‘কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড নোট’ কী আছে সেই চিঠিতে?

কাদম্বরী দেবী জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের বিভিন্ন ব্যাখ্যার মূল গন্তব্য বোধকরি সর্বত্রই এক—প্রেম। বিভিন্ন উৎসের দলিল থেকে বলা যেতে পারে প্রেমটা যদি থেকেও থাকে, তবে রবীন্দ্রনাথ আর ভবতারিণী দেবীর বিয়ের আগ পর্যন্তই ছিল। এই এক প্রেম এবং এক বিয়ের জের একটা আত্মহত্যায় গড়ায় বলে জানা যায়। কাদম্বরী দেবী রবীন্দ্রনাথের বিয়ের চারমাসের মাথায় আত্মহত্যা করেন।
এই বিষয়টি মুখে মুখে মুখরোচক হয়েছে, হয়েছে ফিকশনের উপাদান। রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় এই ব্যাপারটি নিয়ে কয়েকরকম দৃষ্টিকোণ থেকে কয়েকটি আলাদা আলাপ করেছেন। এ লেখার আলোচ্য ‘কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড নোট’।
কাদম্বরী দেবীর কথিত চিঠিতে বারবার দেখেছি তিনি বলার চেষ্টা করেছেন তিনি মিথ্যে বলেননি। এমনকি বিহারীলাল চক্রবর্তী প্রসঙ্গেও সৎ তিনি। তিনি যেখানে নিজেকে সত্যিকার অর্থেই প্রকাশ করে ফেলেছেন, নাটকীয়ভাবে, সেটি একটি নাট্যমঞ্চ ছিল! ‘অলীকবাবু’ শীর্ষক নাটকের মূল মঞ্চায়নেই আশ্চর্য দৃঢ়তায় নিজের ভালোবাসার নিবেদন করে বসেন কাদম্বরী দেবী!
কাদম্বরী দেবীর কথিত চিঠিতে বারবার দেখেছি তিনি বলার চেষ্টা করেছেন তিনি মিথ্যে বলেননি। এমনকি বিহারীলাল চক্রবর্তী প্রসঙ্গেও সৎ তিনি। তিনি যেখানে নিজেকে সত্যিকার অর্থেই প্রকাশ করে ফেলেছেন, নাটকীয়ভাবে, সেটি একটি নাট্যমঞ্চ ছিল! ‘অলীকবাবু’ শীর্ষক নাটকের মূল মঞ্চায়নেই আশ্চর্য দৃঢ়তায় নিজের ভালোবাসার নিবেদন করে বসেন কাদম্বরী দেবী!
কোনো একটা আলোচনায় বলেছিলাম, ‘য়ূরোপ-প্রবাসীর পত্র’-এর পাঠ কাদম্বরী-রহস্য উদ্ঘাটনে জরুরি নয়। আপাতত সে ধারণা অমূলক প্রমাণিত হলো। রবীন্দ্রনাথের বিলেতপ্রবাস তাঁর বিয়ের আগের ঘটনা। তখনকার পত্রগুলো অনুমিতভাবেই ‘য়ূরোপ-প্রবাসীর পত্র’ গ্রন্থে সংকলিত। সেখান থেকেই গুরুত্বপূর্ণগুলো ‘নতুনবউঠান’ শব্দযোগে উদ্ধৃত কাদম্বরী দেবীর পত্রে। এ শব্দ (নতুন বউঠান) পাওয়া যায় না ‘য়ূরোপ-প্রবাসীর পত্র’ গ্রন্থে।
এ বিষয়টিতে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিগ্রন্থ ‘আমার ছেলেবেলা’ গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এ গ্রন্থের কোথাও কাদম্বরী দেবীকে ‘নতুন বউঠান’ পরিচয় দেওয়া হয়নি। ‘বউ ঠাকরুন’ শব্দটি দেখা যায় সেখানে। অবশ্য সময়ের সাথে সম্বোধন পাল্টানো অমূলক নয়। শুধু সম্বোধনের বিষয়টি যদি এড়িয়েও যাওয়া হয়, তবে অন্য মোটামুটি সব আবেগগত এবং কার্যগত ঘটনাবলির বিবরণ মোটামুটি সম্পর্কিত সব গ্রন্থেই এক। কাকাতালীয়ভাবে কাদম্বরী দেবী এবং মৃণালিনী ওরফে ভবতারিণী দেবীর ঈর্ষাপরায়ণতার দৃষ্টিকোণও অনেকটাই এক। পার্থক্য রচিত হয়েছে ইন্দিরা দেবী প্রসঙ্গে। ইন্দিরা দেবী প্রসঙ্গ কাদম্বরী দেবীর ক্ষেত্রে অমূলক বলা যায়। রবীন্দ্রনাথের বিয়ের সময় কাদম্বরী-ইন্দিরা উভয়েই ছিলেন বরপক্ষ থেকো– জানা যায়। ইন্দিরার তখনকার আচরণে শ্রেণিবৈষম্য প্রকটিত হয়েছে বলে জানা যায়। ইন্দিরা দেবী রচিত ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’ পাঠে বিস্তারিত জানা যেতে পারত, যদি তিনি লিখতেন, সুযোগ থাকলেও লেখেননি সেভাবে।
সেই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের বরাত দিয়ে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কিছু চরণের উল্লেখ আছে, যা রাধার প্রতি কাহ্নাইয়ের প্রেমের প্রকাশক প্রশস্তি ধরা যায়। চিঠির দাবি, রবীন্দ্রনাথ কাহ্নাইয়ের রাধারূপেই দেখতেন কাদম্বরীকে।
কাদম্বরীর শরীরকে সরোবর হিসেবে উপমিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ- বলে দাবি করছে কাদম্বরীর সেই চিঠি। ভবতারিণী দেবীর নাম পাল্টে মৃণালিনী দেবী রাখেন রবীন্দ্রনাথ, আবার আনা খড়খড়কে নলিনী নাম দেবার নজিরও রয়েছে। এর পেছনে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব ব্যাখ্যা সবসময়ই ছিল।
কাদম্বরীর শরীরকে সরোবর হিসেবে উপমিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ- বলে দাবি করছে কাদম্বরীর সেই চিঠি। ভবতারিণী দেবীর নাম পাল্টে মৃণালিনী দেবী রাখেন রবীন্দ্রনাথ, আবার আনা খড়খড়কে নলিনী নাম দেবার নজিরও রয়েছে। এর পেছনে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব ব্যাখ্যা সবসময়ই ছিল।
রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজটি পড়তে গিয়ে চোখের সামনে ভেসেছে ‘ভালোবেসে সখি নিভৃতে যতনে’, ‘খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি’সহ আরও কিছু হৃদয়ছোঁয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত, যেগুলোর মূল রবীন্দ্রজীবনে কাদম্বরীঘটিত বিপর্যয়কে ইঙ্গিত করে।
হেথা হতে যাও পুরাতন!
হেথায় নতুন খেলা আরম্ভ হয়েছে!
—লাইন দুটো নিয়ে চিঠির অন্তত দুটো জায়গায় প্রশ্ন তুলেছেন কাদম্বরী দেবী। এই বিখ্যাত দুটো লাইন সত্যিই সংশয় জাগানিয়া। যেকোনো সাধারণ লোক স্রেফ নতুনের আবাহনে পুরাতন বিসর্জনের তত্ত্ব দাঁড় করাবেন এক্ষেত্রে।
যে জায়গায় থমকে গেছি হঠাৎ, সেখানে কাদম্বরী লিখেছেন—একটু আগেই আমি একটি একটি করে সবগুলো খেয়েছি। অনেকদিন ধরে জমিয়ে তোলা আফিমের গুলিগুলো। আর আমার পক্ষে ফিরে আসা সম্ভব নয়। সত্যিই চললাম। ‘কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড নোট’ বইয়ের ফার্স্ট ফ্ল্যাপে লেখা —১৮৮৪ সালের ১৯ এপ্রিল আফিম খেলেন নতুন বউঠান, আত্মহত্যার চেষ্টায়। মারা গেলেন ঠিক দুদিন পরে। হরিশংকর জলদাস তাঁর ‘আমি মৃণালিনী নই’য়ে ভবতারিণী দেবীর যে খাতাটি উদ্ধৃত করলেন তার অনুসরণে বলা যায় ১৯ এপ্রিলের সর্বোচ্চ দুদিন আগে তিনি আফিম যোগাড় করেন অতি গোপনে এক ছুটা গৃহভৃত্যের মাধ্যমে।
শেষোক্ত দুটি তথ্য প্রথম তথ্যের সাথে না মেলায় এক্ষেত্রে একটা বড়োসড়ো কিন্তু’র অবকাশ থেকে যায়।
আবার একথাও তোলা যায়—একজন নারী ওভাবে অতগুলো আফিম সেবন করে অচেতন অবস্থায় কী করে ভাষাগতভাবে এতটা গুছিয়ে এই চিঠি লিখলেন? যতই কাল্পনিক বলে স্বীকার করে নেওয়া হোক না কেন, এটা উপন্যাসের চরিত্রনির্মাণের একটা গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি হিসেবে বিবেচনা করতে হয়।
রেজওয়ান আহমেদ, শিক্ষার্থী, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য (৬ষ্ঠ আবর্তন), বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।