সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ থেকে ‘গেরিলা’— কলম থেকে ক্যামেরা

গত সপ্তাহে একটা গল্প লিখেছি। সেটা নিয়ে শর্টফিল্ম করার পরিকল্পনা ছিল। কাছের কয়েকজনের সাথে টুকটাক কথাবার্তা বলেছি। এদের মধ্যে দুর্গ ব্যান্ডের লিড ভোকালিস্ট ফারাবীর কথা বলতে হচ্ছে আলাদাভাবে। গল্পটা পড়ে তার ভাষ্যের সারাংশ – লেখাকে ধরে ধরে ক্যামেরায় আনা হলেও মানুষ টের পায় না। পড়ার সময়ই যার যতটুকু বোঝার, ততটুকু বুঝে পড়ে।
কলম-ক্যামেরা – দুইই শিল্প-সাহিত্যের শক্তিশালী মাধ্যম। কিন্তু এককভাবে দুইয়েরই কার্যকারিতা গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয় হতে পারে।
সৈয়দ শামসুল হক ১৯৭৯ সালে লিখলেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’। ছোটো কলেবরের এ লেখাটি চিরায়তের পর্যায়ে চলে গেছে এর পট বিবেচনায়। অনার্স ভর্তি পরীক্ষা, চাকরির পরীক্ষায় আসা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের তালিকায় ওপরের দিকে থাকে ‘নিষিদ্ধ লোবান’ এবং মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ। প্রথম প্রকাশের তিরিশ বছরের মাথায় নাসিরুদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু নির্মাণ করলেন ‘গেরিলা’ ছবিটি। ছবির কাহিনী ‘নিষিদ্ধ লোবান’ অবলম্বনে। তবে হুবহু উপন্যাসের চিত্ররূপ হয়ে ওঠেনি। এখানেই নির্মাতার সার্থকতা। উপন্যাসের চরিত্রের দৃষ্টিকোণও কিছুটা পাল্টে দিয়ে নির্মাণে মৌলিকতার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। ‘নিষিদ্ধ লোবানে’ আমরা একজন ভাইহারা বোনকে পাই। অথচ ছবিতে সেই বোন অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে একই চরিত্রে একজন বিধবা স্ত্রীর অস্ফুট আর্তনাদের নিচে। মোটাদাগে এ দুই সৃষ্টিতে আমরা লেখক এবং নির্মাতার দৃষ্টিভঙ্গিগত বিপ্রতীপ সংঘর্ষ উপলব্ধি করি। ফলশ্রুতিতে ছবির নির্মাণ হয়েছে কাহিনীর সমসাময়িক ঢাকা শহরকেন্দ্রিক। তাতে যদিও বোন হিসেবে বিলকিসের আবেগ লুকোছাপার চেষ্টা ছিল না, তবু যেন কোথায় কী বাদ পড়ে গেছে মনে হয়।
বাইরের ইন্ডাস্ট্রির সিনেমাগুলোয় পরাবাস্তবতার চিত্রায়ণ যতটা দেখা যায়, বাংলাদেশে ২০১১ সালের প্রেক্ষাপটে সেটা কতটা সম্ভব ছিল, এক্ষেত্রে তা বিবেচ্য। একজন লেখক এক্ষেত্রে সময়নিরপেক্ষভাবে স্বাধীন। সৈয়দ শামসুল হককে ত আর এমনিতেই ‘সব্যসাচী লেখক’ বলা হয় না! তিনি এ লেখায় শেয়াল, কুকুরের উপস্থিতির সময়কার মানবীয় মনস্তত্ত্ব নিয়ে যে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন, তা আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে চিত্রায়িত করা গেলেও সে মানের দর্শক আমরা এখনো তৈরি করতে পারিনি। বেড়ালের পদক্ষেপের সাথে মানবীয় সাবধানতার তুলনায় যে ভয়ভাব তথা ভয়ানকরস —তা সিঞ্চন করতে আমরা সিনেমা হলে কতটা প্রস্তুত থাকি তা ভাববার বিষয়।
সমসাময়িক ঢাকার কাহিনী তুলে ধরায় বুদ্ধিজীবীনিধনের বাস্তবতা সিনেমায় উঠে এসেছে যা উপন্যাসে উপেক্ষিতই ছিল। একইভাবে তৎকালীন জামায়াতে ইসলামের নারীকর্মীদের সক্রিয়তা সিনেমায় এলেও আসেনি বিহারীদের উন্মত্ত নির্মমতার নিদর্শন।
যুদ্ধকালীন জীবনবাস্তবতা তুলে ধরতে ঔপন্যাসিক এবং নির্মাতা উভয়ে যে যার জায়গা থেকে সেরা। উপন্যাসে ‘আপা, এখন কে কাকে দেখবে?’ —এ প্রশ্নের সাথে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সম্পর্ক সহজেই অনুমেয়। অথবা সিনেমায় মিষ্টির প্যাকেটে করে বোমা বহনের বাস্তবতার চিত্রায়ণ!
যুদ্ধকালীন জীবনবাস্তবতা তুলে ধরতে ঔপন্যাসিক এবং নির্মাতা উভয়ে যে যার জায়গা থেকে সেরা। উপন্যাসে ‘আপা, এখন কে কাকে দেখবে?’ —এ প্রশ্নের সাথে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সম্পর্ক সহজেই অনুমেয়। অথবা সিনেমায় মিষ্টির প্যাকেটে করে বোমা বহনের বাস্তবতার চিত্রায়ণ!
সিনেমায় রূপদান করতে গিয়ে আনুষঙ্গিক পরিবর্তন করতেই হয় কিছু কিছু ক্ষেত্রে। তাতে প্রয়োজনে চরিত্রের যোজন-বিয়োজন অস্বাভাবিক কিছু নয়। ‘গেরিলা’য় বিলকিসের শ্বশুরালয়ের সংসারের কাহিনী দেখাতে গিয়ে তার বাপের বাড়ির ঘটনা ও চরিত্র কিছুটা অবহেলিত বলেই প্রতীয়মান। সিরাজ বা প্রদীপ চরিত্রের সংকোচন মেনে নেয়া গেলেও আলেফ মোক্তার চরিত্রটার গুরুত্ব সহজ কথায় অবহেলিত। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী চরিত্র থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জীবনদর্শন পাওয়া যায়। ঔপন্যাসিক সেই চিরায়ত চরিত্রনির্মাণ করলেও চিত্রনির্মাতা সেখান থেকে সরে এসেছেন, সরে এসেছেন জীবন বাঁচাতে পলায়নপর জনগোষ্ঠীর আধাখাওয়া খাবার ফেলে পালানোর দৃশ্যধারণ থেকে। এটা তর্কসাপেক্ষভাবে ভালো বা খারাপ দুইই হতে পারে। জানামতে, কারিগরি কৌশলগত আধুনিকতার ছোঁয়ায় নির্মিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম ছবি ‘গেরিলা’। এটি তুমুল জনপ্রিয়ও বটে। আমার নিজেরও পছন্দের তালিকায় ওপরের দিকে। তবু কেন জানি না মনে হয়, ‘নিষিদ্ধ লোবানে’র মতো চিরায়ত হওয়াটা ‘গেরিলা’র জন্য সহজ নয়।
‘নিষিদ্ধ লোবান’ ভাষাতাত্ত্বিকভাবে বিশেষায়িত এক জনপদের কাহিনী হলেও ঔপন্যাসিক সে বিশেষত্ব উপন্যাসে রাখেননি। বরং তিনি সাবলীল প্রমিত বাঙলাই ব্যবহার করেছেন। অবশ্য সমাজভাষাতত্ত্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে উপন্যাসে—
“সিরাজের মুখে একবার ‘আপা’ একবার ‘দিদি’ এই প্রথম কানে লাগে বিলকিসের। জলেশ্বরী হিন্দুপ্রধান জায়গা ছিল এক সময়। এখনো এখানে অনেক মুসলমান পরিবার দাদা-দিদি ব্যবহার করে। ‘আপা’ চল হয়েছে পাকিস্তান হবার পর। তার আগে ‘বুবু’ চলত। বুবু ডাক আশা করেনি বিলকিস, কিন্তু ‘আপা’ আর ‘দিদি’ এর কোনো একটা হলে তার কানে লাগত না। সম্বোধনের দুটোই ব্যবহার করাতে সিরাজকে তার বয়সের চেয়েও ছোট মনে হয়, বেড়ে ওঠা এক কিশোর মনে হয়, যে এখনো ঠিক অভ্যস্ত নয় অচেনা কোনো মহিলার সঙ্গে দীর্ঘকাল কথা বলতে।”
“সিরাজের মুখে একবার ‘আপা’ একবার ‘দিদি’ এই প্রথম কানে লাগে বিলকিসের। জলেশ্বরী হিন্দুপ্রধান জায়গা ছিল এক সময়। এখনো এখানে অনেক মুসলমান পরিবার দাদা-দিদি ব্যবহার করে। ‘আপা’ চল হয়েছে পাকিস্তান হবার পর। তার আগে ‘বুবু’ চলত। বুবু ডাক আশা করেনি বিলকিস, কিন্তু ‘আপা’ আর ‘দিদি’ এর কোনো একটা হলে তার কানে লাগত না। সম্বোধনের দুটোই ব্যবহার করাতে সিরাজকে তার বয়সের চেয়েও ছোট মনে হয়, বেড়ে ওঠা এক কিশোর মনে হয়, যে এখনো ঠিক অভ্যস্ত নয় অচেনা কোনো মহিলার সঙ্গে দীর্ঘকাল কথা বলতে।
আঞ্চলিক ভাষা-উপাদানের চাইতে সমাজভাষাবিজ্ঞান ভারিক্কি বিষয়। সমাজভাষাবিজ্ঞান সিনেমায় এত বিস্তারিতভাবে নিয়ে আসা বাস্তবে ঠিক সম্ভব নয়। কিন্তু আঞ্চলিক ভাষাউপাদানের সঠিক এবং পরিমিত ব্যবহার সিনেমাকে শিল্পগুণে সমৃদ্ধ করতে পারে। ‘গেরিলা’র ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। পুরান ঢাকা এবং কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত (প্রান্তউত্তরবঙ্গীয়) অঞ্চলের রূপমূল এবং ভাষাবৈচিত্র্যের পরিমিত ব্যবহার বিশিষ্টতা দিয়েছে সিনেমাকে। কলকাতার সিনেমায় পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক ভাষার সঠিক এবং পরিমিত ব্যবহারের বিপরীতে আমাদের দেশীয় নাটক-সিনেমায় ভুলভাল আঞ্চলিকতার এন্তার উপস্থিতি একটা দুশ্চিন্তার কারণ সবসময়ের জন্য। এরকম বাস্তবতার মধ্যে ‘গেরিলা’র ভাষাতাত্ত্বিক নৈপুণ্য স্বস্তিকর ব্যাপার। এই একটা জায়গায় বোধকরি সিনেমা উপন্যাসের কৃতিত্বকে কিছুটা হলেও ছাড়িয়ে গেছে।
অল্প কথায় বেশি বোঝাতে পারা লেখকের বড় গুণ। সে গুণের স্বাক্ষর মাত্র ৭২ পৃষ্ঠার উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’। সিনেমা হিসেবে সেলুলয়েডে ধরতে গেলে পরিবর্ধন প্রয়োজন স্বাভাবিকভাবেই। তাতে সফল বলতে হবে নাসিরুদ্দীন ইউসুফকে। শেষদৃশ্যে নারীর আত্মঘাতী আত্মরক্ষার লেখ্যরূপ এবং চিত্ররূপ আলাদা হওয়ায় আলাদাভাবেই মুগ্ধতা দিয়েছে কাজদুটো। সামগ্রিক বিচারে কলম আর ক্যামেরা —কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান!
বইয়ের নাম : নিষিদ্ধ লোবান
লেখক : সৈয়দ শামসুল হক
প্রচ্ছদ : মাসুক হেলাল
প্রকাশনী : অনন্য
পৃষ্ঠা : ৭২
মূল্য : ১৫০ টাকা
প্রথম প্রকাশ : ১৯৮১