কবি আবুল হাসানের ৫টি কবিতা

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি আবুল হাসান। প্রকৃত নাম আবুল হোসেন মিয়া। তিনি ১৯৪৭ সালের ৪ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার বর্ণি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস পিরোজপুরের নাজিরপুরের ঝনঝনিয়া গ্রামে। বাবা আলতাফ হোসেন মিয়া ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার। ঢাকার আরমানিটোলা সরকারি বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ সালে এসএসসি পাস করেন আবুল হাসান। পরে বরিশালের বিএম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে বিএ শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু পরীক্ষা শেষ না করেই ১৯৬৯ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা বিভাগে যোগদান করেন। পরে তিনি গণবাংলা (১৯৭২-৭৩) এবং দৈনিক জনপদে (১৯৭৩-৭৪) সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। আবুল হাসান অল্প বয়সেই একজন সৃজনশীল কবি হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন। মাত্র এক দশকের কাব্যসাধনায় তিনি আধুনিক বাংলা কাব্যের ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেন। আত্মত্যাগ, দুঃখবোধ, মৃত্যুচেতনা, বিচ্ছিন্নতাবোধ, নিঃসঙ্গচেতনা, স্মৃতিমুগ্ধতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আবুল হাসানের কবিতায় সার্থকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯৭০ সালে এশীয় কবিতা প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম হন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রাজা যায় রাজা আসে (১৯৭২), যে তুমি হরণ করো (১৯৭৪) ও পৃথক পালঙ্ক (১৯৭৫)। মৃত্যুর পর কাব্যনাট্য ওরা কয়েকজন (১৯৮৮) ও আবুল হাসান গল্প-সংগ্রহ (১৯৯০) প্রকাশিত হয়। তিনি কবিতার জন্য মরণোত্তর ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ (১৯৭৫) এবং ‘একুশে পদক’ (১৯৮২) লাভ করেন। ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর মাত্র ২৮ বছর বয়সে আবুল হাসান মৃত্যুবরণ করেন।
কবি আবুল হাসানের জন্মদিনে তাঁর স্মরণে বইচারিতা চিরায়ত লেখা বিভাগে তাঁর লেখা ক’টা কবিতা আমরা নিবেদন করছি—
উচ্চারণগুলি শোকের
লক্ষ্মী বউটিকে আমি আজ আর কোথাও দেখি না,
হাঁটি হাঁটি শিশুটিকে কোথাও দেখি না,
কতগুলি রাজহাঁস দেখি
নরম শরীর ভরা রাজহাঁস দেখি,
কতগুলি মুখস্থ মানুষ দেখি, বউটিকে কোথাও দেখি না
শিশুটিকে কোথাও দেখি না!
তবে কি বউটি রাজহাঁস?
তবে কি শিশুটি আজ সবুজ মাঠের সূর্য, সবুজ আকাশ?
অনেক যুদ্ধ গেলো,
অনেক রক্ত গেলো,
শিমুল তুলোর মতো সোনারূপো ছড়ালো বাতাস।
ছোটো ভাইটিকে আমি কোথাও দেখি না,
নরোম নোলক পরা বোনটিকে আজ আর কোথাও দেখি না!
কেবল পতাকা দেখি,
কেবল উৎসব দেখি,
স্বাধীনতা দেখি!
তবে কি আমার ভাই আজ ঐ স্বাধীন পাতাকা?
তবে কি আমার বোন তিমিরের বেদীতে উৎসব?
রক্তের মুখ
আহত শাবক শেষে আউড়ে নিল রক্তের ক্লিষ্ট ধ্রুপদী
নিহত রক্তের স্রোতে শেষবার দেখে নিল পৃথিবীর মুখ
উত্তপ্ত দেহের গায়ে এঁকে নিয়ে স্থিতির সুখ
প্রার্থনায় আওড়ালে, ওহে প্রভু আর একটু বেচে থাকি যদি…
আর বানরের শেষ দৃশ্যে বনমোরগের দুটো পাখা
উড়ন্ত বিলাসে তার নায়কের কথা তুলে নিয়ে
প্রত্যুত্তরে জানালো সে প্রতিবাদে, কেঁপে গেল জারুলের শাখা
(কী হবে স্বর্গে গিয়ে এইসব নৃত্য ছেড়ে দিয়ে?)
শাবক শেষের গানে পিতৃত্বের দামেই বরং
ডেকে গেল প্রভুকেই ভেবে নিয়ে শিকারির উল্লসিত লোভের মাতলামি
মুখ দিয়ে ঘসে নিল ঘাসের সবুজ সেই রঙ
নিহত রক্তের স্রোতে থেকে গেল তার সেই সন্ধ্যা প্রণামী।
কাছে কিছু পিঁপড়ের মুখ দিয়ে শেষ সূর্যের মতো
বের হল সমবেদনার এক সততার কথা
মানুষ বর্বরই শেষে ভোল সে পরুক না যত
অণুর নৃত্যে তার পশুত্বের হেঁয়ালি বারতা।
অসভ্য দর্শন
দালান উঠছে তাও রাজনীতি, দালান ভাঙছে তাও রাজনীতি,
দেবদারু কেটে নিচ্ছে নরোম কুঠার তাও রাজনীতি,
গোলাপ ফুটছে তাও রাজনীতি, গোলাপ ঝরছে তাও রাজনীতি!
মানুষ জন্মাচ্ছে তাও রাজনীতি, মানুষ মরছে তাও রাজনীতি!
বোন তার বেণী খুলছে যৌবনের অসহায় রোদে মুখ নত করে
বুকের ভ্রমর হাতে রাখছে লুকিয়ে —তাও রাজনীতি
তরুণেরা অধঃপাতে যাচ্ছে তাও রাজনীতি পুনরায়
মারামারি যুদ্ধ আর অত্যাচার, হত্যার আগ্রাসী খুন মানুষের
ছড়ানো বীর্যের ব্যথা, বিষন্ন মিথুন
মহিলার রক্তের ভেতরে ভ্রুন, সমস্যার ছদ্মবেশে আবার আগুন উর্বর হচ্ছে, রাজনীতি, তাও রাজনীতি!
আমি পকেটে দুর্ভিক্ষ নিয়ে একা একা অভাবের রক্তের রাস্তায় ঘুরছি
জীবনের অস্তিত্বে ক্ষুধায় মরছি রাজনীতি, তাও রাজনীতি আর
বেদনার বিষবাষ্পে জর্জরিত এখন সবার চতুর্দিকে খাঁ, খাঁ, খল,
তীব্র এক বেদেনীর সাপ খেলা দেখছি আমি; রাজনীতির তাও কি রাজনীতি?
আমি অনেক কষ্টে আছি
আমার এখন নিজের কাছে নিজের ছায়া খারাপ লাগে
রাত্রিবেলা ট্রেনের বাঁশি শুনতে আমার খারাপ লাগে
জামার বোতাম আঁটকাতে অমন কেন যত্ন করে
লাগিয়ে দিতে?
অমন কেন শরীর থেকে আসতে আমার
ক্লান্তিগুলো উঠিয়ে নিতে?
তোমার বুকের নিশিথ কুসুম আমার মুখে ছড়িয়ে দিতে?
জুতোর ফিতে প্রজাপতির মতন তুমি উড়িয়ে নিতে?
বেলজিয়ামের আয়নাখানি কেন তুমি ঘোর না রেখে
অমন কারুকাজের সাথে তোমার দুটি চোখের মধ্যে
রেখে দিতে?
রেখে দিতে?
আমার এখন চাঁদ দেখতে খারাপ লাগে
পাখির জুলুম, মেঘের জুলুম, খারাপ লাগে!
কথাবার্তায় দয়ালু আর পোশাকে বেশ ভদ্র মানুষ
খারাপ লাগে,
এই যে মানুষ মুখে একটা মনে একটা…
খারাপ লাগে
খারাপ লাগে
মোটের উপর আমি এখন কষ্টে আছি,
কষ্টে আছি বুঝলে যুথী
আমার দাঁতে আমার নাকে, আমার চোখে কষ্ট ভীষণ
চতুর্দিকে দাবী আদায় করার মতো মিছিল তাদের কষ্ট
ভীষণ
বুঝলে যুথী,
হাসি খুশি উড়নচণ্ডী মানুষ আমার তাইতো এখন
খারাপ লাগে
খারাপ লাগে
আর তাছাড়া আমি কি আর যীশু না হাবিজাবি
ওদের মতো সব সহিষ্ণু?
আমি অনেক কষ্টে আছি, কষ্টে আছি;
কষ্টে আছি আমি অনেক।
আহত আঙ্গুল
আহত এই আঙ্গুল, তাতে ক্ষত বেরোয়
ক্ষত তো নয় পোকা
পাশ ফিরে শোয় পবিত্র পুঁজি
অমল থোকা থোকা!
পাশ ফিরে শোয় আঙ্গুলগুলি:
সুযন্ত্রণার সুখে:
দরবেশেরই মতোন ওরা আমারই সম্মুখে
আহত হয়, আহত হয় আর
গলিত এক পুঁজের ঝর্ণা তার
মন্ত্রবলে মলিন বেদনায়
আহত এই আহত আঙ্গুল যে
রক্তে ভাসে, রক্তে ভেসে যায়
—রক্তেঝরা ফুল!
জীবন এত অবাধ্য সঙ্কুল
নেয় না তুলে সন্ধিও, শান্তিকে!
আঙ্গুলে তাই আহত এক ক্ষরা
কেবল ঢালে পুঁজের ঘড়া ঘড়া
অশান্তির এই মোহ!
কিন্তু তাকে আর কে করে পান
কুযন্ত্রণার মুখে?
আমার মাঝে মোহিনী একখান
ঈশ্বরের গান
ভেঙ্গেছে সেই দুখে!
একটা কিছু মারাত্মক
একটা কিছু মারাত্মক ঘটছে কোথাও
নইলে ডাইনীর মতন কেন কোমর বাঁকানো
একটি চাঁদ উঠবে জ্যোৎস্নায়
উলুকঝুলুক গাছ,
এখানে সেখানে,
সবদিকে
কেন এত রক্তপাত হবে? গুপ্তহত্যা হবে?
কেন জীবনের দ্রব্যমূল্য বাড়বে এত শনৈঃ শনৈঃ
কেন ফুরাবে এমন আমাদের পকেটে সিগ্রেট,
খাদ্য, রূপালী আত্মার ঘ্রাণ রমণী ও টাকা?
একটা কিছু মারাত্মক ঘটছে কোথাও
নইলে কেন পাওয়া যায় না প্রেমিকা?
কেন মোমের আলোর শিখা আজকাল
ধীরে জ্বলে,
ধীরে জ্বলে, মাঝরাতে
মহিলার শাড়ি কেন সভ্যতার শোভার মতন
খুলে যায়
নেমে যায়, আজকাল
কেন এত সহজেই ভেঙে পড়ে কালো চোখ, কোমল যৌবন?
একটা কিছু মারাত্মক ঘটছে কোথাও
নইলে কিশোর চেনে না কেন ঘাস ফুল? ঘাস কেন সবুজের বদলে হলুদ?
একটা কিছু মারাত্মক ঘটছে কোথাও
নইলে নয়টি অমল হাঁস
থেঁতলে যায় ট্রাকের চাকায়?
ভালোবাসা, কেবলি… কেবল একটি
বাজেয়াপ্ত শব্দের তালিকা হয়?
একটা কিছু মারাত্মক ঘটেছে কোথাও
নইলে মানুষের দরোজায় টোকা দিলে কেন আজ দরোজা খোলে না?
‘বৃষ্টি হলে গা জুড়োবে’ কেউ কেন বলেনা এখন?
খুউব খুউব ভালো লাগ।