কবি সুফিয়া কামালের কবিতাগুচ্ছ

আজ কবি সুফিয়া কামালের ১১০ জন্মবার্ষিকী। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বইচারিতার চিরায়ত লেখা বিভাগে থাকছে তাঁর কিছু কবিতা।
তাহারেই পড়ে মনে
“হে কবি! নীরব কেন-ফাল্গুন যে এসেছে ধরায়,
বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?”
কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি-
“দখিন দুয়ার গেছে খুলি?
বাতাবী নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল?
দখিনা সমীর তার গন্ধে গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল?”
“এখনো দেখনি তুমি?” কহিলাম “কেন কবি আজ
এমন উন্মনা তুমি? কোথা তব নব পুষ্পসাজ?”
কহিল সে সুদূরে চাহিয়া-
“অলখের পাথার বাহিয়া
তরী তার এসেছে কি? বেজেছে কি আগমনী গান?
ডেকেছে কি সে আমারে? -শুনি নাই,রাখিনি সন্ধান।”
কহিলাম “ওগো কবি, রচিয়া লহ না আজও গীতি,
বসন্ত-বন্দনা তব কণ্ঠে শুনি-এ মোর মিনতি।”
কহিল সে মৃদু মধুস্বরে-
“নাই হ’ল, না হোক এবারে-
আমার গাহিতে গান! বসন্তরে আনিতে ধরিয়া-
রহেনি,সে ভুলেনি তো, এসেছে তো ফাল্গুন স্মরিয়া।”
কহিলাম “ওগো কবি, অভিমান করেছ কি তাই?
যদিও এসেছে তবু তুমি তারে করিলে বৃথাই।”
কহিল সে পরম হেলায়-
“বৃথা কেন? ফাগুন বেলায়
ফুল কি ফোটে নি শাখে? পুষ্পারতি লভে নি কি ঋতুর রাজন?
মাধবী কুঁড়ির বুকে গন্ধ নাহি? করে নি সে অর্ঘ্য বিরচন?”
“হোক, তবু বসন্তের প্রতি কেন এই তব তীব্র বিমুখতা?”
কহিলাম “উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা?”
কহিল সে কাছে সরি আসি-
“কুহেলী উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে। তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোন মতে।”
মিটাতে জঠর ক্ষুধা
অন্তর তৃষা মিটাতে এনেছে মমতার মধু-সুধা?
রিক্তের প্রাণ ভরিবে কি আজ পুণ্যের আশ্বাসে?
অবহেলিতেরে ডেকে নেবে ঘরে, তাদের দীর্ঘশ্বাসে।
ব্যথিত মনের সম বেদনায় দূর করি দিয়ে প্রাণ
জুড়াবে, শুনাবে ভরসায় ভরা আগামী দিনের গান?
হে কাফেলা! তুমি চল পাঁওদল কাঁধেতে মিলায়ে কাঁধ,
পথে পথে আজ চলিছে যাহারা তাহাদের সংবাদ
লও, শোনো ঘরে কার
আজও আছে অনাহার,
তবুও ভিক্ষা মাগিতে এ পথে বাহির হবে না আর।
কত সে মাতার সন্তান আজও রহিয়াছে কারাগারে-
শোন ফরিয়াদ, মাথা কুটে বারে বারে
পাষাণ প্রাচীর ভাঙ্গিতে পারেনি যারা
ঈদের খুশী কি ঘরে আনিয়াছে তারা?
তাদের অশ্রু মুছাতে তোমরা যাত্রীরা কর পণ,
আজকে দিনের শপথ রহুক বেদনায় ভরা মন।
উৎসব তোলো সার্থক করে তাহাদের আঁখিজল
মুছায়ে, আবার আগামী দিনেতে মেলি আনন্দ দল।
জন্মেছি এই দেশে
অনেক কথার গুঞ্জন শুনি
অনেক গানের সুর
সবচেয়ে ভাল লাগে যে আমার
‘মাগো’ ডাক সুমধুর।
আমার দেশের মাঠের মাটিতে
কৃষাণ দুপুরবেলা
ক্লান্তি নাশিতে কন্ঠে যে তার
সুর লয়ে করে খেলা।
মুক্ত আকাশে মুক্ত মনের
সেই গান চলে ভেসে
জন্মেছি মাগো তোমার কোলেতে
মরি যেন এই দেশে।
এই বাংলার আকাশ-বাতাস
এই বাংলার ভাসা
এই বাংলার নদী, গিরি-বনে
বাঁচিয়া মরিতে আশা।
শত সন্তান সাধ করে এর
ধূলি মাখি সারা গায়
বড় গৌরবে মাথা উচু করি
মানুষ হইতে চায়।
প্রার্থনা
তুলি দুই হাত করি মোনাজাত
হে রহিম রহমান
কত সুন্দর করিয়া ধরণী
মোদের করেছ দান,
গাছে ফুল ফল
নদী ভরা জল
পাখির কন্ঠে গান
সকলি তোমার দান৷
মাতা, পিতা, ভাই, বোন ও স্বজন
সব মানুষেরা সবাই আপন
কত মমতায় মধুর করিয়া
ভরিয়া দিয়াছ প্রাণ৷
তাই যেন মোরা তোমারে না ভলি
সরল সহজ সত্ পথে চলি
কত ভাল তমি, কত ভালোবাস
গেয়ে যাই এই গান৷
পথ নহে অন্তহীন
প্রসন্ন প্রভাতে আজি যাত্রা শুরু কর হে কাফেলা!
সম্মুখে আলোকদীপ্ত বেলা।
দূর পথ প্রসারিত, দিকে দিকে চঞ্চল জীবন।
আঁধার নির্মোক হতে কর উন্মোচন
গতিময় দৃপ্ত প্রাণাবেগ,
ভেদ করি সংশয়ের মেঘ
চলো চলো যাত্রাপথে, সম্মুখে অনন্ত সম্ভাবনা!
পথে পথে যদি দেয় হানা
খল মুষিকের দল, তবু চলো চলো হে কাফেলা!
তোমারে দেখাবে পথ দীপ্ত রাঙ্গা উদয়ের বেলা।
আবারও নামিবে রাত্রি, তবু দ্বিধা করিয়ো না আর,
রুদ্ধ করিয়ো না গতি, লক্ষ্য দৃঢ় রাখিয়ো তোমার
মনযিল-ই-মোকসেদে তুমি উপনীত হবে একদিন,
দুর্বার রাখিয়ো গতি! পথ কভু নহে অন্তহীন।
হে কাফেলা! যাত্রা করো! মনযিলে মনযিলে যাও বলে
আজি এ প্রভাতে আলোকের পথে ঈদগার পথে চলে
খুশী ভরা ক-টি প্রাণ
কটি আনন্দের গান
স্বার্থ বিহীন অন্তর নিয়ে ক-টি জন করে আজি দান।
ইতল বিতল
ইতল বিতল গাছের পাতা
গাছের তলায় ব্যাঙের ছাতা।
বৃষ্টি পড়ে ভাঙে ছাতা
ডোবায় ডুবে ব্যাঙের মাথা।