শুভযাত্রা, মিতালি, স্বর্ণদ্বীপ, রিসান ঘাটে এসে ভিড়ে। ঢাকা হতে আগত যাত্রীরা এক এক করে নেমে পড়ে যার যার গন্তব্যে চলে যায়। এই ঘাটে স্থানীয় যাত্রী ছাড়াও, ভেদরগঞ্জ, ডামুড্ডা,গোসাইর হাট,মোল্লাবাজার, গরীবের চর, ডিএমখালি এমনকি জেলা সদরের যাত্রীরাও এই ঘাটে নামতেন। তারপর সেই হৈচৈ। যানবাহন চালকরা ফজরের পর থেকে সেই যাত্রী পরিবহনের জন্য দাড়িয়ে থাকতো এবং এক এক করে ঘাট একদম চুপচাপ হয়ে যেতো। এর পর ঘরের বউরা গুটিগুটি পায়ে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।সকালের জন্য খাবার তৈরি করার জন্য। কৃষকরা চলে যাচ্ছে মাঠে। ছোট ছোট শিশুরা চলে যাচ্ছে মক্তবে। এদের হাতে খাবার, কুরআন শরীফ, আমপাড়া। তারা ছুটে চলছে দল বেঁধে।
গতকাল রাতে যে মাছ ধরা নৌকাগুলো নদীতে মাছ ধরতে যায় তারা মাছ নিয়ে ঘাটে ফেরত এসেছে। ঘাটে আড়তদার মাছ কেনায় আর জেলেরা মাছ বিক্রিতে ব্যস্ত। এদিকে মুশকিল মোল্লার জালে বড় একটা পাঙ্গাস মাছ ধরা পড়েছে। ভালো দাম পাওয়ার আশায় সকাল ৭টায় ট্রলারে করে যায় চাঁদপুরে। জলিল মুসলমান নৌকা ঘাটে বসে আছে তার সঙ্গীরা আসলে একসঙ্গে খেতে কাজ করতে যাবে। তারা প্রতিদিন কাজ করে ৭০ টাকা পায়। সকাল ৮ টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কাজ করে।যাদের নিজের গাভী আছে তারা দুধ সংগ্রহ করে বাজারের উদ্দেশ্যে চলে যাচ্ছে। যারা তরকারির খেত করেছে তারা মাথায় করে সেই তরকারি বিক্রি করার উদ্দেশ্যে বাজারে রওনা দিয়েছে। এর মধ্যে বাড়ির ছেলে মেয়েরা সব উঠে পড়েছে তাদের গন্তব্য রান্নাঘরে। এতক্ষণে তাদের সকালের খাবার তৈরি হয়ে গেছে। এদিকে গায়ের বৌ ঝিরাও বের হয়ে পড়ছে মরিচ তুলতে। কেউ নিজের খেতে আবার কেউ অন্যের খেতে। যারা অন্যের খেতে তোলে, তারা যতটুকু তোলে তার ৫ ভাগের একভাগ নিজে মজুরি হিসেবে পায়। এতসময়ে ধরে একটি ঘাটের বর্ণনা দিলাম। শরীয়তপুর জেলার, ভেদরগঞ্জ উপজেলার, সখিপুর থানার, চরসেনসাস ইউনিয়নের, বালাকান্দি গ্রামের। সকালের প্রতিদিনের দৃশ্যটা প্রায় একই। এরপর আবার লঞ্চ ছাড়ার পালা এক এক করে সবকটি লঞ্চ ছেড়ে চলে যায় ঢাকার উদ্দেশ্য। এর ভিতর চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে ঘাট থেকে প্রতি আধা ঘন্টা পরপর ট্রলার ছেড়ে যায়। এতক্ষণ যেই ঘটনাগুলো বললাম। বেশিরভাগ ঘটনা ২০০৭ সালের আগের। তখন ৮ টা বাজলেই ছেলে মেয়েরা দল বেঁধে স্কুলের ছুটত। তারপর প্রথম শ্রেণি ও ২য় শ্রেণি ছুটি হলে ১২ টার দিকে যারা ক্লাস ৩ থেকে ৫ তারা যেত তাদের ছুটি হত ৪ টায়। আর মাধ্যমিকের ছাত্র- ছাত্রীরা সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত ক্লাস করত। বিকাল হলেই ছেলে মেয়েরা দল বেঁধে খেলতে বের হত। এদের মধ্যে কিছু ছেলে মেয়ে যেত খেতে কাজ করতে বা বাবা মাকে সাহায্য করার জন্য।

এখনকার চিত্র কিছুটা ভিন্ন গ্রামের উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে, এখন খেতে কাজ করার জন্য শ্রমিক পাওয়া দুষ্কর। সবাই মোটামুটিভাবে এখন সাবলম্বী। গ্রামের কাঁচা রাস্তা নেই, এখন ইটের রাস্তা।
আমাদের গ্রামের ঠিক উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। গ্রামের পাশ দিয়ে নদী বয়ে গেছে। একটি বিশাল বাজার, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় , একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটি জামে মসজিদ একটি কিন্ডারগার্ডেন আছে।
বালারবাজার
চরসেনসাস ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় বাজার। আগে সকাল বেলা শাক-সবজি, নদীর তাজা মাছ,গাভীর দুধ বেচাকেনা চলত। সপ্তাহে দুদিন হাট বসে। আগে মানুষ হাটের দিনের জন্য অপেক্ষা করত ভালমন্দ কেনার জন্য। স্টিলের জিনিসপত্র কেনার জন্য চাঁদপুর কিংবা ভেদরগঞ্জ যেতে হত। শুধুমাত্র হাটের দিন গরু জবাই করা হত।কিন্তু এখন বাজারের আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছে সবকিছু পাওয়া যায়। ফ্রিজ,টিভিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিস পাওয়া যায়। সারাদিন মানুষে বাজার গমগম করে। আগে রাত ৮টার পর দোকান খোলা পাওয়া যেত না এখন রাত ১১/১২ টা পর্যন্ত দোকান খোলা থাকে। শুধু আমাদের গ্রামের মানুষ না। এই বাজারে পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রাম থেকেও মানুষ হাটে আসে। মালের বাজার,ঈশানবালার বাজার,জিয়া কান্দি, চোকদার কান্দি, খালাশী কান্দি, ফেরিঘাট, মাঝি কান্দি, মাদবর কান্দিসহ অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের জন্য বালারবাজার দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, আসবাবপত্র, ইলেকট্রনিক সামগ্রী ক্রয়ের একমাত্র জায়গা। শরীয়তপুরের মধ্যে কাজির হাটের পর বালারবাজার ই সবচেয়ে বড় বাজার এখন। এই বাজারে রয়ে গেছে নানা রকম স্মৃতি। হাটের দিন আসলে বাজারে যাওয়ার জন্য বায়না ধরতাম। দাদার সঙ্গে বেশিরভাগ সময় যাওয়া হত। আব্বুর সঙ্গে খুব কম বাজারে যাওয়া হয়েছে। বাজারে আমার প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল পুরি।

৮ নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক বিদ্যালয়টি আমাদের গ্রামের বাতিঘর। টিন শেডের ঘরটি এখন দোতালা দুইটি বিল্ডিং হয়েছে।শিক্ষার মান দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তারাবুনিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত। উচ্চশিক্ষার মান বৃদ্ধিতে এই বিদ্যালয়টি এই অঞ্চলের মানুষের জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে হাজির হয়। এই বিদ্যালয়ে অনেক কৃতি শিক্ষার্থী বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। এই বিদ্যালয়ে আমার ৭ দিন ক্লাস করার সৌভাগ্য হয়েছিল। তারপর পারিবারিক কারণে বিদ্যালয়টি ছেড়ে চলে আসতে হয় জাদুর শহর ঢাকাতে।

আমাদের গ্রামে কোনো কলেজ নেই। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীরা সখিপুর,ডিএম খালি, ভেদরগঞ্জ, চাঁদপুর এবং ঢাকামুখী হয়।
আমাদের গ্রামটি ঠিক আগের মত নেই। নদী ভাঙনের শিকার হয়ে বিলিন হয়ে গেছে অনেক বাড়ি, ফসলি জমি, সেই সাথে আমার মত অনেক মানুষের শৈশবের স্মৃতি। আমার বেড়ে উঠা বাড়িটি ২০০৭ সালে নদী ভাঙনের কারণে বিলীন হয়ে যায়। বিশাল একটা বাড়ি। উঠনেই আমরা লং পিচ ক্রিকেট খেলতাম। বাগানে সারাদিন খেলাধুলায় মগ্ন থাকতাম। আমাদের সাথে পাড়ার অন্য ছেলে মেয়রাও খেলতে আসত। এখন এগুলো শুধুই স্মৃতি।
নদীর ভাঙন রোধ করার লক্ষ্যে নদীতে বাধ দেওয়ার ফলে এখন আর নদীতে তেমন স্রোত নেই। এজন্য শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি থাকে না। লঞ্চ ঘাটে বর্ষা বাদে লঞ্চ আসে না এখন আর, ট্রলার গুলো খুব কষ্টে মালামাল নিয়ে যাতায়াত করে।মাঝে মাঝে মানুষ এখন কোমড় পানিতে হেঁটে পার হয়। আগের মতো ঘাটে হৈচৈ, লঞ্চের সাইরেনে ঘুম ভাঙে না ঘুমন্ত শিশুদের। এখনো প্রধান জীবিকা কৃষি থাকলেও গ্রামের মানুষ এখন আর কেউ আগের মত কৃষির ওপর নির্ভরশীল নয়। মানুষজন শহরমুখী হচ্ছে এবং চাকরি করে পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করতেছে।
গ্রামের দুই একটা বিল্ডিং বাড়ি ছাড়া প্রায় ছিল কাচা বাড়ি।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ঐতিহ্য, নদীতে লাফজাপ, কানামাছি খেলা, দাড়িয়াবান্ধা হারিয়ে যাচ্ছে। আমার গ্রামের স্মৃতি কখনো ভুলে যাবার নয়। গ্রাম থেকে দূরে থাকি প্রায় ১৩ বছর। এক দুদিনের জন্য যাওয়া হয়। কিন্তু আজও স্মৃতিতে মিশে আছে গ্রামের মাঠ ঘাট, নদী, গ্রামের মানুষ, গ্রামের প্রতিটি ইঞ্চি মাটিতে। যেখানে আমি ঘুরে বেড়িয়েছি,খেলেছি, শৈশব কাটিয়েছি বেড়ে উঠেছি।
নদীর মোহনা
” আমার এ প্রাণ আজো নেচে উঠে হায়
সময় বদলায়, বদলায় প্রকৃতি
বদলায় জীবনের নানা গতি
ভুলে যাই কত কী, ভুলে যাই স্মৃতি
জন্মভূমি তুমি আমাকে করেছ ঋণী
যতকাল আমি রব বেঁচে এই পৃথিবীর মাঝে
জ্যোৎস্না রাতে, একা বসে নির্জন রাতে
তোমার আদর মাখা স্মৃতিতে ডুবে গিয়ে
যেনো বারবার তোমাতেই হারাতে চাই
প্রিয় জন্মভূমি তোমায় আমি অনেক ভালোবাসি “।
মিরাজ হোসেন সবুজ, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়