স্মরণে : কবি, গীতিকার ও সাংবাদিক সিকান্দার আবু জাফর

বাংলা সাহিত্যে অন্যতম কবি, গীতিকার ও সাংবাদিক সিকান্দার আবু জাফর। পূর্ণ নাম সৈয়দ আল্ হাশেমী আবু জাফর মুহম্মদ বখত সিকান্দার। আদি নিবাস ছিল পাকিস্তানের পেশোয়ারে। সেখান থেকে তাঁর পিতামহ মাওলানা সৈয়দ আলম শাহ হাশেমী ওই গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। তিনি ১৯১৯ সালের ১৯ মার্চ সাতক্ষীরার তেঁতুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
স্থানীয় স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি কলকাতার রিপন কলেজে পড়েন। ১৯৪১ সালে তিনি কাজী নজরুল ইসলামের নবযুগ পত্রিকায় যোগ দেন। এছাড়া দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক মিল্লাত-এ চাকরি করতেন। আমাদের সংগ্রাম চলবেই তার রচনা বিখ্যাত গান। দেশবিভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। পঞ্চাশের দশকে রেডিও পাকিস্তানের শিল্পী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি সাহিত্য পত্রিকা ‘সমকাল’-এর প্রকাশক ও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এই পত্রিকার পাতায় পাতায় তাঁর রুচি ও সাহসের পরিচয় মুদ্রিত আছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ‘বাঙলা ছাড়ো’, ‘জনতার সংগ্রাম’ কিংবা ‘আমার অভিযোগ’-এর মতো রচনা নানাভাবে প্রেরণা জুগিয়েছে।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ: উপন্যাস পূরবী (১৯৪১), নতুন সকাল (১৯৪৬); ছোটগল্প মাটি আর অশ্রু (১৯৪২); কবিতা প্রসন্ন শহর (১৯৬৫), তিমিরান্তিক (১৯৬৫), বৈরী বৃষ্টিতে (১৯৬৫), বৃশ্চিক-লগ্ন (১৯৭১), বাংলা ছাড়ো (১৯৭১); নাটক সিরাজ-উদ-দৌলা (১৯৬৫), মহাকবি আলাউল (১৯৬৬); সঙ্গীত মালব কৌশিক (১৯৬৬)।
আবু জাফর অনুবাদক হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। তার কয়েকটি অনূদিত গ্রন্থ: যাদুর কলস (১৯৫৯), সেন্ট লুইয়ের সেতু (১৯৬১), রুবাইয়াৎ : ওমর খৈয়াম (১৯৬৬) ইত্যাদি।
তিনি নাটকে বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৬) এবং একুশে পদক (১৯৮৪, মরণোত্তর) লাভ করেন।
৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ১৯৭৫ সালের ৫ আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
বইচারিতার চিরায়ত বিভাগে তাঁর স্মরণে তাঁর লেখা কয়েকটি কবিতা ও গান নিবেদন করা হলো-
বাংলা ছাড়ো
রক্তচোখের আগুন মেখে ঝলসে যাওয়া আমার বছরগুলো
আজকে যখন হাতের মুঠোয় কণ্ঠনালীর খুন পিয়াসী ছুরি
কাজ কি তবে আগলে রেখে বুকের কাছে কেউটে সাপের ঝাপি
আমার হাতেই নিলাম আমার নির্ভরতার চাবি
তুমি আমার আকাশ থেকে সরাও তোমার ছায়া
তুমি বাংলা ছাড়ো
অনেক মাপের অনেক জুতোর দামে তোমার হাতে
দিয়েছি ফুল হৃদয় সুরভিত
সে ফুল খুঁজে পায়নি তোমার চিত্তরসের ছোঁয়া
পেয়েছে শুধু কঠিন জুতোর তলা
আজকে যখন তাদের স্মৃতি অসন্মানের বিষে
তিক্ত প্রানে শ্বাপদ নখের জ্বালা
কাজ কি চোখের প্রসন্নতায় লুকিয়ে রেখে প্রেতের অট্টহাসি
আমার কাঁধেই নিলাম তুলে আমার যত বোঝা
তুমি আমার বাতাস থেকে মুছো তোমার ধূলো
তুমি বাংলা ছাড়ো
একাগ্নতার স্বপ্ন বিনিময়ে মেঘ চেয়েছি
ভিজিয়ে নিতে যখন পোড়া মাটি
বারে বারেই তোমার খরা আমার খেতে বসিয়ে গেছে ঘাঁটি
আমার প্রীতি তোমার প্রতারনা
যোগ বিয়োগে মিলিয়ে
নিলে তোমার লাভের জটিল অন্কগুলো
আমার কেবল হাড় জুড়ালো হতাশ শ্বাসের ধূলো
আজকে যখন খুঁড়তে গিয়ে নিজের কবরখানা
আপন খুলির কোদাল দেখে সর্বনাশা বজ্র দিয়ে গড়া
কাজ কি দ্বিধায় বিষন্নতায় বন্দী রেখে ঘৃনার অগ্নিগিরি
আমার বুকেই ফিরিয়ে নেব ক্ষীপ্ত বাঘের থাবা
তুমি আমার জল স্থলের মাদুর থেকে নামো
তুমি বাংলা ছাড়ো
সংগ্রাম চলবেই
জনতার সংগ্রাম চলবেই,
আমাদের সংগ্রাম চলবেই।
হতমানে অপমানে নয়, সুখ সম্মানে
বাঁচবার অধিকার কাড়তে
দাস্যের নির্মোক ছাড়তে
অগণিত মানুষের প্রাণপণ যুদ্ধ
চলবেই চলবেই,
আমাদের সংগ্রাম চলবেই।
প্রতারণা প্রলোভন প্রলেপে
হ’ক না আঁধার নিশ্ছিদ্র
আমরা তো সময়ের সারথী
নিশিদিন কাটাবো বিনিদ্র।
দিয়েছি তো শান্তি আরও দেবো স্বস্তি
দিয়েছি তো সম্ভ্রম আরও দেবো অস্থি
প্রয়োজন হ’লে দেবো একনদী রক্ত।
হ’ক না পথের বাধা প্রস্তর শক্ত,
অবিরাম যাত্রার চির সংঘর্ষে
একদিন সে-পাহাড় টলবেই।
চলবেই চলবেই
আমাদের সংগ্রাম চলবেই
মৃত্যুর ভর্ৎসনা আমরা তো অহরহ শুনছি
আঁধার গোরের ক্ষেতে তবু তো’ ভোরের বীজ বুনছি।
আমাদের বিক্ষত চিত্তে
জীবনে জীবনে অস্তিত্বে
কালনাগ-ফণা উৎক্ষিপ্ত
বারবার হলাহল মাখছি,
তবু তো ক্লান্তিহীন যত্নে
প্রাণে পিপাসাটুকু স্বপ্নে
প্রতিটি দণ্ডে মেলে রাখছি।
আমাদের কি বা আছে
কি হবে যে অপচয়,
যার সর্বস্বের পণ
কিসে তার পরাজয় ?
বন্ধুর পথে পথে দিনান্ত যাত্রী
ভূতের বাঘের ভয়
সে তো আমাদের নয়।
হতে পারি পথশ্রমে আরও বিধ্বস্ত
ধিকৃত নয় তবু চিত্ত
আমরা তো সুস্থির লক্ষ্যের যাত্রী
চলবার আবেগেই তৃপ্ত।
আমাদের পথরেখা দুস্তর দুর্গম
সাথে তবু অগণিত সঙ্গী
বেদনার কোটি কোটি অংশী
আমাদের চোখে চোখে লেলিহান অগ্নি
সকল বিরোধ-বিধ্বংসী।
এই কালো রাত্রির সুকঠিন অর্গল
কোনোদিন আমরা যে ভাঙবোই
মুক্ত প্রাণের সাড়া জানবোই,
আমাদের শপথের প্রদীপ্ত স্বাক্ষরে
নূতন সূর্যশিখা জ্বলবেই।
চলবেই চলবেই
আমাদের সংগ্রাম চলবেই।
মানা
হাটে-মাঠে-গঞ্জে-ঘাটে সুদূর গাঁয়ের পথে
নদীর তীরে, বালুর চরে, সমুদ্র সৈকতে
ছড়িয়ে আছে জীবন যেন আনন্দে আটখানা
তুমিই যে তার ভাগ নেবে না তোমার শুধু মানা।
ও-জঙ্গলে দোয়েল নাচে, শালিক ডাকে গাছে
ঘুঘুর ছানা মিটমিটিয়ে হয়তো চেয়ে আছে
বুলবুলিটার লাল টুপিটা দেখার নেশায় মেতে,
টুনটুনি-বৌ আবাক হয়ে রাখে দু চোখ পেতে,
ও-জঙ্গলে বাতাস মিঠে, মিঠে ফুলের হাসি
তারও চেয়ে মধুর মিঠে বাঁশের পাতার বাঁশি
তবুও তোমার ও-দিকটাতে যেতে বিষম মানা,
ছাতিম গাছে লুকিয়ে আছে মুণ্ডু কাটা ডানা।
সাগর দিঘির তীরে তীরে ধান সবুজের মেলা
কচি ধানের হাজার শীষে সোনা রোদের খেলা।
ফড়িং-পায়ের নাচন কেড়ে নাচে মেঘের মায়া।
জল-পুকুরে আকাশ দেখে নিজের সুনীল কায়া।
মাছরাঙা তার রাঙা ঠোঁটের পরখ করে ধার
সাগর-দিঘির চতুর্দিকে খোলা খুশির দ্বার,
তবু তোমার ও-দিকটাতে যেতে বিষম মানা
জলের দানো হঠাৎ রেগে দিতেই পারে হানা।
দক্ষিণে যাও বারণ আছে, পশ্চিমে যাও মানা
উত্তরে যাও নিষেধ আছে, পুবে আগল টানা।
সবাই যখন হাসে-খেলে বন্ধ তোমার খেলা
একলা তোমার চতুর্দিকেই ভয়ের থাবা মেলা।
পালিয়ে যাবে কেবল তখন হার মেনে সব মানা
তুমি যখন সাহস করে হবে হার-না-মানা।
গতানুগতিক
আমার জবাব পেলাম।
তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি কিনা?
না!
আমরা যে সমাজের জীব
তারই ধারায় তুমি ভাসমান তৃণ।
ইতিহাস পরিবর্তনের দিন এলে
হৃদয় নিয়ে তুমি খেলবেনা,
আমি জানি।