বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে পঞ্চকবির কবিতা

প্রতিকৃতি : শিল্পী মাসুক হেলাল
গাছ, কফিন এবং নৌকা
শামসুর রাহমান
একজন কাঠুরেকে স্বপ্নাদ্য একটি গাছ টানে
এবড়োখেবড়ো জমিনের সীমানায়,
যেখানে গাছটি অনাদরে উপেক্ষায় বেড়ে উঠে
মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে,
যেন বীর কর্ণ, যার রথের ভাস্বর চাকাদ্বয়
দেবে যাবে মাটিতে। কাঠুরে কুঠারের
আঘাতে আঘাতে গাছটিকে
কাঠে রূপান্তর করে ঘর্মাক্ত শরীরে।
একজন কাঠের মিস্তিরি বসে থাকে কয়েকটি
কাষ্ঠখণ্ড নিয়ে।
সে তার নিজের ছায়া বিছিয়ে দিয়েছে
কাঠের ওপর আর তিনটি খেয়ালি দাঁড়কাক
ছায়াটিকে দ্রুত খণ্ড খণ্ড করে ধারালো চঞ্চুতে, ছায়াটির
বিলাপে মিস্তিরি কফিনের রূপ দেখে, অবশেষে
তার শিল্পদক্ষতায় গড়ে ওঠে সাধারণ একটি কফিন
যার শূন্যতায় দীর্ঘশ্বাস, মরীচিকা, মর্সিয়ার পূর্বাভাস।
কফিনে পুরল ওরা, ঘাতকেরা, তাঁকে
অবহেলা আর অশ্রদ্ধায়,
অথচ মহত্ত্ব আর অমরত্ব, তাঁর দুই সহচর, তাঁর
উদ্দেশে করল নিবেদন অপরূপ শ্রদ্ধাঞ্জলি।
ঘাতকরা সে কফিনটিকে
নিষিদ্ধ দ্রব্যের মতো পাচার করতে চেয়েছিল
বিস্মৃতির বিয়াবানে আর সে কফিন
অলৌকিক প্রক্রিয়ায় একটি বিশাল
সন্তরণশীল নৌকা হয়ে ভাসমান সবখানে।
কাঠুরে ও কাঠের মিস্তিরি জনতার
বিপুল তরঙ্গে মিশে সবিস্ময়ে নৌকার আড়ালে
একটি সুদীর্ঘ গাছ, একটি কফিন
দেখে বুকে একরাশ উজ্জ্বলতা নিয়ে ঘরে ফেরে।
পনেরো আগস্ট
সৈয়দ শামসুল হক
এখনও রক্তের রঙ ভোরের আকাশে।
পৃথিবীও বিশাল পাখায় গাঢ় রক্ত মেখে
কবে থেকে ভাসছে বাতাসে।
অপেক্ষায়- শব্দের- শব্দেই হবে সে মুখর- আরো একবার
জয় বাংলা ধ্বনি লয়ে যখন সূর্যের আলো তার
পাখায় পড়বে এসে
ইতিহাস থেকে আরো কিছুক্ষণ পরে।
মানুষ তো ভয় পায় বাক্হীন মৃত্যুকেই,
তাই ওঠে নড়ে
থেকে থেকে গাছের সবুজ ডাল পাতার ভেতরে।
পাতাগুলো হাওয়া পায়,
শব্দ করে ওঠে আর খাতার পাতাও
ধরে ওঠে অস্থিরতা- কখন সে পাবে স্বর—
জয় বাংলা ঝড়- তাকে দাও
জন্মনাভি! বোঁটা থেকে দ্যাখো আজও
অভিভূত রক্ত যায় ঝরে
বাঙালির কলমের নিবের ভেতরে।
স্তব্ধ নয় ইতিহাস! বাংলাও সুদূরগামী
তেরোশত নদীর ওপরে ওই আজও তো নৌকোয়
রক্তমাখা জনকের উত্থান বিস্ময়!
হন্তারকদের প্রতি
শহীদ কাদরী
বাঘ কিংবা ভালুকের মতো নয়,
বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা হাঙরের দল নয়
না, কোনো উপমায় তদের গ্রেপ্তার করা যাবে না
তাদের পরনে ছিল ইউনিফর্ম
বুট, সৈনিকের টুপি,
বঙ্গবন্ধুর সাথে তাদের কথাও হয়েছিলো,
তারা ব্যবহার করেছিল
এক্কেবারে খাঁটি বাঙালির মতো
বাংলা ভাষা। অস্বীকার করার উপায় নেই ওরা মানুষের মতো
দেখতে, এবং ওরা মানুষই
ওরা বাংলা মানুষ
এর চেয়ে ভয়াবহ কোনো কথা আমি আর শুনবো না কোনোদিন।
আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি
নির্মলেন্দু গুণ
সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ
গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
শহিদ মিনার থেকে খসে-পড়া একটি রক্তাক্ত ইট গতকাল আমাকে বলেছে,
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
সমবেত সকলের মতো আমিও পলাশ ফুল খুব ভালোবাসি, ‘সমকাল’
পার হয়ে যেতে সদ্যফোটা একটি পলাশ গতকাল কানে কানে
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
শাহবাগ এ্যভিন্যুর ঘূর্ণায়িত জলের ঝরনাটি আর্তস্বরে আমাকে বলেছে,
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
সমবেত সকলের মতো আমারো স্বপ্নের প্রতি পক্ষপাত আছে,
ভালোবাসা আছে_ শেষ রাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন গতকাল
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
এই বসন্তের বটমূলে সমবেত ব্যথিত মানুষগুলো সাক্ষী থাকুক,
না-ফোটা কৃষ্ণচূড়ার শুষ্কভগ্ন অপ্রস্তুত প্রাণের ঐ গোপন মঞ্জরীগুলো কান পেতে শুনুক,
আসন্ন সন্ধ্যার এই কালো কোকিলটি জেনে যাক—
আমার পায়ের তলায় পুণ্য মাটি ছুঁয়ে
আমি আজ সেই গোলাপের কথা রাখলাম, আজ সেই পলাশের কথা
রাখলাম, আজ সেই স্বপ্নের কথা রাখলাম।
আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি,
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিলাম।
সেই কবিতাটি লেখা হয় নাই
মহাদেব সাহা
সেই কবিতাটি লেখা হয় নাই
লিখবেন কোন কবি
সেই কবিতাটি কবিতা তো নয়
মুজিবের মুখচ্ছবি।
সেই কবিতাটি লেখা হবে ঠিক
কালি ও কাগজে নয়
হৃদয়ে হৃদয়ে লেখা হবে সেই
অমর পংক্তিচয়!
সেই কবিতাটি পড়বে দাঁড়িয়ে
মানুষের সাথে পাখি
সেই কবিতাটি শাপলা গোলাপ
দীঘিরও পদ্ম নাকি?
সেই কবিতাটি লেখা হয় নাই
লিখবেন এক কবি,
হয়তো তা কোন কবিতাই নয়
একটি মুখের ছবি।
সেই কবিতাটি পড়া হবে ঠিক
বাংলার ঘরে ঘরে
সেই কবিতাটি দুফোঁটা অশ্র“
মানুষের অন্তরে।